প্রথম আলো এক্সপ্লেইনার

প্রাথমিকে কেন সংগীত শিক্ষক, বিরোধিতায় কারা, কী বলছেন শিক্ষকেরা

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পদক্ষেপ নেওয়ার পাঁচ বছর পর এখন তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অবশ্য এর বিরোধিতাও হচ্ছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০২০ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগের প্রস্তাব তৈরি করেছিল। তার ভিত্তিতে গত বছর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই দুই বিষয়ে ৫ হাজার ১৬৬ জন শিক্ষক নিয়োগের প্রস্তাবে সম্মতি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে সংগীতের জন্য ২ হাজার ৫৮৩ জন এবং শারীরিক শিক্ষার ২ হাজার ৫৮৩ জন।

এরপর গত ২৮ আগস্ট ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৫’–এর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে অন্যান্য বিষয়বস্তুর পাশাপাশি সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের সুযোগ রয়েছে।

তবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বিভিন্ন সভা, সেমিনার, বিক্ষোভ সমাবেশে সংগীত শিক্ষকের বদলে ধর্ম শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার দাবি করেছেন। সংগীত শিক্ষক নিয়োগ বাতিল করা না হলে তাঁরা আন্দোলনেরও হুমকি দিচ্ছেন।

প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সংগীতের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের আলাদা পাঠ্যপুস্তক নেই। শিক্ষার্থীদের সংগীত বিষয়ে কোনো পরীক্ষা দিতে না হলেও বছর শেষে শিক্ষকেরা তাদের মূল্যায়ন করেন। এ জন্য শিক্ষক নির্দেশিকা দেওয়া আছে।

কেন সংগীত শিক্ষক

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারি (এপিএসসি) অনুযায়ী বর্তমানে সারা দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৫ হাজার ৫৬৭টি। এগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৬ লাখ ২০ হাজার ৬৬ এবং শিক্ষকের সংখ্যা ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৬২৪ জন।

প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে পড়ানো হয়। আর তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে ছয়টি বিষয় পড়ানো হয়। বিষয়গুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, প্রাথমিক বিজ্ঞান, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বাংলা এবং নিজ নিজ ধর্ম শিক্ষা।

প্রাথমিকে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ হয় না। প্রত্যেক শিক্ষকই সব বিষয় পড়ান। তবে কয়েক বছর ধরে ২০ শতাংশ পদ বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের দিয়ে পূরণ করা হচ্ছে। মূলত বিজ্ঞান ও গণিতে দক্ষতা বাড়াতেই এই পদক্ষেপ।

প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সংগীতের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের আলাদা পাঠ্যপুস্তক নেই। শিক্ষার্থীদের সংগীত বিষয়ে কোনো পরীক্ষা দিতে না হলেও বছর শেষে শিক্ষকেরা তাদের মূল্যায়ন করেন। এ জন্য শিক্ষক নির্দেশিকা দেওয়া আছে।

ঢাকা ও ঢাকার বাইরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেছেন, শিক্ষকদের গানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে যে শিক্ষকেরা আগে গান শেখেননি, তাঁরা প্রশিক্ষণ পেলেও তা খুব একটা কাজে লাগে না।

নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, ‘বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত যেসব সংগীত রাখা হয়েছে, সেগুলো শিক্ষার্থীরা আত্মস্থ করতে পারলে তাদের মধ্যে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের চেতনা, মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, শ্রমের প্রতি মর্যাদা ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হবে। শিক্ষার্থীর ভর্তির হার বাড়বে, ঝরে পড়া কমবে।’
প্রাথমিকে মোট ১৩টি গান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গানগুলো হলো জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল, মিঠা নদীর পানি’, ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’, ‘আমরা করব জয়’, ‘আল্লা মেঘ দে পানি দে’, ‘প্রজাপতি, প্রজাপতি! কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা’, ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’, ‘নিজের হাতে কাজ কর’, ‘চল চল চল’, ‘প্রিয় ফুল শাপলা ফুল’, ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’, ‘আমরা সবাই রাজা’ ও ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’।

ঢাকা ও ঢাকার বাইরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেছেন, শিক্ষকদের গানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে যে শিক্ষকেরা আগে গান শেখেননি, তাঁরা প্রশিক্ষণ পেলেও তা খুব একটা কাজে লাগে না।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন ও বিকাশ’ শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় ২০১০-১১ অর্থবছরে দেশের সব উপজেলা বা থানা শিক্ষা কর্মকর্তাকে তাঁর এলাকার নির্বাচিত ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হারমোনিয়াম, ডুগি ও তবলা কেনার নির্দেশনাসহ আর্থিক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।

প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবে সেসব কাজে লাগেনি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কেবল বাদ্যযন্ত্রগুলো চেনেন মাত্র। অথচ শিক্ষক নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, ‘শিক্ষক সুরে গাইবেন, শিক্ষার্থীরা তাঁর সঙ্গে গাইবে। যে শিক্ষার্থী সুরে গাইতে পারবে না, শিক্ষক তাকে চিহ্নিত করবেন।’

১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজধানীর বছিলা (পুরাতন) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মেরিনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারলে শিক্ষার্থীদের জন্যই ভালো হবে।

বিরোধিতায় কারা

১৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক সেমিনারে জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক পাঁচটি দলের নেতারা বলেন, লেখাপড়ার মানের অবনতি ঘটায় শিক্ষার্থীদের মানসিক ও আদর্শিক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সরকার সেদিকে লক্ষ না করে গানের শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে।

নেতাদের দাবি, সংগীত শিক্ষকের জায়গায় সরকারকে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। তা না হলে দেশের ইসলামপ্রেমী জনগণ রাজপথে নামতে বাধ্য হবেন।

প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবে সেসব কাজে লাগেনি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কেবল বাদ্যযন্ত্রগুলো চেনেন মাত্র। অথচ শিক্ষক নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, ‘শিক্ষক সুরে গাইবেন, শিক্ষার্থীরা তাঁর সঙ্গে গাইবে। যে শিক্ষার্থী সুরে গাইতে পারবে না, শিক্ষক তাকে চিহ্নিত করবেন।’

জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নেতাদের অংশগ্রহণে এ সেমিনারের আয়োজন করে জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ।

সেমিনারের মূল প্রবন্ধে মুফতি আবদুল্লাহ মাসুম ও মুফতি ইউসুফ সুলতান ছয়টি প্রস্তাব তুলে ধরেন।

প্রস্তাবগুলোর মধ্যে আছে—প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন যোগ্য ও স্বতন্ত্র ধর্ম শিক্ষক নিয়োগ; ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা ২০২৫’ গেজেট সংশোধন করে ধর্ম শিক্ষক নিয়োগের বিধান সংযোজন, নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও মানোন্নয়নের ব্যবস্থা করা এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান) শিক্ষার্থীদের জন্যও তাদের ধর্ম অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা রাখা ইত্যাদি।

জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক পাঁচটি দলের নেতারা বলেন, লেখাপড়ার মানের অবনতি ঘটায় শিক্ষার্থীদের মানসিক ও আদর্শিক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সরকার সেদিকে লক্ষ না করে গানের শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে।

গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েও নেতারা সংগীত শিক্ষক নিয়োগের বিরোধিতা করছেন।
এর আগে ১২ সেপ্টেম্বর ধর্ম শিক্ষক হিসেবে আলেমদের নিয়োগ দেওয়ার দাবিতে রাজধানীর বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা ২০২৫ অনুযায়ী নিয়োগ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটির চেয়ারম্যান প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।

জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় বা সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যে সিদ্ধান্ত দেবেন, অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে তা বাস্তবায়ন করব। চলমান আন্দোলন নিয়ে বক্তব্য দিতে চাই না।’ তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, গান ও চারু বা কারুকলার মতো সৃজনশীল বিষয় শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য জরুরি।

সব বিদ্যালয়ে কি সংগীত শিক্ষক থাকবে

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, একেকটি জেলা-উপজেলায় ২০ থেকে ২৫টি বিদ্যালয় মিলে একটি করে ক্লাস্টার (গুচ্ছ) হয়। একটি ক্লাস্টারের জন্য একজন করে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষক নেওয়া হবে। তাঁরা স্কুলে ঘুরে ঘুরে শিক্ষার্থীদের সংগীত ও শারীরিক শিক্ষাবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেবেন।

মন্ত্রণালয় বা সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যে সিদ্ধান্ত দেবেন, অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে তা বাস্তবায়ন করব। চলমান আন্দোলন নিয়ে বক্তব্য দিতে চাই না।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান

নোয়াখালী সদরের কৃপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার ক্লাস প্রতিদিন হলেও নির্দিষ্ট কোনো শিক্ষক নেই। উপস্থিত শিক্ষকদের মধ্যে যাঁরা ধর্ম শিক্ষায় মোটামুটি ভালো, তাঁরা ক্লাসগুলো নেন। ধর্মীয় ক্লাস কার্যকরভাবে নেওয়ার জন্য ধর্ম শিক্ষক নিয়োগ এবং শিশুর মানসিক ও নান্দনিক বিকাশের স্বার্থে সংগীতের শিক্ষক নিয়োগ—দুটিই গুরুত্বপূর্ণ।

ধর্ম ও সংস্কৃতিচর্চার মধ্যে তো কোনো সংঘাত নেই। একটি বাদ দিয়ে অন্যটি করার বিষয়ও নয়। ধর্মচর্চা শিশুদের চিন্তা ও মননকে নৈতিক ও পরিশীলিত করে। সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার মতো বিষয়গুলো শিশুদের মেধা ও শারীরিক বিকাশ ঘটায়।
রাশেদা কে চৌধূরী, গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক

শিক্ষা অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ধর্ম ও সংস্কৃতিচর্চার মধ্যে তো কোনো সংঘাত নেই। একটি বাদ দিয়ে অন্যটি করার বিষয়ও নয়। ধর্মচর্চা শিশুদের চিন্তা ও মননকে নৈতিক ও পরিশীলিত করে। সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার মতো বিষয়গুলো শিশুদের মেধা ও শারীরিক বিকাশ ঘটায়।

‘বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে, নিছক পুঁথিগত বিদ্যা দিয়ে শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। গানসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে শিশুদের সম্পৃক্ত করতে পারলে তাদের মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন প্রযুক্তিগত ডিভাইসের নেশা থেকেও দূরে রাখা সম্ভব হবে,’ যোগ করেন রাশেদা কে চৌধূরী।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা আরও বলেন, গানের শিক্ষক নিয়োগের গুরুত্ব সরকারকেই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়ে স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে। এই নিয়োগ থেকে সরকার যাতে পিছিয়ে না যায়, সেই সুপারিশও করেন তিনি।