মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা

রোহিঙ্গা ঢলের ৮ বছর

জটিল হয়ে গেছে রোহিঙ্গা সংকট

দুবার দিনক্ষণ চূড়ান্ত করেও প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আজ কক্সবাজারে শুরু হচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সম্মেলন।

রাখাইনে গণহত্যা থেকে প্রাণে বাঁচতে আট বছর আগের এই দিনে বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল রোহিঙ্গাদের ঢল। তাদের আর নিজ দেশে ফেরানো যায়নি। দুবার দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়েছিল, তবে প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। বরং গত দেড় বছরে নতুন করে এসেছে ১ লাখ ২৪ হাজার রোহিঙ্গা।

রোহিঙ্গাদের নিজস্ব আবাস মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ক্ষমতার সমীকরণ বদলে গেছে। সেই সঙ্গে আঞ্চলিক আর বৈশ্বিক নানা কারণে মনোযোগ হারিয়ে ফেলেছে রোহিঙ্গা সংকট।

এদিকে রোহিঙ্গাদের একাংশ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অনেকে মানব পাচারকারীদের শিকার হচ্ছে। খুন, ধর্ষণের ঘটনা একের পর এক ঘটছে। অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় ও ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। ছড়িয়ে পড়ছে মাদক ও অবৈধ অস্ত্র।

মানবিক সহায়তাও কমছে। কারণ, আন্তর্জাতিক সহায়তা আগের মতো নেই। শিশুদের পড়ানোর অনেক স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে হতাশা বাড়ছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে।

২০২৫ সালের জন্য জিআরপির আওতায় ৯৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার চাওয়া হয়েছিল। গত জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে পাওয়া গেছে ৩৫ শতাংশ।

এমন প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তিনটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সম্মেলনের আয়োজন করছে। প্রথমটি শুরু হচ্ছে আজ সোমবার কক্সবাজারে। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বাকি দুই সম্মেলনের একটি হবে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। অন্যটি হবে ৬ ডিসেম্বর কাতারে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) ও অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রত্যাবাসন জটিল হলেও সরকারের প্রচেষ্টা থেমে নেই। সম্মেলন থেকে ভালো কিছু আশা করা যায়।

২০১৭ সালে সীমান্তচৌকিতে ‘রোহিঙ্গা জঙ্গিদের’ হামলার অজুহাত তুলে গণহত্যা শুরু করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। তখন প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। পরেও অনেকে এসেছে। আগে থেকেও অনেক রোহিঙ্গা ছিল। সব মিলিয়ে এখন কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৪ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। নিবন্ধিতদের বাইরেও রোহিঙ্গা রয়েছে।

চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আশ্রয়শিবিরের ছয় লাখ কিশোর-তরুণ-যুবক তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হলে তাদের একটি অংশ পাচারের কবলে পড়বে, কিছু অংশ অপরাধে জড়িয়ে পড়বে।
রোহিঙ্গা নেতা সালামত উল্লাহ

শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনা বা জিআরপির আওতায় খাদ্য ও অন্যান্য সহায়তা দেওয়া হয়। জিআরপিতে অনুদান দেয় বিভিন্ন দেশ, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান সবচেয়ে বেশি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর সহায়তা কমিয়ে দেওয়া হয়।

২০২৫ সালের জন্য জিআরপির আওতায় ৯৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার চাওয়া হয়েছিল। গত জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে পাওয়া গেছে ৩৫ শতাংশ।

টেকনাফের শালবন আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা সনজিদা আক্তারের সংসারে চার ছেলেমেয়ে। যে সহায়তা দেওয়া হয়, তা দিয়ে চলে না দাবি করে তিনি বলেন, বর্ষাকালে আশ্রয়শিবিরে পাহাড়ধসের ঝুঁকি, শীতকালে আগুনে পুড়ে মরার শঙ্কা ও আর নিরাপত্তাঝুঁকি নিয়ে বাস করতে হচ্ছে। তাঁরা দ্রুত ফিরতে চান।

তহবিল সংকটের কারণে আশ্রয়শিবিরে তিন হাজার লার্নিং সেন্টার (শিশু শিক্ষাকেন্দ্র) বন্ধ হয়ে গেছে উল্লেখ করে রোহিঙ্গা নেতা সালামত উল্লাহ বলেন, চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আশ্রয়শিবিরের ছয় লাখ কিশোর-তরুণ-যুবক তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হলে তাদের একটি অংশ পাচারের কবলে পড়বে, কিছু অংশ অপরাধে জড়িয়ে পড়বে।

৮ বছরে ২৪৬ জন খুন

অপরাধের চিত্র পাওয়া যায় পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের কাছ থেকে। তাঁদের দেওয়া তথ্য বলছে, বিগত আট বছরে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে খুন হয়েছেন ২৬৩ জন। এই সময়ে বিভিন্ন অপরাধের ৪ হাজার ৫৪টি মামলায় ৯ হাজার ৩৩ জন রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়। কিন্তু ১৪ লাখ রোহিঙ্গার ভেতর থেকে আসামিদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা কঠিন। 

আট বছরে মাদকের ২ হাজার ৫৮৯টি মামলায় ৩ হাজার ৯৩৫ জনকে আসামি করা হলেও অনেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। একই সময়ে অস্ত্রের ৪১৮টি মামলায় ৮৭৩ জনকে আসামি করা হলেও চিহ্নিতদের অনেককে আইনের আওতায় আনা যায়নি। 

বিগত দেড় বছরে ৩৮টি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার মামলায় ৩৪ জন রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়। ৩৭টি অপহরণের মামলায় আসামি করা হয় ৮৯ জনকে। ১৭টি মানব পাচার মামলায় আসামি করা হয় ১৮ জনকে। 

রাখাইনে সংঘাত থামেনি 

রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি ক্রমেই অস্থিতিশীল হচ্ছে। সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, আরাকান আর্মিকে দখলে রাখা সীমান্তচৌকি থেকে উচ্ছেদ করতে হামলা চালাচ্ছে দেশটির সশস্ত্রগোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা), আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), আরাকান রোহিঙ্গা আর্মিসহ (আরআইআর) কয়েকটি গোষ্ঠী। তাতে বেশ কিছু রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে। সেখানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার লক্ষণ নেই। এমন অবস্থায় রোহিঙ্গাদের ফেরানোর সম্ভাবনা একেবারেই কম। 

২০২৪ সালে রোজার মাসে আশ্রয়শিবিরে গিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে পাশে রেখে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, আগামী পবিত্র ঈদুল আজহার নামাজ রোহিঙ্গারা আরাকানে পড়বে। তাঁর কথায় রোহিঙ্গারা খুশি হয়েছিল। কিন্তু অগ্রগতি নেই বললেই চলে।

উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গা ছৈয়দ হোসেন (৫৩) প্রথম আলোকে বলেন, ত্রিপলের ছাউনিতে আট বছর কেটে গেল, অথচ জন্মভূমি আরাকানে (রাখাইন রাজ্য) ফেরার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।