৫০টি তালগাছ মেরে ফেলার চেষ্টা, ওসি বললেন আওয়ামী লীগ নেতা জড়িত

শাহরিয়ার আলম নিজের আমগাছগুলো দ্রুত বড় করে তোলার জন্য সড়কের পাশের তালগাছে কীটনাশক প্রয়োগ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বাগমারার মাথাভাঙ্গা-হাটগাঙ্গোপাড়া বাইগাছা এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

রাজশাহীর বাগমারার বাইগাছা এলাকায় ৫০টি তালগাছ মেরে ফেলার চেষ্টায় উপজেলার শুভডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি শাহরিয়ার আলম ও তাঁর লোক জড়িত, প্রাথমিক তদন্তে এটা পাওয়া গেছে বলে হাইকোর্টকে জানিয়েছেন বাগমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)।  

বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি এ কে এম রবিউল হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে আজ বৃহস্পতিবার ওই তথ্য তুলে ধরেন বাগমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আমিনুল ইসলাম। তাঁর উদ্দেশে আদালত বলেন, অতিসতর্কতার সঙ্গে আইওকে (তদন্ত কর্মকর্তা) তদন্ত করতে বলবেন। তদন্ত যেন কোনোভাবে প্রভাবিত না হয়। শুনানি নিয়ে আদালত আগামী ৪ এপ্রিল পরবর্তী শুনানির জন্য দিন রেখেছেন।

রাজশাহীর বাগমারায় উপজেলার সড়কের বাইগাছা এলাকায় নিজের পুকুরপাড়ে আমগাছ লাগিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শাহরিয়ার আলম। পুকুরটি মূলত মাথাভাঙ্গা-হাটগাঙ্গোপাড়া সড়কঘেঁষা। ওই সড়কের পাশে আগে থেকেই তালগাছ লাগানো ছিল। এসব তালগাছের ছায়ার কারণে শাহরিয়ারের লাগানো আমগাছগুলো ঠিকমতো বেড়ে উঠছে না। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, নিজের গাছগুলো দ্রুত বড় করে তোলার জন্য তালগাছের বাকল তুলে সেখানে কীটনাশক প্রয়োগ করেছেন শাহরিয়ার আলম। এতে সড়কের পাশে থাকা অন্তত ৫০টি তালগাছ মরে যাচ্ছে।    

২৭ জানুয়ারি প্রথম আলো অনলাইনে ‘সড়কের পাশের অর্ধশত তালগাছ মারতে বাকল তুলে কীটনাশক প্রয়োগ করলেন আ.লীগ নেতা’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর ৩১ জানুয়ারি ‘৫০ তালগাছে কীটনাশক: দোষীর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ কেন নয়’ শিরোনামে প্রথম আলোয় সম্পাদকীয় ছাপা হয়। এটি নজরে আসার পর ১ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের একই বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত রুলসহ আদেশ দেন। কীটনাশক প্রয়োগের বিষয়ে ব্যাখ্যা জানাতে উপজেলার শুভডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি শাহরিয়ার আলমকে ১২ ফেব্রুয়ারি আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন নিয়ে কৃষি কর্মকর্তাকে সেদিন আদালতে উপস্থিত হতে বলা হয়।

ধার্য তারিখ ১২ ফেব্রুয়ারি শাহরিয়ার আলম আদালতে হাজির হন। বাগমারা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আবদুর রাজ্জাক প্রতিবেদন দাখিল করেন। কৃষি কর্মকর্তার প্রতিবেদনের ভাষ্য, আমগাছের বড় হওয়ার প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য তালগাছগুলোর বাকল তুলে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে মারার অপচেষ্টা হয়েছে। তালগাছ রক্ষার্থে তাঁর (শাহরিয়ার আলম) কোনো উদ্যোগ ও আন্তরিকতা পরিলক্ষিত হয়নি। তালগাছগুলোর ক্ষতি করার পেছনে তাঁর ব্যক্তিগত স্বার্থ রয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে শাহরিয়ার জড়িত মর্মে কৃষি কর্মকর্তা মনে করেন। অন্যদিকে ঘটনায় সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে শাহরিয়ারের পক্ষ থেকে শুনানিতে দাবি করা হয়, বিদ্বেষপ্রসূত ঘটনাটি প্রচারিত হয়েছে।

শুনানি নিয়ে ১২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট ২৩ ফেব্রুয়ারি শুনানির দিন ধার্য করেন। প্রতিবেদনের সত্যতা বিষয়ে প্রথম আলোর সম্পাদককে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। প্রথম আলোর বাগমারা প্রতিনিধি মো. মামুনুর রশীদকে কথোপকথনের রেকর্ডসহ ২৩ ফেব্রুয়ারি আদালতে উপস্থিত হতে বলা হয়। এ ছাড়া শাহরিয়ার আলমের বিরুদ্ধে কী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা অবহিত করতে বাগমারা থানার ওসিকে আদালতে উপস্থিত হতে বলা হয়। এর ধারাবাহিকতায় আজ শুনানি হয়।

প্রথম আলোর সম্পাদকের পক্ষে প্রতিবেদনের সত্যতা বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেন আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার। তথ্য সংগ্রহ, প্রতিবেদন তৈরি এবং পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে প্রথম আলোর বাগমারা প্রতিনিধি মামুনুর রশীদের জবানবন্দি গ্রহণ করেন আদালত। ওই ঘটনায় নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে ওসির প্রতিবেদন দাখিল করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ওয়ায়েস-আল-হারুনী, সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মাহফুজা বেগম। শুনানির সময় শাহরিয়ার আলম আদালতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মো. জাহেদুল হক।

শুনানির একপর্যায়ে আদালত ওসির উদ্দেশে বলেন, কী পদক্ষেপ নিয়েছেন? তখন ওসি আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘সরেজমিনে ঘটনাস্থলে যাই। তালগাছ থেকে বের হওয়া তরল রাসায়নিক পদার্থ বোতলে সংগ্রহ করা হয়েছে। গাছ মারার চেষ্টার ঘটনায় উপজেলা প্রকৌশলী সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডি বিষয়ে তদন্তের জন্য আমলি আদালতে অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা নির্ধারণ করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শন করেছেন, কয়েকজনের বক্তব্যও নিয়েছেন। প্রাথমিক তদন্তে এটিই পরিলক্ষিত হয় যে  আমগাছগুলো বাঁচানোর জন্যই তালগাছ বিনষ্ট করার জন্য তিনি এবং তাঁর লোক দিয়ে এটি করিয়েছেন।

আদালত বলেন, কে করিয়েছেন? তখন ওসি আমিনুল ইসলাম বলেন, শাহরিয়ার আলম করেছেন। ৩০ মার্চ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন রয়েছে। নির্ধারিত সময়ে তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল করবেন তদন্ত কর্মকর্তা। আদালত বলেন, আমলি আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছেন? তখন ওসি বলেন, ধার্য তারিখের আগেই দাখিল করা হবে। রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য অনুমতি নেওয়া হয়েছে। প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। পরে ৪ এপ্রিল পরবর্তী দিন নির্ধারণ করে আদেশ দেওয়া হয়।

এ সময় ওসির উদ্দেশে আদালত বলেন, আমলি আদালতে ৩০ মার্চ প্রতিবেদন দাখিল করে যত দ্রুত সম্ভব তার কপি হাইকোর্টে দাখিল করার জন্য ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে পৌঁছে দেবেন। শাহরিয়ার আলমকে ৪ এপ্রিল আদালতে হাজির হতে হবে। প্রথম আলোর বাগমারা প্রতিনিধিকে আর আসতে হবে না।