গভীর রাতে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করার ঘোষণার জেরে শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষাসচিবের পদত্যাগের দাবিতে সচিবালয়ের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাঁদের লাঠিপেটা করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। গতকাল বেলা পৌনে চারটায়
গভীর রাতে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করার ঘোষণার জেরে শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষাসচিবের পদত্যাগের দাবিতে সচিবালয়ের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাঁদের লাঠিপেটা করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। গতকাল বেলা পৌনে চারটায়

শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি

সচিবালয়ে ঢুকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, পুলিশের লাঠিচার্জ, সংঘর্ষ

  • সচিবালয়ের ভেতরে গাড়ি ভাঙচুর।

  • ৭৫ শিক্ষার্থী আহত।

  • সচিবকে প্রত্যাহারের ঘোষণা।

শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগসহ কয়েকটি দাবিতে গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ের ভেতরে ও বাইরে বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে তাদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় সচিবালয়ের ভেতরে বেশ কিছু গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। পুলিশ শিক্ষার্থীদের লাঠিচার্জ করে এবং কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। সেনাসদস্যরাও শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করেন।

গতকাল বেলা আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত এ ঘটনায় অন্তত ৭৫ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। একজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্যও আহত হন।

শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষাসচিবের পদত্যাগের দাবিতে গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে সচিবালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আসা শিক্ষার্থীরা। দেড় ঘণ্টার বেশি সময় ধরে সেখানে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দেওয়ার পর একপর্যায়ে সচিবালয়ের মূল ফটক খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ে তারা। সেখানে অন্তত ২০টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। তখন পুলিশ ও সেনাসদস্যরা তাদের ধাওয়া দিয়ে বাইরে বের করে দেন। এরপর বেশ সময় ধরে শিক্ষার্থীরা বাইরে থেকে সচিবালয়ের ভেতরে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। এরপর সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে গুলিস্তানসহ আশপাশের এলাকায়।

শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষাসচিবের পদত্যাগের দাবিতে সচিবালয়ের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে ঢোকেন শিক্ষার্থীরা

আগের দিন সোমবার রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে শিক্ষার্থীসহ ৩১ জন নিহত হন। আহত হন দেড় শতাধিক। মর্মান্তিক এ ঘটনার পর মঙ্গলবারের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করার ঘোষণা দেওয়া হয় সোমবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে। তখন শিক্ষার্থীরা ঘুমিয়ে ছিল। সকালে এই ঘোষণা নিয়ে সারা দেশের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। এ ঘটনা শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ করে তোলে।

ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থী গতকাল সচিবালয়ের দিকে যাওয়ার সময় শিক্ষা ভবনের সামনে প্রথম আলোকে বলেছে, মাইলস্টোন কলেজে এত বড় বিপর্যয়ের পর সারা দিনেও পরীক্ষা স্থগিত না করে রাত তিনটার দিকে কেন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে? সকালে ঘুম থেকে উঠে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার পর জানা গেল, পরীক্ষা স্থগিত। এমন অবিবেচক শিক্ষা উপদেষ্টা ও সচিবকে আর দেখতে চায় না তারা। তাই তাঁদের পদত্যাগের দাবিতে সচিবালয়ের সামনে এসেছে বলে জানায় সে।

বিক্ষোভ চলাকালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব সিদ্দিক জুবাইরকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত জানানো হলেও শিক্ষার্থীরা অন্য দাবিতে বিক্ষোভ চালিয়ে যায়।

সচিবালয় রাষ্ট্রের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর (কেপিআই) একটি। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এই সচিবালয় থেকে মূলত গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সিদ্ধান্তগুলো দেওয়া হয়। তাই সচিবালয়ে বাড়তি নিরাপত্তা থাকে। এখানে ঢুকতে গেলে বিশেষ পাসের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বিপুলসংখ্যক বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী সচিবালয়ের প্রধান ফটক ধাক্কাতে ধাক্কাতে ভেতরে ঢুকে পড়ে। এর আগে তারা মূল ফটকের সামনে জড়ো হয়ে দীর্ঘ সময় ধরে বিক্ষোভ করে।

সচিবালয়ের ভেতরে গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে

সচিবালয়ের ভেতরে বিক্ষোভ-ভাঙচুর

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শিক্ষার্থীদের একটি অংশ চলে যায় সচিবালয়ের ভেতরে ৬ নম্বর ভবনের সামনে। ওই ভবনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অবস্থিত। যদিও শিক্ষার্থীরা ভবনের ভেতরে ঢুকতে পারেনি। পরে ৫ নম্বর ভবন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সামনে গিয়ে গাড়ি ভাঙচুর করে। ৪ নম্বর ভবনে অবস্থিত কৃষি মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয়েও ঢোকার চেষ্টা করে শিক্ষার্থীরা। এ সময় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সামনে থাকা এক পুলিশ সদস্যকে মারধর করে শিক্ষার্থীরা। পরে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেন।

৭ নম্বর ভবনের সামনে গাড়ি ভাঙচুর করে শিক্ষার্থীদের আরেক অংশ চলে যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে। সেখানে গাড়ি ও মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়। সেখানে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের বাধা দেন। এরপরই সচিবালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে কয়েক শ পুলিশ ভেতরে ঢুকে শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়। এ সময় শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ। তখন শিক্ষার্থীরা দিগ্‌বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। একপর্যায়ে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। তখন তাদের সচিবালয়ের মূল ফটক দিয়ে বের হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়।

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম আলোকে জানান, অনেকক্ষণ ধরেই শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ে ঢোকার চেষ্টা করছিল। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ঠেলে শত শত শিক্ষার্থী ভেতরে ঢুকে পড়ে। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে আটকানোর মতো পরিস্থিতি তখন ছিল না।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আহত এক সদস্যকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে

দেড় ঘণ্টা ধরে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া

সচিবালয় থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে দেওয়ার পর তাদের একটি অংশ শিক্ষা ভবনের দিকে, আরেকটি অংশ জিরো পয়েন্টের দিকে চলে যায়। এর মধ্যে শিক্ষা ভবনের দিকে যারা চলে যায়, তারা আধা ঘণ্টার মতো মোড়ে অবস্থান নিয়ে পুলিশকে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। এ সময় পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে শিক্ষার্থীদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।

এরপর শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ জিরো পয়েন্ট মোড়ে অবস্থান নিয়ে সড়ক বন্ধ করে স্লোগান দিতে থাকে। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে পুলিশ তাদের ধাওয়া দিলে শিক্ষার্থীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। পরে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়লে শিক্ষার্থীরা তিন ভাগে ভাগ হয়ে একটি অংশ পুরানা পল্টনের দিকে, আরেক অংশ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকের দিকে এবং অপর অংশ গোলাপ শাহ মাজারের দিকে চলে যায়। এর মধ্যে পুরানা পল্টনের দিকে যাওয়া শিক্ষার্থীদের পেছনে পেছনে গিয়ে তাদের পুরানা পল্টন মোড় পর্যন্ত ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে পরিস্থিতি শান্ত হয়।