
গ্রাহকসেবা আরও সমৃদ্ধ করতে, নিজেদের কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে ও ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহারে জোর দিচ্ছে গ্রামীণফোন। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটি ‘এআই অ্যান্ড আই’ নামের নতুন একটি কর্মসূচি চালু করেছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছিলেন গ্রামীণফোনের মূল কোম্পানি টেলিনর গ্রুপের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হেড অব এআই ইয়েভা মার্টিনকেনাইট। ১৭ আগস্ট তিনি ও গ্রামীণফোনের চিফ ইনফরমেশন অফিসার নিরঞ্জন শ্রীনিবাসন প্রথম আলোসহ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। এই আলাপে এআই নিয়ে অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের পটভূমি, দায়িত্বশীল এআই, ভবিষ্যতের কার্যক্রমসহ নানা বিষয় উঠে আসে। তাঁদের কথোপকথনের মূল বিষয় তুলে ধরা হলো—
টেলিনর গ্রুপ ১৫ বছর আগেই নিজেদের এআই–যাত্রা শুরু করে। এ জন্য অসলোয় একটি গবেষক দল গঠন করা হয়েছিল। মূল উদ্দেশ্য ছিল এআইয়ের প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা। টেলিনর গ্রুপের পুরো কাঠামোয় তা ব্যবহার করা।
টেলিনর বৈশ্বিক পর্যায়ে বড় ক্লাউড প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। ছোট প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও টেলিনরের অংশীদারত্ব রয়েছে। বর্তমানে নরওয়েসহ পুরো নর্ডিক অঞ্চলে টেলিনরের আলোচিত বিষয় এআই-যাত্রাকে দ্রুততর করা, নতুন ব্যবহারিক ক্ষেত্র বাড়ানো।
টেলিনর গ্রুপ ১৫ বছর আগেই নিজেদের এআই যাত্রা শুরু করে। এ জন্য অসলোয় একটি গবেষক দল গঠন করা হয়েছিল। মূল উদ্দেশ্য ছিল এআইয়ের প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা। টেলিনর গ্রুপের পুরো কাঠামোয় তা ব্যবহার করা।
এআই নিয়ে মূলত তিনটি ক্ষেত্র ধরে কাজ করছে টেলিনর। প্রথমত, গ্রাহকসেবা উন্নত করা। যেমন কল সেন্টার অটোমেশন, অফারগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক করা, প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রাহক ধরে রাখা, নতুন গ্রাহক তৈরি করা।
দ্বিতীয়ত, কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানো। এআই ব্যবহারের পরিসর বাড়াতে দক্ষ কর্মী দরকার। দক্ষ কর্মী গড়তে টেলিনর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাড়াচ্ছে। এ জন্য টেলিনরে একটি ‘এআই ফ্লুয়েন্সি প্রোগ্রাম’ রয়েছে।
তৃতীয়ত, টেলিনরের এআই ব্যবহারের অন্যতম জায়গা হচ্ছে নেটওয়ার্ক। এই কার্যক্রমকে স্বয়ংক্রিয় করতে, বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে এআই ব্যবহার করা হচ্ছে। এর বাইরে ত্রুটি শনাক্ত করা ও সাইবার হামলা প্রতিরোধ করাও টেলিনরের অগ্রাধিকার।
ইয়েভা মার্টিনকেনাইট ও নিরঞ্জন শ্রীনিবাসন জানান, বিশ্বে এখন রেসপন্সিবল এআই বা দায়িত্বশীল এআই নিয়ে কথা হচ্ছে। এর অর্থ হলো, এআই দিয়ে যা-ই করা হোক না কেন, তা স্বচ্ছ, যাচাইযোগ্য ও ন্যায়সংগত হতে হবে। যদি ব্যাকএন্ড এলএলএম (লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল) নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তাহলে যে প্রভাব তৈরি হবে, তা সমাজের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর হতে পারে। এআইয়ের ব্যবহার যেন বেপরোয়া না হয়। টেলিনর সময় নিয়েছে যাতে প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক ও কার্যক্রম অপব্যবহার বা দুর্নীতির শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করতে। দায়িত্বশীল এআই টেলিনরের সব এআই উদ্যোগের মূল ভিত্তি।
বাংলাদেশে এখনো এআই নিয়ে কোনো নীতিমালা হয়নি। সে ক্ষেত্রে গ্রামীণফোনের এআইভিত্তিক কার্যক্রম প্রসঙ্গে এই দুই টেলিকম কর্মকর্তা বলেন, নৈতিকতা, গোপনীয়তা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতে টেলিনর গ্রুপের দিকনির্দেশনা মেনে চলছে গ্রামীণফোন। টেলিনর গ্রুপের দায়িত্বশীল এআই কাঠামো মেনে গ্রামীণফোন এআই ব্যবহার করছে। তবে এটা স্থানীয় বাজার পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল।
ইউরোপে এআই-সম্পর্কিত নিয়মনীতি কার্যকর হচ্ছে। তাই নর্ডিক দেশগুলোয় টেলিনরকে সে অনুযায়ী বিধান নিশ্চিত করতে হবে। নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি সাংস্কৃতিক। কর্মীদের সেভাবেই গড়ে তুলতে হবে। উদ্ভাবন ও অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে টেলিনর দায়িত্বশীলভাবে কাজ করছে বলে জানান তাঁরা।
টেলিনর বৈশ্বিক পর্যায়ে বড় ক্লাউড প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। ছোট প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও টেলিনরের অংশীদারত্ব রয়েছে। বর্তমানে নরওয়েসহ পুরো নর্ডিক অঞ্চলে টেলিনরের আলোচিত বিষয় এআই-যাত্রাকে দ্রুততর করা, নতুন ব্যবহারিক ক্ষেত্র বাড়ানো।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এআই কার্যক্রম সম্পর্কে এই দুই টেলিকম কর্মকর্তা জানান, গ্রাহকসেবা ও নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনায় এআই ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে গ্রামীণফোন। বাংলাদেশে অন্যতম বড় বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন। তারা বিদ্যুতের যথাযথ ব্যবহারে এআই ব্যবহার করছে। গ্রামীণফোন এআই কার্যক্রমে সময় নিয়ে, বুঝে-শুনে এগোতে চায়। কারণ, কোনো ভুল যেন না হয়। গ্রামীণফোনের অ্যাপ মাইজিপিতে গ্রাহকের ব্যবহারের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এআই দিয়ে বিভিন্ন প্ল্যান ও অফার সাজানো হয়েছে।
টেলিনর গত বছর নরওয়েতে ‘এআই ফ্যাক্টরি’ চালু করে। গ্রাহক ও অংশীদারদের আরও নিরাপদ, ভালো ক্লাউড ও ডেটা সেন্টারভিত্তিক সমাধান দিতে এটা তৈরি করা হয়েছে। এনভিডিয়া ও সিসকোর সঙ্গে অংশীদারত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশেও গ্রামীণফোন একই ধরনের এআই ফ্যাক্টরি তৈরি করছে। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ কাজে এআই ফ্যাক্টরি ব্যবহার করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এর আওতা বাড়ানো হবে। এ বিষয়ে গ্রামীণফোন ভবিষ্যতে বিস্তারিত জানাবে।
কর্মসংস্থানের ওপর এআইয়ের প্রভাব সম্পর্কে তাঁরা বলেন, এআইকে কখনোই একজন কর্মীর বিকল্প হিসেবে দেখা উচিত নয়; বরং এটা কর্মীর দক্ষতা বাড়াতে সহায়তা করে। টেলিনর বা গ্রামীণফোন সেবা খাতের সঙ্গে যুক্ত। এ খাতে পুরোপুরিভাবে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করা যায় না। কিছু ক্ষেত্রে মানুষের সরাসরি সংযোগ ও মানুষের অনুভূতির প্রয়োজন রয়েছে, যাতে গ্রাহকের সঙ্গে সাবলীল সম্পর্ক তৈরি হয়। এআইকে মানবিক করে তুলতে মানুষের প্রয়োজন। মানুষকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া যাবে না। নেটওয়ার্ক নিজে নিজে চলবে না। তবে কিছু ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় হতে পারে।
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নানা ডিপ ফেক ভিডিও তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়ে ইয়েভা মার্টিনকেনাইট ও নিরঞ্জন শ্রীনিবাসন বলেন, এটা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, পুরো বিশ্বেরই সমস্যা। এটা মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে আলোচনা করতে হবে। পাশাপাশি মানুষের মধ্যে ভুয়া আধেয় শনাক্ত করতে পারার দক্ষতা ও সচেতনতা নিশ্চিত করা জরুরি। গণমাধ্যমের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারকেও তাদের কার্যক্রমে দায়িত্বশীল এআই ফ্রেমওয়ার্ক প্রয়োগ করতে হবে। টেলিনরের এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এ অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে পারে।
ফিনল্যান্ডের উদাহরণ টেনে ইয়েভা মার্টিনকেনাইট জানান, দেশটি শিক্ষায় বিনিয়োগে কৌতূহল ও সৃজনশীলতার ওপর বেশি জোর দিচ্ছে। শিশুদের শেখাচ্ছে, কীভাবে তথ্যের উৎস শনাক্ত করতে হয়। তথ্যের উৎস বোঝা জরুরি। নতুন প্রজন্মকে তাদের বয়স বিবেচনায় ‘এআই নাগরিক’ হিসেবে গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি শক্তিশালী এআই সংস্কৃতি তৈরি করা দরকার। এ জন্য স্কুলপর্যায় থেকেই শিক্ষাদান করতে হবে।
সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা প্রসঙ্গে ইয়েভা মার্টিনকেনাইট বলেন, নরওয়েতে সংবাদমাধ্যমগুলো নিজস্ব স্বাধীন নৈতিক বোর্ড স্থাপন করেছে, যাতে তাদের কার্যক্রম ও প্রকাশিত আধেয় নিয়ে স্বাধীনভাবে পর্যালোচনা করা যায়। তথ্যের উৎসের নির্ভরযোগ্যতাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
টেলিনর ও গ্রামীণফোনের এই দুই কর্মকর্তা বলেন, এআই উদ্ভাবনকে সীমাবদ্ধ করছে না, বরং উদ্ভাবনকে সহজ করছে। যদি এআইকে কর্মীদের হাতে দেওয়া হয়, তাহলে তাঁরা নতুন উদ্ভাবনে সক্ষম হবেন। কর্মীদের সৃজনশীলতাও বাড়িয়ে দেবে। এখানে ৬৫ শতাংশ মানুষ ৩৫ বছরের কম বয়সী। এআই ব্যবহার করে তাঁদের জীবন উন্নত করার সুযোগ রয়েছে।