আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে যশোরের বেনাপোল পর্যন্ত সড়ককে চার লেন করার কাজ শুরু করতে চায়। ১২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ দুই লেনের সড়কটি চার লেন করতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। এতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ পড়বে ১৪০ কোটি টাকা। সমসাময়িক চার লেন কোনো প্রকল্পে এত বেশি ব্যয় ধরা হয়নি।
ভাঙ্গা-বেনাপোল সড়কে প্রতি কিলোমিটারে এত টাকা ব্যয়ের প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। তারা জমি অধিগ্রহণ, পরামর্শক, যানবাহন কেনাকাটা, প্রকল্প ব্যবস্থাপনাসহ বেশ কয়েকটি খাতে অস্বাভাবিক ব্যয়ের প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এ ধরনের সড়ক নির্মাণে বেশি ব্যয়ের বিষয়টি ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বুয়েটের গবেষণায় উঠে এসেছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট নথি বলছে, সওজের কর্মকর্তারা বলছেন, পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এরই অংশ হিসেবে ভাঙ্গা-বেনাপোল চার লেন মহাসড়ক করতে দুটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। জমি অধিগ্রহণ ও পরিষেবা স্থানান্তরে ৪ হাজার ২৩৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নড়াইল ও যশোরে সড়কের দুই পাশে ৯৬৭ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এ অর্থ সরকার দেবে।
ভাঙ্গা-বেনাপোল মহাসড়ক নির্মাণে আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সার্ভিস লেনসহ ছয় লেনের মহাসড়কে খরচ ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভারত সরকার ১১ হাজার ৮২ কোটি টাকা ঋণ দেবে। বাকি ২ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে চার লেনে খরচ হবে ১৮ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। এতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে ১৪০ কোটি টাকা। অবশ্য জমি অধিগ্রহণ ছাড়া খরচ হবে ১০৭ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে সওজের প্রধান প্রকৌশলী মো. ইসহাক প্রথম আলোকে বলেন, সব ধরনের নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে, রেট শিডিউলে পরিবর্তন এসেছে। ২০১৮ সালের রেট শিডিউলের পরিবর্তে ২০২২ সালের রেট শিডিউল কার্যকর হয়েছে। তাই ব্যয় বাড়ছে।
প্রকল্পের নথি ঘেঁটে দেখা যায়, চার লেন মহাসড়ক নির্মাণে ১৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যমান দুই লেনের সড়ককে চার লেন করতে কেন বিদেশি পরামর্শক লাগবে এবং কেন এত বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করতে হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশনের।
এ প্রসঙ্গে সওজের প্রধান প্রকৌশলী মো. ইসহাক প্রথম আলোকে বলেন, উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পরামর্শক নিয়োগে তাদের শর্ত থাকে। শর্ত মানতে গিয়ে বিদেশি পরামর্শক নেওয়া হয়।
চার লেনের মহাসড়কের জন্য ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও নগরকান্দায় ৪১ একর; গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর ও কাশিয়ানীতে ৭৯ একর; নড়াইলের লোহাগড়া ও সদরে ২৯২ একর এবং যশোরের বাঘারপাড়া, যশোর সদর, ঝিকরগাছা ও শার্শায় ৫৪৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। সব মিলিয়ে ৯৬৭ একর জমি অধিগ্রহণের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। প্রস্তাবিত এই জমি কম নাকি বেশি, তা যাচাই-বাছাই করা হবে।
জমি অধিগ্রহণ নিয়ে সন্দেহ তৈরি হওয়ার কারণ, ২০১৭ সালে পাস হওয়া একটি আইন। ‘স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল বিল-২০১৭’ আইন পাস হওয়ার পর থেকে কোনো এলাকায় নতুন সড়ক হবে কিংবা সড়ক চার লেন হবে—এমন তথ্য পেলে প্রভাবশালীরা প্রকল্প শুরুর আগেই সেখানে কম দামে জমি কেনে। চাঁদপুর বিশ্ববিদ্যালয় করতে গিয়ে জমি কেনাকাটায় বাণিজ্যের বিষয়টি গণমাধ্যমে উঠে এসেছে।
চার লেনের সড়কটি নির্মাণ করতে গিয়ে চারটি জেলার বিভিন্ন এলাকায় পরামর্শক, প্রকৌশলীদের জন্য অস্থায়ী ভবন করা হবে। এসব ভবন নির্মাণে খরচ হবে ১৮৪ কোটি টাকা। কিসের ভিত্তিতে এই খরচ ধরা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে পরিকল্পনা কমিশনের। এ ছাড়া চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে যানবাহন কেনাকাটাসহ আরও কয়েকটি খাতের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কমিশন।
বাংলাদেশে প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে অস্বাভাবিক ব্যয়ের আলোচনাটি বেশ পুরোনো। সওজের তথ্য বলছে, সাধারণত উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়নে চার লেন সড়ক প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয় ১৮ কোটি থেকে ৩৪ কোটি টাকা।
১৯২ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে খরচ পড়েছিল প্রতি কিলোমিটার ২১ কোটি টাকা। জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ চার লেন প্রকল্পেও একই ব্যয় হয়েছে। যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর আট লেন প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয়েছে ২২ কোটি টাকা। রংপুর-হাটিকুমরুল চার লেনে খরচ পড়েছে ৫৫ কোটি টাকা। সিলেট থেকে তামাবিল পর্যন্ত চার লেনের সড়কে খরচ হবে ৬৪ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের রেট শিডিউলে নির্মিত ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেন করতে খরচ হচ্ছে ৮২ কোটি টাকা।
২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা যায়, ভারতে প্রতি কিলোমিটার সড়কে ব্যয় ১১ লাখ থেকে ১৩ লাখ ডলার বা (১০০ টাকা ধরে) ১১ কোটি থেকে ১৩ কোটি টাকা। অন্যদিকে চীনে ব্যয় হয় ১৩ লাখ থেকে ১৬ লাখ ডলার বা ১৩ কোটি থেকে ১৬ কোটি টাকা।
বৃহৎ প্রকল্প বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, জমি অধিগ্রহণ নিয়ে দেশে বড় ধরনের বাণিজ্য হচ্ছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় নেতাদের কাছে টাকা পৌঁছানোর একটি পদ্ধতি হয়ে গেছে জমি অধিগ্রহণ। এই প্রকল্পে কেন এত বিপুল পরিমাণ জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন পড়ল, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাঁর মতে, মানুষের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে নয়, প্রভাবশালী দেখে এখন প্রকল্পের অগ্রাধিকার নির্ধারিত হয়।