অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েই চলেছে, কমানোর পথ কী 

স্বাধীনতার পর গত প্রায় সাড়ে পাঁচ দশকে বাংলাদেশ প্রায় সব ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি অর্জন করেছে। কিন্তু এই সাফল্যের বিপরীতে একটি উদ্বেগের বিষয়ও ক্রমেই বেড়েছে, তা হলো বৈষম্য। সম্পদ, আয়, সুযোগ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন এমন মাত্রায় পৌঁছেছে, যা সামাজিক ন্যায়বিচার, অংশগ্রহণ ও স্থিতিশীল উন্নয়নের ভিত্তি দুর্বল করে দিচ্ছে।

২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থানের ব্যাপ্তি ও তীব্রতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, ন্যায্যতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত না হলে প্রবৃদ্ধির ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়ে। গণ–অভ্যুত্থান একটি মৌলিক প্রশ্ন সামনে এনেছে—কাদের জন্য উন্নয়ন? কারা সিদ্ধান্ত নেবে এবং কারা সুফল পাবে? গণ–অভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই কেবল অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক ন্যায়বিচারের সঙ্গেও জড়িত।

কেবল আয় নয়, বৈষম্যের পরিধি অনেক বিস্তৃত

বাংলাদেশে বৈষম্য নিয়ে আলোচনা প্রায়ই আয়বৈষম্যের মধ্যে সীমিত থাকে; কিন্তু বৈষম্য অনেক গভীর ও বহুমাত্রিক। প্রবেশাধিকার, মালিকানা, সুযোগ, কণ্ঠস্বর ও মর্যাদা ইত্যাদিসহ সমাজের প্রতিটি স্তরে বৈষম্য রয়েছে। 

আয়বৈষম্যের সূচক গিনি সহগ ০.৪৯ অতিক্রম করেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম উচ্চ। এই সংখ্যা প্রতিফলিত করে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল একটি ক্ষুদ্র অংশের হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। সম্পদবৈষম্য আরও গভীর; ভূমি, আবাসন ও আর্থিক সম্পদের মালিকানা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী একটি শ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বৈষম্য সমাজকে আরেকটি স্তরে ভাগ করে দিয়েছে। সরকারি স্কুল ও হাসপাতালের মান কমে যাওয়ায় সামর্থ্যবানেরা বেসরকারি সেবা গ্রহণ করছেন, দরিদ্ররা নিম্নমানের সেবায় আটকে পড়েছেন। 

লিঙ্গ, জাতিগত ও ধর্মীয় বৈষম্য এখনো গভীর। নারী শ্রমিকেরা কম মজুরিতে ও অনিরাপদ কর্মপরিবেশে কাজ করছেন; আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক প্রান্তিকতায় ভুগছে। কণ্ঠস্বরের বৈষম্য সবচেয়ে সূক্ষ্ম, কিন্তু বিপজ্জনক। সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়ায় নাগরিক সমাজ, শ্রমজীবী মানুষ ও তরুণদের কণ্ঠস্বর প্রায় অনুপস্থিত।

কাঠামোগত বৈষম্যের অর্থনৈতিক শিকড়

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো এমনভাবে গঠিত, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৈষম্য পুনরুৎপাদন করে। রাজস্বনীতি, শিল্পনীতি, আর্থিক খাত, শ্রমবাজার—সব ক্ষেত্রেই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও দুর্নীতি বৈষম্যকে স্থায়ী করে তুলেছে। রাজস্বকাঠামো বৈষম্যের অন্যতম প্রধান উৎস। রাজস্ব আয়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আসে পরোক্ষ কর থেকে, যা দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর বেশি চাপ সৃষ্টি করে। অন্য দিকে উচ্চ আয়শ্রেণি নানা করছাড় পায়, রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক ফাঁকফোকর ব্যবহার করে কর এড়িয়ে যায়। ফলে রাজস্বব্যবস্থার ন্যায্যতা ভেঙে পড়ে। 

শিল্পনীতি ও বিনিয়োগ কাঠামোতেও একই প্রবণতা। রাষ্ট্র বড় পুঁজিপতি ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনা, করছাড় ও ব্যাংকঋণ বরাদ্দ করে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সহজে ঋণ পান না। খেলাপি ঋণ, ব্যাংক লুট, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের অদক্ষ ব্যবস্থাপনা ধনীদের সম্পদ সুরক্ষিত করেছে, সাধারণ আমানতকারীর আস্থা নষ্ট করেছে। ব্যাংক খাত কার্যত নীতিনির্ধারক ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। 

অন্যদিকে শিক্ষা ও শ্রমবাজারের দুর্বলতা দরিদ্রদের পিছিয়ে রেখেছে। মানসম্মত শিক্ষার অভাবে তাঁরা দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পাচ্ছেন না; শ্রমবাজারে তাঁদের মূল্য সর্বনিম্ন পর্যায়ে সীমাবদ্ধ। এই বৈষম্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত।

পথই তাঁদের বাসস্থান, তাঁদের রান্নাঘর

কাঠামোগত বৈষম্যের রাজনৈতিক শিকড়

অর্থনৈতিক বৈষম্যের পেছনে রয়েছে গভীর রাজনৈতিক বৈষম্য ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ ও সম্পদের বণ্টন রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে নির্ধারিত হচ্ছে, যার ফলে অর্থনীতি হয়ে উঠেছে একচেটিয়া ও অস্বচ্ছ। দলীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও স্বজনপ্রীতি রাজনৈতিক অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে। বাজেট বরাদ্দ, সরকারি ক্রয়, ব্যাংকঋণ বিতরণ, এমনকি সরকারি চাকরিতেও রাজনৈতিক পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। ফলে সম্পদ বণ্টনের ন্যায্যতা বিনষ্ট হচ্ছে এবং একটি ক্ষুদ্র রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর হাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হচ্ছে।

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা এই বৈষম্যকে স্থায়ী করে তুলেছে। সংসদ, স্থানীয় সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কার্যকর নয়; বরং অনেক ক্ষেত্রে তারা ক্ষমতাকেন্দ্রের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে কাজ করতে পারেনি। এর ফলে দুর্নীতি ও শাসনব্যর্থতা বৈষম্যের কাঠামোগত ইঞ্জিনে পরিণত হয়েছে। সরকারি চুক্তি, বড় প্রকল্প, ব্যাংকঋণ ও ব্যবসায়িক লাইসেন্স প্রায়ই রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতার ভিত্তিতে বণ্টিত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় বাজার প্রতিযোগিতা ভেঙে যায়, নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ কমে যায় এবং সম্পদ একটি শ্রেণির হাতে জমা হয়। 

এ ছাড়া রাষ্ট্রের দলীয়করণ ও নাগরিক সমাজের সংকোচন বৈষম্যের রাজনৈতিক শিকড়কে আরও গভীরে নিয়ে গেছে। প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও গণমাধ্যম দলীয় প্রভাবাধীন হয়ে পড়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ভেঙে গেছে। নাগরিক সমাজ, ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক সংগঠনগুলোকে নীরব করে রাখা হয়েছে, ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিজেদের অধিকার রক্ষার কোনো শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম পায় না।

কুজনেটস কার্ভের মিথ ভাঙা

অর্থনীতিবিদ সাইমন কুজনেটস ১৯৫৫ সালে তাঁর বিখ্যাত তত্ত্বে বলেছিলেন, উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে বৈষম্য বাড়ে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যখন শিক্ষা, শিল্পায়ন ও সামাজিক সুযোগ বাড়ে, তখন বৈষম্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে যায়। এ ধারণা অর্থনীতির পাঠ্যবইয়ে দীর্ঘদিন ধরে স্বীকৃত ছিল, অনেক উন্নয়নশীল দেশ ভেবেছিল যে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কিছুটা বৈষম্য ‘স্বাভাবিক’। 

কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা এই তত্ত্ব স্পষ্টভাবে খণ্ডন করেছে। গত দুই দশকে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ধারাবাহিক ও দৃঢ়, প্রতিবছর ৬ থেকে ৭ শতাংশ; কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি জনগণের বৃহত্তর অংশে সমানভাবে পৌঁছায়নি। ফলে সার্বিক বৈষম্য কমেনি, বরং বেড়েছে। 

কিন্তু ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া দেখিয়েছে, উন্নয়নের সঙ্গে বৈষম্য অনিবার্য নয়। ভিয়েতনাম ১৯৯০-এর দশকে বাজার সংস্কারের সমান্তরালে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক সরকারি বিনিয়োগ করে। এর ফলে গ্রামীণ শ্রমিক ও ক্ষুদ্র কৃষক শ্রেণি উন্নয়নের মূল অংশীদার হয়ে ওঠে এবং বৈষম্য নিয়ন্ত্রিত থাকে। মালয়েশিয়া ১৯৭০–এর দশকে ‘নিউ ইকোনমিক পলিসি’ গ্রহণ করে, যার লক্ষ্য ছিল জাতিগত বৈষম্য হ্রাস করা, শিক্ষা ও পুঁজির মালিকানায় বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং সামাজিক সুরক্ষা নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করা। 

এই উদাহরণগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে বৈষম্য ‘অপরিহার্য উন্নয়ন পর্ব নয়’, বরং নীতিনির্ভর সিদ্ধান্তের ফল।

বৈষম্য কমাতে কী করা উচিত

বৈষম্য কমাতে শুধু অর্থনৈতিক সংস্কার নয়, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণও প্রয়োজন। প্রথমত, প্রগতিশীল কর সংস্কার অপরিহার্য। আয়কর, সম্পত্তি কর ও উত্তরাধিকার করের আওতা বাড়াতে হবে; কর ফাঁকি রোধে ডিজিটাল ট্র্যাকিং–ব্যবস্থা চালু করতে হবে। রাজস্বনীতি এমনভাবে সাজাতে হবে, যেন তা জনগণের স্বার্থে কাজ করে, ধনিক শ্রেণির স্বার্থে নয়। 

দ্বিতীয়ত, সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও সর্বজনীন করতে হবে। উপকারভোগী নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও ডিজিটাল পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। 

তৃতীয়ত, দুর্নীতি ও শাসনব্যর্থতা নিয়ন্ত্রণ এখন সবচেয়ে জরুরি। গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অকস্মাৎ দুর্নীতি ও ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বৈষম্যের গতি ত্বরান্বিত করেছে। সরকারি ক্রয়, ব্যাংকঋণ ও প্রকল্প বণ্টনে স্বজনপ্রীতি সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট করেছে। দুর্নীতিকে কেবল নৈতিক সমস্যা হিসেবে নয়, বৈষম্যের কাঠামোগত ইঞ্জিন হিসেবে দেখতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও আর্থিক তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত করতে হবে। 

চতুর্থত, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অপরিহার্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, নির্বাচন কমিশন, গণমাধ্যম ও স্থানীয় সরকার—এসব প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ছাড়া ন্যায়বিচারভিত্তিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। 

পঞ্চমত, রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। নীতি প্রণয়নে নাগরিক সমাজ, তরুণ প্রজন্ম, নারী ও শ্রমজীবীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ দরকার। গণতান্ত্রিক কাঠামো পুনর্গঠন করতে হবে, যেন ক্ষমতার কেন্দ্র জনগণের কাছে ফিরে আসে।

সেলিম রায়হান

অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়