অসুস্থ প্রাণী–পাখিকে সুস্থ করতে চট্টগ্রামের মেয়ে সুমি বিশ্বাস গড়ে তুলেছেন ‘অ্যানিমেল কেয়ার অব চট্টগ্রাম’ নামে একটি সংগঠন।

সালটা ২০১৪। তখন কলেজে পড়তেন সুমি বিশ্বাস। সে বছরের জানুয়ারির এক দুপুরে করুণ এক দৃশ্যের মুখোমুখি হলেন। এলাকার একটি কুকুরের গায়ে গরম পানি ঢেলে দিয়েছেন এক দোকানি। কষ্টে ছটফট করছিল কুকুরটি। মায়া লেগে যায় সুমির। কোনোমতে ঠান্ডা পানি ঢেলে প্রাথমিক শুশ্রূষা করেন। ঘরের সামনে একটি স্থানে রেখে এক সপ্তাহ টানা সেবা দিয়ে সেই পথের কুকুরটি সুস্থ করে তারপর ছেড়ে দেন।
ঘটনাটি সুমিকে নতুন করে ভাবায়। ঝুঁকে পড়েন প্রাণী-পাখির পরিচর্যায়। কাজ করতে গিয়ে দেখলেন একা কাজ করা কঠিন। এক বছর পর অর্থাৎ ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘অ্যানিমেল কেয়ার অব চট্টগ্রাম’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন সুমি। আট বছর ধরে এ সংগঠনের মাধ্যমে আড়াই হাজার অসুস্থ প্রাণী-পাখিকে সুস্থ করে তোলা হয়েছে।
এর মধ্যে ১ হাজার ৯১৩টি কুকুর, ৪৫২টি বিড়াল। বাকি প্রাণীর মধ্যে আছে ঘোড়া, কাক, চড়ুই, প্যাঁচা, সাপ, ইগল, টিয়া ও শিয়াল। উদ্ধারকাজের জন্য কোনো প্রশিক্ষণ অবশ্য নেননি তাঁরা। যা শিখেছেন, কাজ করতে গিয়েই আর ইউটিউবের ভিডিও দেখে। এখন তাঁদের সঙ্গে যুক্ত আছেন একজন প্রাণিচিকিৎসকও।
‘ভবিষ্যতে সংগঠনের কার্যক্রম আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। প্রাণপ্রকৃতি রক্ষায় কাজ করে যাব। এর মধ্যে বিপন্নপ্রায় প্রাণীর জীবন রক্ষায় কাজ করার ইচ্ছা আছে। কারণ, কোনো প্রাণীকে বাদ দিয়ে প্রকৃতি টিকে থাকবে না।’সুমি বিশ্বাস
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেছেন সুমি। মা–বাবার সঙ্গে থাকেন চট্টগ্রাম নগরের হালিশহর আনন্দবাজার এলাকায়। সুমি জানালেন, ছোটবেলা থেকেই প্রাণীদের প্রতি টান ছিল তাঁর। তাঁদের বাসায় একটি কুকুর ছিল। বর্তমানে তাঁর কাছে ৪টি কুকুর ও ১৩টি বিড়াল রয়েছে। এসব কুকুর ও বিড়াল তাঁর বাসায় নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। তিনি খাবার-পানি দিয়ে এদের পরিচর্যা করেন।
সম্প্রতি সুমির বাসায় গিয়ে দেখা যায়, কুকুর ও বিড়ালের জন্য রয়েছে একটা খাঁচার ঘর। এ ঘরের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অ্যানিমেল শেল্টার’। ওই ঘরে শুয়ে ছিল দুটি কুকুর। অসুস্থ এসব কুকুরকে সুমি নিয়ে এসেছিলেন রাস্তা থেকে। জ্বরসহ নানা সমস্যায় ভুগছিল কুকুর দুটি। সুমি বলেন, রাস্তায় বের হলেই বিভিন্ন রোগে ভোগা কুকুর, বিড়াল চোখে পড়ে। কোনোটির পা ভেঙে গেছে, কোনোটি চামড়া উঠে গেছে শরীর থেকে। এসব কুকুরকে নিয়ে এসে চিকিৎসা দেন তাঁরা। মূলত কাজ করেন চট্টগ্রাম অঞ্চলে।
প্রাণীদের উদ্ধার করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় বিপদেও পড়তে হয়েছে সুমিকে। এমনই এক ঘটনা ঘটে ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর। চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদ এলাকা থেকে ফোন আসে সুমির কাছে। পরিচিত এক ব্যক্তি ফোন করে জানান, একটা কুকুরের ঘাড়ে ঘা হয়ে পচন ধরেছে। শরীর থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এ জন্য এলাকাবাসী কুকুরটিকে মেরে ফেলতে চাইছে। কয়েকজন কুকুরটিকে লাঠিপেটাও করেছে। খবর পেয়েই ওই এলাকায় ছোটে সুমি ও তাঁর দল।
তাঁরা গিয়ে দেখেন, কুকুরটি বেশ ভীত। নড়াচড়া করছিল না। সুমি তখন কুকুরটিকে ধরতে যান। মুহূর্তেই কুকুরটি কামড় বসিয়ে দেয় তাঁর হাতে। পরে তাঁকে পাঁচ দিন নগরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়। পাশাপাশি দুটি সার্জারিও করতে হয়। তারপরও কুকুরটি উদ্ধার করে নিয়ে আসেন তাঁরা। সুস্থও করেন। এসব বিপদ সুমিকে থামাতে পারেনি। সুস্থ হয়ে তিনি আবার প্রাণীদের জীবন বাঁচাতে কাজ শুরু করেন।
আরেকটি ঘটনা ২০২১ সালের মার্চ মাসের। নগরের আমবাগান এলাকার রাস্তার পাশেই পড়ে ছিল একটি ঘোড়া। পিকআপ ভ্যানের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ঘোড়াটির পা ভেঙে যায়। পরে খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান সুমি। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঘোড়াটিকে নিয়ে আসেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী হাসপাতালে। সেখান থেকে ঘোড়াটিকে নিয়ে আসা হয় সুমির বাসার অ্যানিমেল শেল্টারে। ২০২২ সালের ১২ এপ্রিল ঘোড়াটির মৃত্যু হয়।
এ রকম আরও নানা ঘটনার স্মৃতি জমা আছে সুমির কাছে। এমনই আরেক ঘটনা ঘটে ২০২১ সালের এপ্রিলে। নগরের আনন্দবাজার এলাকার প্রতিবেশীর বাসার জানালা দিয়ে একদিন একটা আহত প্যাঁচা ঢুকে যায়। পরে ওই প্রতিবেশী ফোন করেন সুমিকে। তাঁরা গিয়ে প্যাঁচাটি নিয়ে আসেন। পাঁচ দিন শুশ্রূষার পর প্যাঁচাটি সুস্থ হয়। এরপর এটিকে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় দিয়ে আসেন সুমি।
করোনাকালে সুমিদের ব্যস্ততা কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল। সুমি জানালেন, ২০২০ ও ২০২১ সালের করোনার থাবায় সবকিছু বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। দোকানপাট ছিল বন্ধ। ঘরে ঘরে ঝুলছিল তালা। কারণ, সবাই ছিল ঘরবন্দী। এমন দুঃসময়ে কুকুর ও বিড়ালের জীবনেও অন্ধকার নেমে এসেছিল। খাবার পাচ্ছিল না অবলা প্রাণীগুলো। এ কারণেই মূলত ব্যস্ততা বেড়ে যায়।
সুমি বলেন, বিভিন্ন এলাকার কুকুর ও বিড়ালের জন্য প্রথমে নিজের বাসায় খাবার রান্না করা শুরু করেন তিনি। পরে সংগঠনের সদস্যরা বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে রান্নার দায়িত্ব নেন। এলাকা ধরে সপ্তাহে দুবার খাবার দেওয়া হতো। পরে তাঁদের সঙ্গে অনেকেই যুক্ত হন। এভাবে দুই থেকে তিন, চার করে বাড়তে থাকে। এভাবে সবকিছু স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত খাবার বিতরণ কর্মসূচি চালানো হয়।
শুরুতে একাই কাজ করতেন সুমি। তবে এসব কাজের বিবরণ ফেসবুকে তুলে ধরতেন। দিতেন ছবিও। একদিন এক প্রাণিপ্রেমী ফেসবুকে মুখ থেঁতলে যাওয়া বিড়ালের সেবার কার্যক্রম দেখে তাঁকে খুদে বার্তা পাঠান। একসঙ্গে কাজ করার অনুরোধ করেন। পরে এভাবে পরিচিতি হয় অনেকের সঙ্গে। ধাপে ধাপে বাড়ে সংগঠনের সদস্য। এখন এই সদস্যদের নিজেদের টাকাতেই প্রাণী-পাখির সেবা দেওয়া হয়। প্রতিটি সদস্য মাসে ২০০ টাকা করে চাঁদা দেন। এই টাকা থেকে অ্যানিমেল কেয়ার অব চট্টগ্রাম পরিচালিত হয়। এ নামে রয়েছে তাঁদের ফেসবুক পেজও।
বর্তমানে ২৩ সদস্যের মধ্যে ১৫ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ৩ জন কলেজ শিক্ষার্থী। আর বাকিরা চাকরিজীবী। প্রাণিচিকিৎসক মো. মহিউদ্দিন আকরাম এখন সুমির সহযোগী। তিনি কর্মরত আছেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হিসেবে। নিজের কাজের ফাঁকে সময় দেন। মহিউদ্দিন আকরাম বলেন, অসুস্থ প্রাণীকে উদ্ধার করে সুস্থ করে তোলাই তাঁদের প্রধান লক্ষ্য।
সুমি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভবিষ্যতে সংগঠনের কার্যক্রম আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। প্রাণপ্রকৃতি রক্ষায় কাজ করে যাব। এর মধ্যে বিপন্নপ্রায় প্রাণীর জীবন রক্ষায় কাজ করার ইচ্ছা আছে। কারণ, কোনো প্রাণীকে বাদ দিয়ে প্রকৃতি টিকে থাকবে না।’
প্রায় সময় সুমিদের পাশে থাকে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএ কাদেরী টিচিং ভেটেরিনারি হাসপাতাল। সেখানকার পরিচালক মো. রায়হান ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, আহত প্রাণী নিয়ে সুমি ও তাঁর দল প্রায় সময় হাসপাতালে আসেন। তাঁদের বিনা মূল্যে ওষুধ দেওয়া হয়। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এ ধরনের সংগঠন প্রাণীদের নিয়ে কাজ করে। এমন আরও সংগঠন গড়ে ওঠা দরকার।