
ফুসফুস ক্যানসার কেবল ব্যক্তিগত নয়, রাষ্ট্রীয়ভাবেও বিশাল আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে চিকিৎসা, হাসপাতাল, যন্ত্রপাতি সবকিছুর ওপর। তাই প্রতিরোধে শুধু চিকিৎসক নন, পরিবেশ, খাদ্য, আইন, রাজস্ব কর্তৃপক্ষ সবার সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। কিন্তু এখনো প্রশাসনিক ও সমন্বয়গত দুর্বলতার কারণে সমস্যা ঠিকভাবে মোকাবিলা করা যাচ্ছে না।
এসকেএফ অনকোলজির আয়োজনে ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় কথাগুলো বলেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। এতে উপস্থাপনায় ছিলেন নাসিহা তাহসিন।
বাংলাদেশে ফুসফুস ক্যানসারের কারণ, ঝুঁকি, লক্ষণ, চিকিৎসা, সচেতনতা, প্রতিরোধব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। পর্বটি গত বুধবার সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই উপস্থাপক ফুসফুস ক্যানসার সম্পর্কে জানান, ফুসফুস ক্যানসারের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৮০০ সালের দিকে। তখন ধূমপান ও বায়ুদূষণ তুলনামূলক কম থাকায় এর প্রকোপও ছিল সীমিত। আধুনিক যুগে প্রযুক্তির প্রসার, মানসিক চাপ, ধূমপানের অভ্যাস ও বায়ুদূষণ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুসফুস ক্যানসারের হারও দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।
দেশে ফুসফুসের ক্যানসার বেশি হয় পুরুষদের
আলোচনায় স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে ফুসফুস ক্যানসার সবচেয়ে বেশি দেখা যায় পুরুষদের মধ্যে। এর মূল দুটি কারণ—বায়ুদূষণ ও তামাক ব্যবহার। ঢাকা শহর এখন বিশ্বের অন্যতম দূষিত নগরী। এর সঙ্গে কম বয়সে ধূমপানের অভ্যাস যুক্ত হলে ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।
বাংলাদেশে ফুসফুস ক্যানসারের হার সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর আনুমানিক দেড় লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হন, যার প্রায় অর্ধেক পুরুষ। এই পুরুষদের মধ্যে ফুসফুস ক্যানসারই সর্বাধিক। দীর্ঘদিনের কাশি, শ্বাসকষ্ট, ক্ষুধামান্দ্য, বুকের আকার বদলে যাওয়া—এগুলো অনেক সময় টিবি বা সিওপিডি মনে করা হয়, কিন্তু আসলে ক্যানসারের লক্ষণও হতে পারে। এই বিভ্রান্তি ও দেরি রোগনির্ণয়ে বড় বাধা। তাই চিকিৎসকের উচিত সঠিকভাবে টিবি নাকি ক্যানসার, তা নিশ্চিত করতে আধুনিক পরীক্ষার সহায়তা নেওয়া।
ক্যানসার শনাক্তে পরীক্ষা
ফুসফুস ক্যানসার শনাক্তে পরীক্ষার ধরন নিয়ে স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ফুসফুস ক্যানসার নির্ণয়ে ধাপে ধাপে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা করা হয়। প্রথমে স্পুটাম টেস্ট, যেখানে কফের নমুনায় ক্যানসার কোষ আছে কি না দেখা হয়। দ্বিতীয়ত, চেস্ট এক্স–রে, যেটা প্রাথমিক স্ক্রিনিং; এতে খরচও কম। তৃতীয়ত, সিটি স্ক্যান (উইথ কনট্রাস্ট), যেখানে বুকের ভেতরের সন্দেহজনক অংশ বিস্তারিতভাবে দেখা যায়। চতুর্থত, ব্রঙ্কোস্কপি, বুকের মাঝামাঝি স্থানে টিউমার থাকলে নল ঢুকিয়ে টিস্যু সংগ্রহ করা হয়। পঞ্চমত, সিটি–গাইডেড বায়োপসি, এখানে ফুসফুসের প্রান্তিক অংশের টিউমারের টিস্যু নেওয়া হয়।
ফুসফুস ক্যানসারের প্রকার সম্পর্কে স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ফুসফুস ক্যানসার প্রধানত দুই ধরনের। নন–স্মল সেল ফুসফুস ক্যানসার ও স্মল সেল ফুসফুস ক্যানসার। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ২০ থেকে ২৫ শতাংশের স্মল সেল ক্যানসার হয়ে থাকে। এটি বেশি অ্যাগ্রেসিভ, মানে দ্রুত ছড়ায় এবং সাধারণত সার্জারির সুযোগ থাকে না।
স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, নন–স্মল সেল ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশের হয়ে থাকে। এটি তুলনামূলক ধীরে বাড়ে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে অস্ত্রোপচার করা সম্ভব। বায়োপসির মাধ্যমে কোন ধরনের ক্যানসার, তা নিশ্চিত করা হয়।
ফুসফুস ক্যানসারের স্টেজ বা ধাপগুলো কীভাবে নির্ধারিত হয়? উত্তরে স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, স্মল সেল ক্যানসারকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একটি হলো লিমিটেড স্টেজ, যা ফুসফুসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর অন্যটি এক্সটেনসিভ স্টেজ, যা শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে নন–স্মল সেল ক্যানসারকে চারটি ধাপে বা স্টেজে ভাগ করা হয়।
চিকিৎসা
স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, স্টেজ নির্ধারণের উদ্দেশ্য হলো, কোন ধরনের চিকিৎসা অর্থাৎ অস্ত্রোপচার, কেমো, রেডিয়েশন ইত্যাদি দেওয়া হবে তা ঠিক করা। তিনি বলেন, ‘এখানে বলতে চাই, বাংলাদেশে এখনো “টিউমার বোর্ড বা সমন্বিত চিকিৎসক দল” গঠনের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। অথচ সঠিক চিকিৎসা নির্ধারণের জন্য বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ, রেডিওলজিস্ট, সার্জন, অনকোলজিস্ট ও প্যাথলজিস্ট—সবাইকে একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।’
টার্গেটেড থেরাপি বা ইমিউনোথেরাপির মতো নতুন চিকিৎসাপদ্ধতি বাংলাদেশে প্রয়োগ কতটা সম্ভব? উপস্থাপক জানতে চাইলে স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, গত কয়েক বছরে ফুসফুস ক্যানসারের চিকিৎসায় বড় পরিবর্তন এসেছে। আগে কেবল কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশন ব্যবহৃত হতো। এখন যুক্ত হয়েছে ইমিউনোথেরাপি ও টার্গেটেড থেরাপি। এসব চিকিৎসা দেওয়ার আগে মলিকুলার টেস্টিং বা পিডি–এল টেস্ট করে দেখা হয় রোগীর টিউমারের জেনেটিক প্রোফাইল কেমন। যদি উপযুক্ত প্রোফাইল মেলে, তবে মুখে খাওয়ার ট্যাবলেট আকারে কার্যকর চিকিৎসা দেওয়া যায়।
স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘যদিও এসব পরীক্ষা ও ওষুধ তুলনামূলক ব্যয়বহুল, তবুও বাংলাদেশে এখন এগুলো পাওয়া যাচ্ছে এবং ফলও আশাব্যঞ্জক। আমি মনে করি, সরকারি ও বেসরকারি খাত একসঙ্গে কাজ করলে ক্যানসারের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব।’
চিকিৎসার পর ফুসফুস ক্যানসার রোগীর ফলোআপের গুরুত্ব ও এর উপযুক্ত সময় প্রসঙ্গে স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ফুসফুস ক্যানসার যেকোনো সময় আবার ফিরে আসতে পারে। তাই নিয়মিত ফলোআপ অত্যন্ত জরুরি। রোগী ভালো অনুভব করলেও প্রতি তিন মাস অন্তর পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা উচিত। বিশেষ করে চিকিৎসা–পরবর্তী প্রথম পাঁচ বছর পর্যন্ত। তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে, ফলোআপের মূল উদ্দেশ্য হলো রোগ ফিরে এসেছে কি না, তা দ্রুত ধরা। পাশাপাশি রোগীকে জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস ও ধূমপান থেকে বিরত থাকা নিশ্চিত করা।