খন্দকার আবদুল্লাহ আল মামুন
খন্দকার আবদুল্লাহ আল মামুন

সাক্ষাৎকা র

এআই প্রযুক্তি গার্মেন্টসের চেয়ে বড় রপ্তানি খাত হতে পারে

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিয়ে কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন ঢাকার ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) অধ্যাপক খন্দকার আবদুল্লাহ আল মামুন। গবেষণার জন্যই ইউআইইউতে প্রতিষ্ঠা করেছেন অ্যাডভান্সড ইন্টেলিজেন্স মাল্টিডিসিপ্লিনারি সিস্টেমস ল্যাব (এইমস ল্যাব) এবং ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ, ইনোভেশন, ইনকিউবেশন অ্যান্ড কমার্শিয়ালাইজেশন (আইআরআইআইসি)। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. সাইফুল্লাহ

প্রশ্ন

ইউআইইউতে এআই-সংক্রান্ত নানা গবেষণার কাজ আপনারা করছেন বলে শুনেছি। একটু বিস্তারিত বলবেন?

খন্দকার আবদুল্লাহ আল মামুন: ইউআইইউর রিসার্চ, ইনোভেশন সেন্টারে আমরা এআইয়ের মাধ্যমে শিক্ষা খাতের নানা সমস্যা সমাধানে কাজ করছি। যেমন গণিত, ইংরেজি বা কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের ভয় কীভাবে দূর করা যায়। আরও একটা বড় প্রকল্পে গবেষণা চলছে। আমাদের দেশে নবম শ্রেণির পর শিক্ষার্থীরা কেউ বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে, কেউ ব্যবসায়, কেউ মানবিকে। উচ্চমাধ্যমিকের পরও বিশ্ববিদ্যালয়ে একেকজন একেক বিষয় বেছে নেয়। কিন্তু এই বিষয় বাছাই হয় অনেকটা অন্ধকারে থেকে। শিক্ষার্থীরা জানে না কোন বিষয়টা তার জন্য, কী তার ভালো লাগে। অনেকটা পরিবারের চাপে কিংবা আশপাশের দেখাদেখি সে সিদ্ধান্ত নেয়। একই কথা পাস করে বেরোনোর পরও। কর্মক্ষেত্রে ঢোকার আগেও আমরা জানি না, কোন কাজে আমার সম্ভাবনা আছে। আমাদের পুরো ব্যবস্থাই এমন, কেউ কোনো পড়ালেখা বা কাজ পছন্দ না করলেও আমরা তাকে জোর করে সেটা করানোর চেষ্টা করি। ফলে ছেলেমেয়েরা হতাশায় পড়ে যায়। নিজের সেরাটা দিতে পারে না। এ কারণেই প্রচুর ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়েও বেকার থাকে। এই সমস্যাগুলোর সমাধান কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে হতে পারে, সেটা নিয়েই আমরা অনেক বছর ধরে কাজ করছি।

প্রশ্ন

ইউআইইউর একজন দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীর হয়তো এআই-সংক্রান্ত কোনো একটা ‘আইডিয়া’ আছে, যেটা নিয়ে সে কাজ করতে চায়। গবেষণা করতে চায়। সে কি আপনাদের রিসার্চ সেন্টারের সাহায্য নিতে পারে?

খন্দকার আবদুল্লাহ আল মামুন: শুধু ইউআইইউ কেন, যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই পারে। কারও যদি কোনো আইডিয়া থাকে, সেই আইডিয়া যদি সম্ভাবনাময় হয়, তাহলে তাকে আর্থিক থেকে শুরু করে কারিগরি—সব রকম সহায়তাই আমরা দেব। দুই মাস আগে প্রথম ব্যাচের কার্যক্রম চালু হলো। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪৫টি দল বিভিন্ন গবেষণার কাজ শুরু করেছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। আমাদের স্বপ্ন, আমরা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ থাকব না। সারা দেশ থেকে হ্যাকাথনের মাধ্যমে যদি এআই-সংক্রান্ত ১০০টি আইডিয়া আমাদের এখানে নিয়ে আসতে পারি, তার মধ্যে ১০টাও যদি সফল হয়, সেটা দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে।

প্রশ্ন

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির সুযোগ চালু হলে কি আপনাদের কার্যক্রম আরও গতি পাবে বলে মনে করেন?

খন্দকার আবদুল্লাহ আল মামুন: নিশ্চয়ই। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে আজ থেকে কয়েক বছর আগেই অনেকগুলো প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সেসব প্রস্তাবে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে পাবলিক-প্রাইভেট ভেদাভেদ ভুলে আমরা কীভাবে মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষায় জোর দিতে পারি। যদি ভেদাভেদ ভুলে গবেষণা, উদ্ভাবনকে গুরুত্ব দিই; তাহলে উচ্চশিক্ষার মান বাড়বে। একটা পর্যায়ে আমরা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে পারব। আমার প্রস্তাবেই উল্লেখ ছিল, একটা নির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসরণ করতে পারলে সরকারি-বেসরকারি যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়েরই পিএইচডি অফার করার সুযোগ থাকা উচিত। নির্ধারিত সংখ্যক পূর্ণকালীন অধ্যাপক থাকতে হবে, সেই অধ্যাপকদের গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটা ভালো অবস্থান থাকতে হবে, প্রতিবছর এমন কিছু মানদণ্ড ধরে রাখতে পারলেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিএইচডি অফার করতে পারবে—এমন নিয়ম যদি করা যায়, তাহলে সামগ্রিকভাবেই দেশের গবেষণার উন্নতি হবে।

প্রশ্ন

এআই যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসছে, আপনার কী মনে হয়, শুধু কি কম্পিউটারবিজ্ঞান বা প্রকৌশলের শিক্ষার্থীরাই এতে ভূমিকা রাখতে পারবে? নাকি অন্যান্য বিষয়ের ছাত্রছাত্রীরাও কাজ করতে পারে?

খন্দকার আবদুল্লাহ আল মামুন: আমাদের দেশের একটা সমস্যা হলো আমরা এত স্নাতক তৈরি করছি, কিন্তু তাদের সমস্যা সমাধানের দক্ষতা খুব দুর্বল। যদি বিশ্লেষণের দক্ষতা থাকে, সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা থাকে, তাহলে যে কেউ-ই কিন্তু এআই থেকে উপকৃত হতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ দুইভাবে এআইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এক. যাঁরা এআই ব্যবহার করে। দুই. যারা ব্যবহার করে এবং তৈরি করে। আমাদের দেশের মানুষ কিন্তু প্রথম দলে। কিন্তু যদি সত্যিই দেশের অবস্থার পরিবর্তন করতে চাই, তাহলে ব্যবহারকারী এবং নির্মাতা—দুটিই হতে হবে। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, গার্মেন্টস যেমন আমাদের দেশের একটা বড় রপ্তানি খাত, এআই প্রযুক্তি এর চেয়ে বড় রপ্তানি খাত হতে পারে। সেই মেধা, সেই সক্ষমতা আমাদের ছেলেমেয়েদের আছে। কিন্তু সে জন্য তাদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষা, যুব ও ক্রীড়া এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়—এই তিন মন্ত্রণালয়কে এ ক্ষেত্রে এক হয়ে কাজ করতে হবে। তাহলেই আমরা চীন বা ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে প্রযুক্তিবিশ্বে একটা ভালো অবস্থান তৈরি করতে পারব।