লন্ডনভিত্তিক প্রখ্যাত দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর (এফটি) সম্পাদক লিওনেল বারবার ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে সব কর্মীকে একটি ই-মেইল বার্তা পাঠিয়েছিলেন। সেই ই-মেইল এখন গণমাধ্যম ইতিহাসের একটি অংশ। ই-মেইলে লিওনেল বারবার ঘোষণা দিয়েছিলেন যে এখন থেকে এফটি ‘ডিজিটাল ফার্স্ট’ নীতি অনুসরণ করবে। তিনি এটিকে প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি বড় সাংস্কৃতিক পরিবর্তন উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘এফটি তখনই টিকে থাকতে পারবে, যদি এটি ডিজিটাল ও প্রিন্ট—দুই দিকের পাঠকের চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে।’
লন্ডনভিত্তিক আরেক পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান অবশ্য এত দেরি করেনি। ২০১১ সালের জুনেই গার্ডিয়ান মিডিয়া গ্রুপের প্রধান নির্বাহী অ্যান্ড্রু মিলার ঘোষণা দিয়ে ডিজিটাল ফার্স্ট নীতি অনুসরণের কথা জানিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস মাঠে নেমেছিল আরেকটু পরে, ২০১৪ সালে। তারাও বিশাল খরচ ও আয় কমে যাওয়ায় চাপ থেকে রক্ষা পেতে চেয়েছিল। আসলে পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়াগুলো ঠিকই বুঝতে পেরেছিল যে মানুষের পাঠাভ্যাস পাল্টে যাচ্ছে। ইন্টারনেট খবর জানার নিত্যনতুন পথ বের করে দিচ্ছে। ডিজিটাল ফার্স্ট নীতি এফটি, গার্ডিয়ান বা নিউইয়র্ক টাইমসকে নতুন জীবন দিয়েছে বলা যায়।
প্রথম আলোর ডিজিটাল যাত্রা শুরু হয়েছিল এরও এক যুগ আগে। ১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর আত্মপ্রকাশের সময় ডিজিটাল যুগ শুরু হয়নি, বলা যায় উঁকি মারছে কেবল। ইন্টারনেটের প্রসার ঘটলেও আবিষ্কার হয়নি স্মার্টফোনের। ফলে অন্যদের মতো প্রথম আলোর একটি ডিজিটাল উপস্থিতি ছিল ঠিকই, তবে খুবই সীমিত পরিসরে। সেই সময় থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত—এই ২২ বছরে প্রথম আলো ডিজিটাল উপস্থিত ছিল ছাপা পত্রিকার একটি অনুষঙ্গ হিসেবে। আর এই সময়ের মধ্যেই ইন্টারনেটের প্রসার ঘটেছে ব্যাপকভাবে, জীবনযাপনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে স্মার্টফোন। এতে পাল্টে গেছে সংবাদ প্রকাশ ও পড়ার ধরন। এ কারণেই টিকে থাকতে বিশ্বের বড় বড় মিডিয়া বেছে নিয়েছিল ডিজিটাল ফার্স্ট নীতিকে।
সমন্বিত বার্তা বিভাগের যাত্রা শুরু। এর আগপর্যন্ত প্রথম আলোয় দুটি বার্তাকক্ষ ছিল। একটি ছাপা পত্রিকার জন্য, অন্যটি কেবল অনলাইনের জন্য। কোভিড মহামারির মধ্যেই বার্তা বিভাগকে সমন্বিত করা হয়। অর্থাৎ প্রত্যেকেই কাজ করবেন ছাপা পত্রিকা ও অনলাইনের জন্য।
প্রকাশের পরপরই ছাপা পত্রিকায় প্রভাব বিস্তারে খুবই কম সময় নিয়েছিল প্রথম আলো। আর ডিজিটাল দুনিয়ায় তো পা রেখে দিয়েছিল প্রথম দিন থেকেই। শুরু থেকে প্রথম আলোর সেই পথরেখাটি আবার সংক্ষেপে জানা যাক।
৪ নভেম্বর, ১৯৯৮: প্রথম আলো ডটকমের যাত্রা শুরু। তবে কেবল প্রথম পাতা ও শেষ পাতার লেখাগুলো অনলাইন সংস্করণে স্থান পেত।
অক্টোবর, ২০০৬: প্রথম হালনাগাদ সংবাদ দেওয়া শুরু। সকাল ও সন্ধ্যায় সংবাদ হালনাগাদ করা হতো। তখন বিএনপি সরকারের ক্ষমতা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে হস্তান্তর করার সময়। রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত। আবার অক্টোবরের ২২ তারিখ থেকে ঈদের ছুটি শুরু। পত্রিকা বন্ধ থাকবে। সেই সময়ের চাহিদা মেটাতেই অনলাইনে হালনাগাদ সংবাদ দেওয়া শুরু হয়েছিল।
তখন অর্থের বিনিময়ে হালনাগাদ সংবাদ পড়তে হতো। এ জন্য নিউইয়র্কে পেপ্যালে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল। দেশেও অর্থ নেওয়া শুরু হয়েছিল। যদিও পরে তা আর অব্যাহত রাখা হয়নি।
নভেম্বর, ২০১০: ফেসবুকে যাত্রা শুরু, খোলা হয় প্রথম আলো পেজ। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে এই পেজের ভেরিফায়েড প্রাপ্তি, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে এক কোটি ফলোয়ার অর্জন। এখন ফলোয়ারের সংখ্যা ২ কোটি ১০ লাখ।
সেপ্টেম্বর, ২০০৮: অনলাইনের জন্য আলাদা জনবল নিয়োগ শুরু। ধীরে ধীরে জনবল বৃদ্ধি, সহসম্পাদকদের পাশাপাশি রিপোর্টার নিয়োগ, আলাদা টিম তৈরি।
৪ নভেম্বর, ২০০৮: প্রথম আলোর দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ই-পেপার অর্থাৎ ই-প্রথম আলো চালুর ঘোষণা। ২০০৯ সালের ৪ এপ্রিল প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ই-প্রথম আলোর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন।
নভেম্বর, ২০১০: ফেসবুকে যাত্রা শুরু, খোলা হয় প্রথম আলো পেজ। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে এই পেজের ভেরিফায়েড প্রাপ্তি, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে এক কোটি ফলোয়ার অর্জন। এখন ফলোয়ারের সংখ্যা ২ কোটি ১০ লাখ।
১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১১: প্রথম আলোর ইংরেজি ভার্সন শুরু।
সেপ্টেম্বর, ২০২০: সমন্বিত বার্তা বিভাগের যাত্রা শুরু। এর আগপর্যন্ত প্রথম আলোয় দুটি বার্তাকক্ষ ছিল। একটি ছাপা পত্রিকার জন্য, অন্যটি কেবল অনলাইনের জন্য। কোভিড মহামারির মধ্যেই বার্তা বিভাগকে সমন্বিত করা হয়। অর্থাৎ প্রত্যেকেই কাজ করবেন ছাপা পত্রিকা ও অনলাইনের জন্য। বাংলাদেশে মিডিয়া জগতে এটাই ছিল প্রথম সমন্বিত বার্তাকক্ষ।
অনলাইন মানে ২৪ ঘণ্টাই বার্তাকক্ষ খোলা। যখনই ঘটনা, তখনই উঠে যাবে সঠিক সংবাদটি। এরপরই চলবে পর্যায়ক্রমে হালনাগাদ। আর দিন শেষে পূর্ণাঙ্গ একটি লেখা তৈরি হবে ছাপা পত্রিকার জন্য। এই নীতি কার্যকর করার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা মনোজগতের পরিবর্তন। কাজটি সহজ হচ্ছিল না।
বিশ্বজুড়েই পাঠকদের পাঠাভ্যাস অনেকখানি বদলে দিয়েছে কোভিড-১৯ মহামারি। তাঁরা অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন কম্পিউটারে বা মুঠোফোনে পড়তে ও দেখতে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রথম আলোও অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ডিজিটালকেও অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া শুরু করে। সমন্বিত বার্তাকক্ষ তৈরি তার বড় প্রমাণ। মুঠোফোন উপযোগী কনটেন্ট বা আধেয় তৈরিকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়।
দুনিয়াজুড়েই যাদের যাত্রা শুরু ছাপা পত্রিকা দিয়ে, তাদের পক্ষে ডিজিটাল ফার্স্ট নীতি গ্রহণ মোটেই সহজ হয়নি। ছাপা পত্রিকার জন্য লেখা শুরু হয় শেষবেলায়। কিন্তু অনলাইন মানে ২৪ ঘণ্টাই বার্তাকক্ষ খোলা। যখনই ঘটনা, তখনই উঠে যাবে সঠিক সংবাদটি। এরপরই চলবে পর্যায়ক্রমে হালনাগাদ। আর দিন শেষে পূর্ণাঙ্গ একটি লেখা তৈরি হবে ছাপা পত্রিকার জন্য। এই নীতি কার্যকর করার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা মনোজগতের পরিবর্তন। কাজটি সহজ হচ্ছিল না।
কাজটি সহজে করার তাগিদ থেকেই ২০২৫ সালে নেওয়া হয় নতুন উদ্যোগ, নতুন পরিকল্পনা। এ জন্য সহায়তা নেওয়া হয়েছে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস স্ট্র্যাটেজি নামের বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত মিডিয়া পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের। মূলত বিশ্বের বড় ও সফল গণমাধ্যম যেভাবে ডিজিটাল ফার্স্ট নীতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে, সেটাই অনুসরণ করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পনার মূল কথা ছিল, সবাই অনলাইনের জন্য লিখবেন, নিউজ ব্যবস্থাপকদের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব থাকবে, তাঁদের প্রথাগত পদ ও পদবির পরিবর্তন হবে এবং ছাপা পত্রিকা বের করবে একটি আলাদা টিম।
ডিজিটাল রূপান্তরের জন্য এই পরিবর্তনের সুফল পেয়েছে প্রথম আলো। এখন সবাই অনলাইনের জন্য কাজ করেন। ছাপা পত্রিকার জন্য পরিকল্পনা করাও তাতে সহজ হয়েছে। কর্মীদের মনোজগতে এসেছে বড় পরিবর্তন। আর তাতে সবচেয়ে বেশি সুফল পাচ্ছেন পাঠকেরা।
আমরা জানি, পাঠকেরা এখন দিনের ঘটনা যেমন দ্রুত জানতে চান, তেমনি পড়তে চান বড় ও ভালো লেখা। অনলাইনে দিনের ঘটনা প্রকাশ করা হবে আর বিশেষ রিপোর্ট, অনুসন্ধানী রিপোর্ট ছাপা হবে কেবল ছাপা পত্রিকায়—এখান থেকেও বের হয়ে গেছে প্রথম আলো। ফলে নানা ধরনের লেখা এখন প্রথমেই প্রকাশ করা হচ্ছে অনলাইনে। এ জন্য নিউজ ব্যবস্থাপকদের পদবিতে আনা হয়েছে বড় পরিবর্তন। এখন ব্রেকিং নিউজের দায়িত্বে আছেন ‘হেড অব ফাস্ট নিউজ’, বিশেষ নিউজের দায়িত্বপ্রাপ্তের পদ হচ্ছে, ‘হেড অব ডিপ নিউজ’। আমরা জানি, বর্তমান সময়টা রাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর অপরাধ নিউজের প্রতি রয়েছে পাঠকের বিপুল আগ্রহ। এ জন্য রাজনীতি ও অপরাধসংক্রান্ত নিউজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জ্যেষ্ঠ একজন সাংবাদিককে। তেমনিভাবে মূল ডেস্কেও কাজের ব্যবস্থাপনায় এসেছে পরিবর্তন।
পাঠকের আগ্রহ আছে বাণিজ্য, খেলা, বিনোদন, লাইফস্টাইলসহ নানা বিষয়ের প্রতি। পড়তে চান ভিন্ন ভিন্ন মত নিয়ে নানা ধরনের লেখা। এসব ক্ষেত্রেও কর্মপ্রবাহে পরিবর্তন আনা হয়েছে, যাতে একজন পাঠক মুঠোফোনটি হাতে নিয়েই জানতে পারেন সর্বশেষ সংবাদ, খবরের পেছনের খবর আর নানা মতের বিশ্লেষণ, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি।
ডিজিটাল রূপান্তরের জন্য এই পরিবর্তনের সুফল পেয়েছে প্রথম আলো। এখন সবাই অনলাইনের জন্য কাজ করেন। ছাপা পত্রিকার জন্য পরিকল্পনা করাও তাতে সহজ হয়েছে। কর্মীদের মনোজগতে এসেছে বড় পরিবর্তন। আর তাতে সবচেয়ে বেশি সুফল পাচ্ছেন পাঠকেরা।
প্রথম আলো ভালো কনটেন্টকে যেমন গুরুত্ব দেয়, তেমনি নজর রাখে পাঠকের আগ্রহের দিকেও। আবার গণমাধ্যমগুলোর কাজের ধারায় যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। সবকিছুই দ্রুত বদলাচ্ছে। এসবের মধ্যে ডিজিটাল যুগে আসল নীতির নামই হচ্ছে ‘অডিয়েন্স ফার্স্ট’, অর্থাৎ পাঠকই সবার আগে। সঙ্গে ছাপা পত্রিকাও গুরুত্বপূর্ণ।
শুরুতে ছিল ডিজিটাল ফার্স্ট নীতি। ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের ব্যাপক প্রসারের কারণে তারপর বলা হলো হতে হবে মোবাইল ফার্স্ট। এটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হতে না হতেই চলে এসেছে ভিডিওর যুগ। এখন বলা হচ্ছে, ভিডিও ফার্স্ট। অর্থাৎ এখন থেকে লেখা ও দেখা—দুটোই সমানতালে চালাতে হবে। কেননা, প্রথম আলো ভালো কনটেন্টকে যেমন গুরুত্ব দেয়, তেমনি নজর রাখে পাঠকের আগ্রহের দিকেও। আবার গণমাধ্যমগুলোর কাজের ধারায় যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। সবকিছুই দ্রুত বদলাচ্ছে। এসবের মধ্যে ডিজিটাল যুগে আসল নীতির নামই হচ্ছে ‘অডিয়েন্স ফার্স্ট’, অর্থাৎ পাঠকই সবার আগে। সঙ্গে ছাপা পত্রিকাও গুরুত্বপূর্ণ।
শওকত হোসেন, হেড অব অনলাইন
প্রথম আলো