ছায়ানটে হামলা ও আগুন দেওয়ার ঘটনায় নিন্দা, মানববন্ধন

গতকাল বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে একদল হামলাকারী দেশের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট ভবনে হামলা চালায়। তারা ভবনের ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর চালায়। লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।

আজ শুক্রবার ধানমন্ডির ছায়ানট সংস্কৃতি–ভবনে গিয়ে দেখা গেছে, ছয়তলা ভবনটির প্রতিটি তলাতেই ভাঙচুর চালানো হয়েছে। হামলাকারীরা ভবনের নিচের তলায় অগ্নিসংযোগ করেছে। ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে ভেতরের প্রতিটি তলায়। তারা শ্রেণিকক্ষগুলোর সিসি ক্যামেরা, কম্পিউটার, আসবাব তছনছ ও ভাঙচুর করেছে। বিশেষ করে তাদের আক্রোশ ছিল বাদ্যযন্ত্রগুলোর প্রতি। এ ছাড়া বেশ কিছু ল্যাপটপ ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জামও লুটপাট করেছে।

ছায়ানটের শিক্ষার্থীদের অনুশীলন ও অনুষ্ঠানের জন্য ভবনে হারমোনিয়াম, তবলা, সেতার, তানপুরাসহ বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র ছিল। দুষ্কৃতকারীরা এসব বাদ্যযন্ত্র ভেঙে ফেলেছে। ছায়ানটের সহসভাপতি পার্থ তানভীর নভেদ প্রথম আলোকে বলেন, গভীর রাতে সংঘবদ্ধভাবে ছায়ানটে হামলা করা হয়েছে। হামলাকারীরা ছায়ানট সংস্কৃতি–ভবন লক্ষ্য করে এগিয়ে আসার খবর পেয়ে তিনি আগেই নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালনকারীদের সতর্ক থাকার কথা জানিয়ে দেন। ফলে তাঁরা হামলা থেকে রক্ষা পান।

ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক শিল্পী লাইসা আহমদ লিসা প্রথম আলোকে বলেন, হামলা সত্ত্বেও ছায়ানট তার অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হবে না। যত দ্রুত সম্ভব অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে আবার কার্যক্রম শুরু করা হবে।

হামলাকারীরা ছায়ানট ভবনের ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর চালায়

ছায়ানটের বিবৃতি

ছায়ানটের পক্ষ থেকে সভাপতি সারওয়ার আলী ও সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা গতকাল শুক্রবার এক বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে তাঁরা বলেছেন, ‘ছায়ানটের কাজের ক্ষেত্র রাজনীতি নয়। সংগীত, সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে বাঙালি জাতিসত্তাকে ধারণ করে ছায়ানট ছায়ানট সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের সমাজ গড়তে প্রয়াসী। ওসমান হাদির মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে তাঁরা গভীরভাবে শোকাহত। কিন্তু ওই সূত্র ধরে ছায়ানট সংস্কৃতি–ভবনে কেন হামলা সংঘটিত হলো তা বোধগম্য নয়। হয়তো পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করেছে সংস্কৃতিচর্চার বিরোধী গোষ্ঠী। তাঁরা বলেন, বাঙালির আবহমান সংগীত সংস্কৃতির সাধনা ও প্রসারে ছায়ানট তার স্থির প্রত্যয়যাত্রায় অবিচল থাকবে।’

বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, এই হামলায় ছয়তলা ভবনের সব সিসি ক্যামেরাসহ অধিকাংশ কক্ষ, প্রক্ষালন কক্ষ এবং বহু বাদ্যযন্ত্র, মিলনায়তন, কম্পিউটার ও আসবাব ভাঙচুর করা হয়েছে। হামলাকারীরা সার্ভারসহ ছায়ানটের বাদ্যযন্ত্র ও আসবাব পুড়িয়ে দিয়েছে। অন্তত সাতটি ল্যাপটপসহ গোটা চারেক ফোন ও কিছু হার্ডডিস্ক লুট করেছে। তাদের ভাঙচুরে বৈদ্যুতিক সংযোগ ও সরঞ্জামও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারকে অনুরোধ করেছেন তাঁরা।

ছায়ানট সংস্কৃতি–ভবেন গিয়ে দেখা গেছে, ছয়তলা ভবনটির প্রতিটি তলাতেই ভাঙচুর চালানো হয়েছে। হামলাকারীরা ভবনের নিচতলায় অগ্নিসংযোগ করেছে

মানববন্ধনে নিন্দা

সকাল থেকে ছায়ানটে শিক্ষক,শিল্পী শিক্ষকদের অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনে আসেন। দুপুরের দিক থেকে কিছু কিছু পরিচ্ছন্নতার কাজও শুরু হয়। এ সময় নাগরিক সমাজের পক্ষে এই হামলার নিন্দা ও ছায়ানটে প্রতি সংহতি প্রকাশ এবং হামলাকারীদের বিচার দাবি করে ভবনের সামনের সড়কে মানববন্ধন ও  সমাবেশ আয়োজন করা হয়। সমাবেশে শিক্ষক, আইনজীবী, লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের পাশাপাশি ছায়ানটের অনেক শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকেরাও অংশ নেন।

মানববন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, একটি মহল দেশকে পরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ সংবাদপত্র ও ছায়ানটের মতো ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলা করছে। তিনি বলেন, শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি মহল এ ধরনের হামলা–অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটাচ্ছে। এটা সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত। অবশ্যই হাদির হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে হবে। কিন্তু আইন হাতে তুলে নিয়ে কেউ যেন আর নাশকতা ঘটাতে না পারে, সে জন্য সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

নাগরিক সমাজের পক্ষে ছায়ানটে হামলার নিন্দা জানিয়ে মানববন্ধন ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়

আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী সারা হোসেন বলেন, ছায়ানটে এই হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আজ থেকে ৫৪ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের সময় যেভাবে দেশের মেধা, মনন, সৃজনশীলতাকে ধ্বংস করতে শিল্পী–সাংবাদিক–বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল, সেই একইভাবে আবার বিজয়ের মাসে দেশের সংবাদপত্র ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের ওপরে হামলা চালানো হলো। এই হামলাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।