লাশ
লাশ

ঢাকা উত্তর–দক্ষিণের টানাটানিতে মর্গে জমছে বেওয়ারিশ লাশ

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায় জুরাইন কবরস্থান আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতায় রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ–সংলগ্ন কবরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হচ্ছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বলছে, জুরাইন কবরস্থানে মাসে মোট বেওয়ারিশ লাশের এক-তৃতীয়াংশের দাফন হবে। আর উত্তর সিটি করপোরেশন বলছে, উত্তরের শতভাগ লাশ রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন হলেও দক্ষিণের কোনো লাশ এখানে দাফন করা যাবে না। এ টানাটানিতে হাসপাতালের মর্গগুলোতে লাশ জমে যাচ্ছে।
বেওয়ারিশ লাশ দাফনের দায়িত্বপ্রাপ্ত একমাত্র বেসরকারি সংস্থা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম দুই সিটি করপোরেশনে চিঠি চালাচালি করে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছে।

মৃতদেহ বহনে রয়েছে আঞ্জুমানের বিশেষ ব্যবস্থা

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায় জুরাইন কবরস্থান আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতায় রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ–সংলগ্ন কবরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হচ্ছে। জুরাইন কবরস্থানের আয়তন ১৭ দশমিক ৬০ একর। আর রায়েরবাজার কবরস্থানের আয়তন ৯৬ দশমিক ২৩ একর।

উত্তর সিটি করপোরেশন গত ১৮ আগস্ট আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে চিঠিতে স্থানসংকটের কথা উল্লেখ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কোনো বেওয়ারিশ লাশ রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন না করার কথা বলে।
ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের লোগো

আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের দেওয়া তথ্য এবং দুই সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন চিঠির তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের ১৮ নভেম্বর জুরাইন কবরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ দাফনের পর এ কার্যক্রম বন্ধ ছিল। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম গত বছরের ২৭ মার্চ দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে জুরাইন কবরস্থানে লাশ দাফন না করতে পারার বিষয়ে চিঠি দেয়। ওই বছরের ২২ মে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন স্থানসংকটের কারণ দেখিয়ে বেওয়ারিশ লাশ না নিতে অনুরোধ করে। এরপর গত বছরের ১২ ডিসেম্বর আরেক চিঠিতে মোট বেওয়ারিশ লাশের তিন ভাগের এক ভাগ নেওয়ার অনুমতি দেয়। কিন্তু কবর চালার (পুনরায় কবর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা) কাজের জন্য চলতি বছরের ১৬ জুলাই পর্যন্ত লাশ দাফন হয়নি। ১৭ জুলাই থেকে এক-তৃতীয়াংশ হিসাবে দাফন শুরু হয়।

অন্যদিকে উত্তর সিটি করপোরেশন গত ১৮ আগস্ট আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে চিঠিতে স্থানসংকটের কথা উল্লেখ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কোনো বেওয়ারিশ লাশ রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন না করার কথা বলে। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে পাঠানো চিঠিতে এ বিষয়টি উল্লেখ করে, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন শতভাগ লাশ কোন কবরস্থানে দাফন করা হবে, সে বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত দেওয়ার অনুরোধ করে। তবে ১৭ আগস্ট জুরাইন কবরস্থানে এক-তৃতীয়াংশ লাশ দাফন হয়ে যাওয়ায় জুরাইন কবরস্থান থেকেও আর লাশ দাফন করা হবে না বলে জানানো হয়।

উত্তর সিটি করপোরেশন বলছে, উত্তরের শতভাগ লাশ রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন হলেও দক্ষিণের কোনো লাশ এখানে দাফন করা যাবে না।

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯ অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন নিজ খরচে নিঃস্ব ও বেওয়ারিশ লাশ দাফন ও দাহের ব্যবস্থা করবে। এ খাতে সিটি করপোরেশনের নিজস্ব বাজেট বরাদ্দ থাকবে।

বর্তমানে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের মর্গে ২২টি এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের (মিটফোর্ড হাসপাতাল) মর্গে ৬টি লাশ পড়ে আছে। সেপ্টেম্বর মাস শুরু হলে আবার দাফন কার্যক্রম শুরু হবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান প্রথম আলোকে বলেন, কবরস্থানে স্থানসংকটের কারণে এক-তৃতীয়াংশ বেওয়ারিশ লাশ দাফনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ২০১৭ সালে। এটা যৌক্তিক। বেওয়ারিশ লাশ দাফন হবে না—এটা কেউ চায় না। উত্তর সিটি করপোরেশনের কবরস্থানে জায়গা আছে, এ করপোরেশনের সঙ্গে আলোচনা করে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম এর স্থায়ী সমাধান করতে পারে।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের মর্গে ২২টি এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের (মিটফোর্ড হাসপাতাল) মর্গে ৬টি লাশ পড়ে আছে। সেপ্টেম্বর মাস শুরু হলে আবার দাফন কার্যক্রম শুরু হবে।

জুরাইন কবরস্থানের মোহরার মো. আমিনুল ইসলাম জানালেন, কবরস্থানের সংস্কারসহ বিভিন্ন কারণে দীর্ঘদিন বেওয়ারিশ লাশ দাফন বন্ধ ছিল। গত জুলাই মাস থেকে আবার দাফন শুরু হয়েছে। ২০টি লাইনে ২৫টি করে কবর অর্থাৎ ৫০০টি কবর বেওয়ারিশ লাশ দাফনের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। আগস্ট মাসে ২১টি এবং জুলাই মাসে ১৯টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়েছে। ১৮ মাস পরে আগের কবরে আবার নতুন করে কবর দেওয়া যায় বলেও জানালেন তিনি।

উত্তর সিটি করপোরেশনের শতভাগ বেওয়ারিশ লাশ দাফনের কথা বলা হয়েছে। তবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন কোনো বেওয়ারিশ লাশ রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা সম্ভব নয় বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন-উল-হাসান

আমিনুল ইসলাম বলেন, বেওয়ারিশ লাশ দাফনের খরচ দেয় কবরস্থানে নিয়োগ পাওয়া ঠিকাদার। পরে সিটি করপোরেশন থেকে এক-তৃতীয়াংশ হিসাবেই বিল পান ঠিকাদার। তাই এর বেশি লাশ হলে দাফনে ঠিকাদারের সমস্যা হয়।

উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন-উল-হাসান প্রথম আলোকে বলেন, উত্তর সিটি করপোরেশনের শতভাগ বেওয়ারিশ লাশ দাফনের কথা বলা হয়েছে। তবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন কোনো বেওয়ারিশ লাশ রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা সম্ভব নয় বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

রায়েরবাজার কবরস্থানে ৪ নম্বর ব্লকে বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়। এই ব্লকে গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে বেওয়ারিশ হিসেবে কবর দেওয়া হয় ১১৪টি লাশ। তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে কতজনের লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে, সে হিসাব নেই।

২০২১ সালে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের প্রকাশিত  জীবনেও সাথী, মরণেও সাথী বইতে উল্লেখ করা হয়েছে, কলকাতায় ১৯০৫ সালে বেওয়ারিশ লাশ দাফনের মাধ্যমেই ইসলামি জনকল্যাণমূলক এই সংস্থা চালু করেছিলেন ভারতের গুজরাট রাজ্যের সুরাটের শেঠ ইব্রাহিম মোহাম্মদ ডুপ্লে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ঢাকায় স্থাপন করা হয় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের শাখা।

আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের হিসাব বলছে, ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়েছে ১২ হাজার ৯০৮টি। এরপর ২০২১ সালে ৪৬৫টি, ২০২২ সালে ৪৪৩টি, ২০২৩ সালে ৪৯০টি, ২০২৪ সালে ৫৭০টি, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৪০৮টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়েছে। লাশ উদ্ধারের পর পরিচয় শনাক্ত করা না গেলে আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর তা আঞ্জুমান মুফিদুলকে দাফনের জন্য হস্তান্তর করা হয়।

আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের দাফন সেবা কর্মকর্তা কামরুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গ, থানা, বৃদ্ধাশ্রম থেকে বেওয়ারিশ লাশের কথা জানানো হয়। পরে আইনি প্রক্রিয়ায় লাশ নির্দিষ্ট কবরস্থানে যথাযথ নিয়মে পৌঁছে দেওয়া হয়।

বেওয়ারিশ লাশ নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে কামরুল আহমেদ বলেন, জুরাইন কবরস্থানে মাসে এক-তৃতীয়াংশের হিসাবে ২০ থেকে ২২টি লাশ দাফনের পর আর দাফন করার সুযোগ নেই। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন হাসপাতালের মর্গে ও বিভিন্ন থানায় লাশ জমে যাচ্ছে। এর একটি স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের মর্গের ইনচার্জ রামো চন্দ্র দাস জানালেন, বর্তমানে (৩১ আগস্ট পর্যন্ত) ২২টি লাশ আছে মর্গে। লাশগুলো ফ্রিজে রাখা আছে। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম থেকে জানানো হয়েছে, সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখ থেকে আবার পাঁচটি করে লাশ নেওয়া শুরু করবে।

জুরাইন কবরস্থানে মাসে এক-তৃতীয়াংশের হিসাবে ২০ থেকে ২২টি লাশ দাফনের পর আর দাফন করার সুযোগ নেই।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের দাফন সেবা কর্মকর্তা কামরুল আহমেদ

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের (মিটফোর্ড হাসপাতাল) ফরেনসিক বিভাগের মর্গের সহকারী শ্যামল চন্দ্র দাস প্রথম আলোকে বলেন, এক সপ্তাহ ধরে মর্গে ছয়টি বেওয়ারিশ লাশ পড়ে রয়েছে। মর্গের ফ্রিজ নষ্ট ২০১৪ সাল থেকে। লাশগুলো স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখতে হচ্ছে বলে পচে–গলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এ পরিবেশে দম বন্ধ করে কাজ করতে হচ্ছে। লাশ দাফনের বিষয়ে দ্রুত স্থায়ী সমাধান চান বলে জানালেন তিনি।