
১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবস। ১৯৮৭ সালের এই দিনে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তিনি। শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের এই লেখাটি ২০০৫ সালের ১৯ মার্চ প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছিল। শহীদ নূর হোসেন স্মরণে লেখাটি আজ পাঠকদের জন্য আবার প্রকাশ করা হলো।
গত ৫ মার্চ, শনিবার গভীর রাতে, শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ রোগযন্ত্রণা আর বুকের মধ্যে গভীর বেদনা নিয়ে নির্বাক মজিবুর রহমানের মৃত্যু হলো। ১৯৮৭ সালের গণআন্দোলনের শহীদ নূর হোসেনের পিতা হলেন মজিবুর রহমান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
বিগত বছরে ১ আগস্ট (২০০৪ সালে) মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন। একাধিক হাসপাতালে চিকিত্সার পর গত ৩ নভেম্বর মিরপুরের বাসায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
আমরা গত বছরের ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেনকে স্মরণ করে তাঁর গুরুতর অসুস্থতার খবর ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে প্রথম আলোতে একটি নাতিদীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলাম। তারপর তাঁর মৃত্যুবরণের সংবাদ ছাপলাম ৭ মার্চ। আমরা জানতাম, তাঁর জীবন আর দীর্ঘ হবে না। তাঁর মৃত্যু প্রায় আসন্ন। তারপরও মজিবুর রহমানের মৃত্যুসংবাদ আমাদের গভীরভাবে ব্যথিত করেছে।
বৃদ্ধ মজিবুর রহমানের মৃত্যুর সংবাদ কোনো গুরুত্ব পায়নি টেলিভিশন বা দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে। অথচ একসময় সেই গত শতাব্দীর আশির দশকে শহীদ নূর হোসেন আর তার পিতাকে নিয়ে কত না হৈচৈ আর মাতামাতি হয়েছিল। কত উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়েছে সভা-সমাবেশে।
১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বরে আত্মদানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন ২৪ বছরের যুবক নূর হোসেন। দেশের প্রায় সব সংবাদপত্রে তার ছবি ছাপা হলো। সারা দুনিয়ার সংবাদ হলেন নূর হোসেন। নূর হোসেনকে নিয়ে কবিতাও লেখা হলো অনেক। গল্প আর নাটক হলো। পোস্টারের বিষয় হয়ে উঠলেন নূর হোসেন। আশির দশকে বাংলাদেশের মানুষের জন্য নূর হোসেন নতুন এক সাহস, এক প্রেরণা হয়ে উঠেছিল।
১০ নভেম্বর নূর হোসেনের আত্মদানের মধ্য দিয়ে তার পরিবারও সংবাদ হয়ে উঠেছিল। দৈনিক, সাপ্তাহিক আর মাসিক পত্রিকায় তাদের নিয়ে অসংখ্য খবর বের হলো। নূর হোসেনের পিতা মজিবুর রহমানের অনেক সাক্ষাত্কার নেওয়া হলো। ছোট-বড় নানা রকম সভা-সমাবেশ, আলোচনা, এমনকি শহীদ মিনারে বুদ্ধিজীবীদের মস্ত বড় অনুষ্ঠানে তাঁকে প্রধান অতিথি করা হলো। প্রচুর সম্মান দেওয়া হলো তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে। মজিবুর রহমান যারপরনাই খুশি ছিলেন সে দিনগুলোতে। নূর হোসেনের পিতা বৃদ্ধ মজিবুর রহমান গর্বিত হৃদয়ে পুত্রশোকের সান্ত্বনা খুঁজলেন।
কোনো কোনো পত্রিকায় খবর বের হয়েছিল, জুরাইনের গোরস্থানে তার কবর হয়েছে। এ খবর শুনে নূর হোসেনের পিতা মজিবুর রহমান ১৩ নভেম্বর দৌড়ে গিয়েছিলেন সে জায়গায়। জুরাইনের কবরখোদকরা তাকে জানায়, ১২ নভেম্বর শেষরাতে, সময় রাত ৩টা হবে, আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের গাড়িতে করে তিনটি লাশ আনা হয়েছিল। পুলিশ ছিল সঙ্গে।
সে সময় জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং তাদের সহযোগীরা নূর হোসেনের পিতা মজিবুর রহমানের বনগ্রামের এক ঘরের গেরস্থালিতে গেলেন। শুধু যাননি জাতীয় পার্টি আর জামায়াতে ইসলামীর কেউ। সে ঘরে নেতাদের বসতে দেওয়ার মতো জায়গা ছিল না। তবু এমন সব ব্যক্তির আগমনে শহীদের পিতা-মাতা উচ্ছ্বাসে তাদের জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তিনি তাদের বারবার বলেছেন, আমরা কিছু চাই না। আমাদের ছেলেকে আর কোনো দিন ফিরে পাব না। ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ এবং ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ আমার ছেলের এ স্লোগান যদি পূরণ হয়, তাহলেই আমরা খুশি।
আমরা সবাই মিলে শহীদ নূর হোসেনের পিতা-মাতা এবং পরিবারের সবাইকে অনেক আশ্বাস দিয়েছিলাম। আমরা বলেছিলাম, আমরা আছি, আমরা আপনাদের পাশে থাকব। আমরা স্বৈরাচারের পতন ঘটাব, গণতন্ত্রকে মুক্ত করব। আমাদের সে আশ্বাস, সে সাহসে শহীদ পরিবার আশ্বস্ত হয়েছিল সেদিন।
শহীদ নূর হোসেনের পিতা মজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার পরিচয়ের ঘটনাটি ছিল অত্যন্ত আকস্মিক এবং বড় বেদনাদায়ক। ২৮ নভেম্বর (’৮৭ সাল) ওয়ারী থেকে বেবিট্যাক্সিতে মণিপুরিপাড়ায় শিল্পী কামরুল হাসানের বাসা হয়ে বংশালে সাপ্তাহিক একতা অফিসের দিকে চলেছি। বেবিট্যাক্সি ইন্দিরা রোড হয়ে ফার্মগেট পার হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এ সময়ই ট্যাক্সিচালক চকিতে পেছনে ফিরে বললেন, আমি আপনাকে চিনি। আপনি পত্রিকার লোক। আর আমি শহীদ নূর হোসেনের বাবা। আমি চমকে উঠলাম। বেবিট্যাক্সিচালক মজিবুর রহমানের পরিচয় পেয়ে আমি সেদিন লজ্জায় কুণ্ঠিত হয়ে বেবিট্যাক্সির আসনে স্থির বসে আছি। বেবিট্যাক্সিচালক মজিবুর রহমান তাঁর সন্তান নূর হোসেনের কথা বলছেন। তিনি একটি ফটো চাইলেন নূর হোসেনের, তিনি সেটাকে বাঁধিয়ে রাখতে চান। গন্তব্যস্থল বংশালে নেমে লজ্জিত বিমূঢ়তা কাটিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানালাম। আর ভাবছিলাম, আমরা শহীদদের কথা বলি, তাদের নামে শপথ নিই, কিন্তু তাঁদের সম্পর্কে, তাঁদের পরিবার সম্পর্কে কতটুকু জানি?
শহীদ নূর হোসেনের পিতা মজিবুর রহমানের সঙ্গে সেই আকস্মিক পরিচয়ের পর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছে। দিনের পর দিন, সকাল-বিকেল নানা সময়ে তিনি আমাদের ওয়ারীর বাসায় এসেছেন। বংশালের সাপ্তাহিক একতা অফিসে গেছেন। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে দৈনিক ভোরের কাগজ-এর অফিসে এসে গল্প করে গেছেন।
সাতাশির ১০ নভেম্বরে বাংলাদেশ সচিবালয়ের সামনের রাস্তায় পুলিশের গুলিতে নিহত সাহসী যুবক শহীদ নূর হোসেনের জনক মজিবুর রহমান। বয়স তখন তাঁর ৬০ বছর পূর্ণ হয়েছে। থাকতেন তখন বনগ্রামের একঘরের বাসাতে। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরেই তিনি ছিলেন সেই একই গৃহে। স্ত্রী ছাড়া চার পুত্র আর এক কন্যা নিয়ে তাঁর সংসার। যখন প্রথম সন্তান আলী হোসেন তখন মিনি ট্রাক ড্রাইভার। নূর হোসেনের পরের ভাই দেলোয়ার মিনিবাসের হেলপার। আনোয়ার লেদ মেশিনে কাজ শিখছে তখন। একমাত্র মেয়ে শাহানা স্কুলে পড়ছিল অষ্টম শ্রেণীতে।
শহীদ নূর হোসেনের পিতা মজিবুর রহমানের সঙ্গে সেই আকস্মিক পরিচয়ের পর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছে। দিনের পর দিন, সকাল-বিকেল নানা সময়ে তিনি আমাদের ওয়ারীর বাসায় এসেছেন। বংশালের সাপ্তাহিক একতা অফিসে গেছেন। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে দৈনিক ভোরের কাগজ-এর অফিসে এসে গল্প করে গেছেন। তখন তিনি আর বেবিট্যাক্সি চালাতে পারেন না। দীর্ঘ সময় ধরে নানা বিষয়ে কথাবার্তা হয়েছে আমাদের। তাঁর জীবনসংগ্রাম আর বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার কথা শুনে মানুষ আর জীবনকে নতুনভাবে দেখতে শিখেছি। অন্যদিকে মজিবুর রহমানের বাসায় গিয়েছি অনেক-কখনো প্রয়োজনে, কখনো অপ্রয়োজনে। এই যাওয়া-আসার মধ্যে নূর হোসেনের মা এবং ভাইবোনদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, দিন দিন আমরা ঘনিষ্ঠতর হয়েছি, তাদের দুঃখ-বেদনাকে কিছুটা হলেও ভাগ করে নিতে চেষ্টা করেছি। কত দিন মজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর ছেলেমেয়েদের বিষয়ে কত কথা হয়েছে, তাদের ভবিষ্যত্ ভেবে বড় চিন্তিত ছিলেন তিনি। মনে পড়ে, তার বড় ছেলে আলী হোসেনের একটি চাকরির ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম বেসরকারি এক ব্যাংকে। পরে অবশ্য আলী হোসেন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব গাড়ির চালক হিসেবে চাকরিরত হয়েছিলেন। এখনো সে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলে মিরপুরের মাজার রোডে ৫ কাঠা পরিমাণ একটি ডোবা জমি পেয়েছিল মজিবুর রহমানের পরিবার। সেখানে ধীরে ধীরে কোনো রকমে একটি বাসা করেছেন। এখন তারা শহীদ নূর হোসেনের ভাইবোন সবাই একসঙ্গে থাকেন। ভাই আর ভগ্নিপতিরা নানা পেশায় যুক্ত হয়েছেন। তাদের অবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এসব দেখে-জেনে ভালো লাগল।
মজিবুর রহমানের কুলখানিতে (মঙ্গলবার, ৮ মার্চ) উপস্থিত হয়ে শহীদ নূর হোসেনের মা ও ভাইবোনের সঙ্গে অনেক কথা হলো। মা অনেক কান্নাকাটি করে পুরনো অনেক কথা বললেন। সন্তানদের তাদের স্ত্রী ও স্বামী এবং তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পরিচয় হলো। তাদের কাছ থেকে মজিবুর রহমান সম্পর্কে আরো অনেক কিছু জানলাম। অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর থেকে বিছানায় শুয়ে শুয়ে টেলিভিশন দেখতেন। ওই টেলিভিশনের ঠিক ওপরে ঝোলানো রয়েছে শহীদ নূর হোসেনের মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তের স্লোগানরত ছবিটি, বুকে লেখা স্লোগান-‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ আর পিঠে লেখা ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’।
সাতাশির ১০ নভেম্বর বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ আর ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লিখে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে উচ্চকণ্ঠে স্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় নেমেছিলেন শহীদ নূর হোসেন। তারপর পুলিশের লক্ষ্যভেদী গুলিতে বনপাখির মতো লুটিয়ে পড়েছিলেন রাজপথে। শহীদ হলেন নূর হোসেন। নূর হোসেন গণআন্দোলনের এক উজ্জ্বল পতাকা হয়ে গেলেন।
কিন্তু নূর হোসেনের লাশের কোনো নির্দিষ্ট খবর কোথাও প্রকাশিত হয়নি। পরিষ্কার কিছু জানা যায়নি। কোনো কোনো পত্রিকায় খবর বের হয়েছিল, জুরাইনের গোরস্থানে তার কবর হয়েছে। এ খবর শুনে নূর হোসেনের পিতা মজিবুর রহমান ১৩ নভেম্বর দৌড়ে গিয়েছিলেন সে জায়গায়। জুরাইনের কবরখোদকরা তাকে জানায়, ১২ নভেম্বর শেষরাতে, সময় রাত ৩টা হবে, আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের গাড়িতে করে তিনটি লাশ আনা হয়েছিল। পুলিশ ছিল সঙ্গে।
কবরখোদকদের কথায় তাদের একজন ছিলেন প্যান্ট পরা, হাতে ঘড়ি। একজন লুঙ্গি পরা। আর একজনের মুখে দাড়ি। পায়ে কেডস জুতা। উদোম গতর। বুকে-পিঠে কী যেন লেখা ছিল।
অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর থেকে বিছানায় শুয়ে শুয়ে টেলিভিশন দেখতেন। ওই টেলিভিশনের ঠিক ওপরে ঝোলানো রয়েছে শহীদ নূর হোসেনের মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তের স্লোগানরত ছবিটি, বুকে লেখা স্লোগান-‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ আর পিঠে লেখা ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’।
মজিবুর রহমান বলেন, তিনজনের শেষজনই হবে আমার নূর হোসেন। আমি কবর খুঁড়তে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারিনি। তিনি আরো জানালেন, সাত দিন পর আবার গিয়েছিলাম এক বন্ধুকে নিয়ে। আবার কবর খুঁড়তে চেয়েছিলাম। কোনটি আমার ছেলে, আমার নূর হোসেনের কবর, সেটা জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কবর খুঁড়তে দেয়নি আমাকে। এক মাস পর, পরিবারের সবাইকে নিয়ে মজিবুর রহমান আবার গিয়েছিলেন জুরাইনের গোরস্থানে। সেদিন সবাই কান্নাকাটি করেছিলেন অনেক। আবারও কবর খোঁড়ার কথা তোলা হয়েছিল। মজিবুর রহমানই সেদিন সবাইকে বুঝিয়েছেন, এখন তো আর চেনার কোনো উপায় নেই। কবর খুঁড়ে কী হবে। সবাই মিলিতভাবে দোয়া পড়ে চলে আসেন।
মনে পড়ে, সে সময়ে নূর হোসেনের পিতার করুণ আর তীক্ষ প্রশ্ন ছিল আমাদের প্রতি-সত্যি কি নূর হোসেনের কবরের খোঁজ পাওয়া খুব কঠিন ছিল? আপনারা চেষ্টা করলে কি এটা সম্ভব ছিল না? আমাদের কাছে তো এ প্রশ্নের কোনো জবাব ছিল না।
স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পক্ষ থেকে সরকারের সুবিধা হয়, এমন বিবৃতিতে স্বাক্ষর দেওয়ার জন্য বারবার নানা প্রলোভন দেখিয়ে মজিবুর রহমানকে প্রভাবিত করার চেষ্টা হয়েছিল। একাধিকবার এ রকম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে। মজিবুর রহমান বিনীতভাবে সেসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। কারণ তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে এক মুহূর্ত দেরি হয়নি মজিবুর রহমানের। তাঁর কাছ থেকে বিবৃতি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে নষ্ট করতে চেয়েছেন তারা এবং তাকে হেয় করতে চেয়েছেন। কী বিরল চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং আদর্শবাদী মানুষ ছিলেন বেবিট্যাক্সিচালক মজিবুর রহমান।
মনে পড়ে, সে সময়ে নূর হোসেনের পিতার করুণ আর তীক্ষ প্রশ্ন ছিল আমাদের প্রতি-সত্যি কি নূর হোসেনের কবরের খোঁজ পাওয়া খুব কঠিন ছিল? আপনারা চেষ্টা করলে কি এটা সম্ভব ছিল না? আমাদের কাছে তো এ প্রশ্নের কোনো জবাব ছিল না।
আশির দশকের একদম শেষ দিকে, তখন তিনি সপ্তাহের সাত দিন বেবিট্যাক্সি চালাতে পারেন না। শুধু চার দিন গাড়ি নিয়ে বের হতেন। তাঁর চোখের শক্তি কমে আসছিল। বাতের ব্যথা বাড়ছিল ক্রমশ। বিশেষ করে শরীরের ডান দিকে। মাঝে মধ্যে হঠাত্ ঝাঁকুনি আসত। তবু গাড়ি চালাতে হয়। অন্যের গাড়ি। জমা ও তেলখরচসহ অন্যান্য খরচের পর কতটুকু আর থাকত।
সেই দিনগুলোতে বৃদ্ধ মজিবুর রহমান পরিবারের জন্য তেমন চিন্তা করতেন না। তার ছেলে নূর হোসেন ‘স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক’ আর ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ এই দাবিতে আত্মাহুতি দিয়েছে। সে জন্য দেশের মানুষ তাঁকে বহু সম্মান দিয়েছে। অনেক ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি। সারাক্ষণ শুধু ভাবতেন, কীভাবে নূর হোসেনের স্বপ্ন পূরণ হবে, কী করলে তার আত্মা শান্তি পাবে?
একদিন বৃদ্ধ মজিবুর রহমান বলেছিলেন, সারা দিন বেবিট্যাক্সি চালাই, কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, কোনো শান্তি নেই কারো জীবনে। সবাই ছুটে চলেছে, প্রাণপণ ছুটে চলেছে। আমি দেখি, মানুষ বাঁচতে চায়, মানুষ সুখ চায়। সে সুখ, সে মুক্তি সে কবে পাবে? আমরা সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, স্বাধীন হয়েছিলাম, শুধু পতাকা বদল নয়, সত্যিকার অর্থে দেশ গড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু কী পেলাম আমরা? কী হলো আমাদের স্বাধীন দেশে?
কিন্তু এতসব প্রশ্নের পরও ঢাকার চার দশকের জীবনযুদ্ধে পোড়খাওয়া যোদ্ধা, বহু লড়াই-সংগ্রামে অভিজ্ঞ মজিবুর রহমান আশাবাদী ছিলেন। তিনি বলতেন, আমার ছেলে রক্ত দিয়েছে, তা বৃথা যেতে পারে না। আমার যা সম্মান, সৌভাগ্য, সেটা তার জন্যই। আমি না থাকতে পারি, কিন্তু ইতিহাস দেখবে, একদিন বিজয় হবে। নূর হোসেন বলেছিল, সারা পৃথিবী কাঁপিয়ে দিয়ে যাবে। সারা পৃথিবী তার কথা জেনেছে। সে জাতির বিবেককে নাড়া দিয়ে গেছে।
একদিন বৃদ্ধ মজিবুর রহমান বলেছিলেন, সারা দিন বেবিট্যাক্সি চালাই, কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, কোনো শান্তি নেই কারো জীবনে। সবাই ছুটে চলেছে, প্রাণপণ ছুটে চলেছে। আমি দেখি, মানুষ বাঁচতে চায়, মানুষ সুখ চায়। সে সুখ, সে মুক্তি সে কবে পাবে?
দেশ ও দেশের মানুষের জন্য মজিবুর রহমানের এই ভালোবাসা এবং মঙ্গল-কামনারও সুদীর্ঘ অতীত আছে। তাঁর এই মানবকল্যাণবোধ গড়ে ওঠার ইতিহাসও বাংলাদেশের দীর্ঘ গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার অর্জনের ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এ দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসের ঘটনাবলির সঙ্গে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। সব আন্দোলনের উত্থান-পতনের তিনি ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী।
১৯৫২ সালে যেদিন মজিবুর রহমান তাঁর নিজ গ্রাম ঝাটিবুনিয়া ছেড়ে লঞ্চে ঢাকার সদরঘাটে পৌঁছান, সেদিন ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, ঢাকা নগরকে কালো অন্ধকার ঢেকে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঘাটের মানুষ তাঁকে শহরে যেতে দেয়নি। কারণ শহরের অবস্থা ভালো ছিল না, গোলাগুলি হয়েছে, ছাত্র মারা গেছে। এসব শুনে থমকে যান।
বড় ছেলে আলী হোসেনকে দুঃখ করে বলেছিলেন, নূর হোসেন যা চেয়েছিল, তা তো হলো। দেশে এত হানাহানি, সন্ত্রাস। স্বৈরতন্ত্র নিপাত হলো। গণতন্ত্র তো মুক্তি পেল না। এর চেয়ে সত্যি কথা আর কী হতে পারে।
’৫২ থেকে ’৫৪ সালের ঢাকার বুকের রাজনৈতিক ঘটনাবলির উত্থান-পতনকে যৌবনের বিস্ময়ভরা চোখে দেখেছিলেন মজিবুর রহমান। ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় নবাবপুর রোডে শেরেবাংলা ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিরোধীদলীয় রাজনীতিতে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন।
একাত্তরের ২৭ মার্চের কার্ফ্যু প্রত্যাহার হলে বিক্রমপুর চলে গিয়েছিলেন মজিবুর রহমান। কিন্তু পেটের দায়, সংসারের মায়ায় কদিন পর ঢাকায় ফিরে আসেন। বাসে টিকাটুলিতে নেমে ঢাকা শহরকে তাঁর ‘রাক্ষসের দেশ’ বলে মনে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে মজিবুর রহমান এক ভীতসন্ত্রস্ত পরিস্থিতিতে ঢাকায় বাস করেছেন।
স্বাধীনতা মজিবুর রহমানের মনে নতুন আশা সৃষ্টি করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর গভীর বিশ্বাস ছিল তাঁর। খুশিতে চলছিলেন তিনি। দেশের মঙ্গল হবে। এমন আস্থা তাঁর ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড তাঁকে গভীরভাবে আঘাত করে।
এ রকম অবস্থায় তিনি স্থির করেন, যাকে ভালো লাগবে, তাকে ভোট দেবেন। জিয়াউর রহমানকে ভালো লেগেছিল। তিনি গ্রামে ঘুরেছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে গেছেন। সে জন্য নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু তিনিও কিছু করতে পারেননি।
জেনারেল এরশাদের সামরিকতন্ত্র কায়েম হলে তিনি পছন্দ করতে পারেননি। কারণ দেশ আর জাতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে তারা। আজকে বাঙালির বুক ফুটো করছে বাঙালিরাই। সে জন্য জাতীয় পার্টির সরকারকে ভোট দেননি। তার সন্তান হত্যাকারীকে ক্ষমা করেননি কোনো দিন।
বেবিট্যাক্সিচালক মজিবুর রহমান চার দশক ধরে ঢাকায় থেকে বিভিন্ন পেশায় কাজ করে, তিন দশকের রাজনৈতিক ঘটনাবলির উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে এক দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছিলেন। তিনি কখনোই কারো দুয়ারে, কোনো দলের কাছে সাহায্য নিতে বা কোনো সুবিধার জন্য হাত পাতেননি। এটা ছিল তাঁর জন্য এক বড় গর্ব। তাঁর পুত্র নূর হোসেনের মহান আত্মত্যাগ বেবিট্যাক্সিচালক পিতাকে আরো শক্ত করেছিল। পুত্র হারানোর শোকে গভীরভাবে ব্যথিত ছিলেন, কিন্তু আশাবাদ তাঁকে আরো দৃঢ় করেছিল। দেশের মঙ্গলচিন্তা তাঁকে অতীতের চেয়ে অনেক বেশি ভাবিত করে তুলত। এভাবেই বিগত চার দশকের শত সংগ্রামে পোড়খাওয়া এক প্রবীণ প্রজন্ম বাংলাদেশের শহরে, গ্রামে, শ্রমিক-বস্তিতে, ক্ষেতমজুরের আস্তানায় গড়ে উঠেছে। সারা দেশে তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন। তাদেরই সৃষ্ট ভিত্তিভূমিতে এই কয়েক দশকের পতন-অভ্যুদয়বন্ধুর পথে লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নূর হোসেনের মতো সাহসী এবং আত্মত্যাগে উন্মুখ এক নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি হয়ে চলছিল।
নূর হোসেন শহীদ হওয়ার দু-তিন বছর পর শুধু নয়, স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর দেড় যুগ ধরে সভা-সমাবেশ অনেক হলো। হরতালও কম হলো না। সরকার এল, সরকার গেল। কিন্তু তেমন তো বড় কোনো পরিবর্তন হলো না সাধারণ মানুষের জীবনে। এক সরকারের জায়গায় আরেক সরকার এসেছে। নিজেদের পছন্দমতো নীতি নিয়ে চলেছে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, দলীয়করণ, আত্মঘাতী রাজনীতি, কোনো কিছুই প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
মনে পড়ে, শহীদ নূর হোসেনের পিতা বৃদ্ধ মজিবুর রহমান প্রায় এক দশক আগে একদিন প্রশ্ন করেছিলেন, এভাবে সব শেষ হয়ে যাবে? চারদিকে বেড়া দিয়ে আটকানো গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে হবে। তিনি শেষ পর্যায়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার কয়েক দিন আগেও বড় ছেলে আলী হোসেনকে দুঃখ করে বলেছিলেন, নূর হোসেন যা চেয়েছিল, তা তো হলো। দেশে এত হানাহানি, সন্ত্রাস। স্বৈরতন্ত্র নিপাত হলো। গণতন্ত্র তো মুক্তি পেল না। এর চেয়ে সত্যি কথা আর কী হতে পারে। স্বৈরতন্ত্রের পতন হলো, একের পর এক নির্বাচন হলো। আর আমরা পাচ্ছি একের পর এক নির্বাচিত স্বৈরতান্ত্রিক সরকার। এটাই কি আমাদের ভাগ্য? আমাদের নিয়তির লিখন?
শয্যাশায়ী মজিবুর রহমান যখন কাউকে চিনতে পারতেন না, কথা বলতে পারেন না, তখনো নূর হোসেনের বাঁধানো ছবিটা তার কাছে নিয়ে গেলে তার চোখে দেখা দিত গভীর বেদনার ছায়া। পরম মমতায় হাত বোলাতেন ছবিতে। আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইতেন ছবিটা। শহীদ নূর হোসেনের ছবিটা যেন ছিল তার বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন।
শহীদ নূর হোসেনের পিতা মজিবুর রহমানকে আমরা শেষ শ্রদ্ধা জানাই।
মতিউর রহমান : সম্পাদক, প্রথম আলো।