
আন্দোলনরত প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের শাহবাগ অবরোধ থেকে যমুনা অভিমুখে যাত্রা ঘিরে তাঁদের ওপর পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ ও জলকামান ব্যবহার এবং লাঠিপেটার ঘটনা ঘটেছে। এতে অনেক শিক্ষার্থী আহত হন।
প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলনের ব্যানারে গতকাল বুধবার বেলা ১১টার দিকে পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে তাঁরা বেলা দেড়টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা অভিমুখে যাত্রা করেন। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে তাঁদের বাধা দেয় পুলিশ।
শিক্ষার্থীরা বলেন, পুলিশের হামলার পর তাঁরা বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে আবারও শাহবাগে জড়ো হন। রাত সাড়ে ১০টার পর শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড় ছেড়ে যেতে থাকেন।
এর আগে রাত ১০টার দিকে প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলনের সভাপতি মো. ওয়ালী উল্লাহ শাহবাগে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, তিন দফা দাবির কোনোটাই এখন পর্যন্ত পূরণ হয়নি। তাঁদের আন্দোলন চলমান থাকবে। আপাতত জনদুর্ভোগ হয়—এমন কর্মসূচিতে না যাওয়ার ঘোষণাও দেন তিনি।
প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক মো. সাকিবুল হক সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশের হামলায় ৫০ থেকে ৬০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।
ঢাকায় প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে এবং প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলনের তিন দফা দাবিতে চট্টগ্রাম শহরের ২ নম্বর গেট এলাকায় ও রাজশাহী শহরের তালাইমারী মোড়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন প্রকৌশল শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে বাংলাদেশ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র-শিক্ষক-পেশাজীবী সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে অংশ নেওয়া আন্দোলনকারীদের ওপর গতকাল লাঠিপেটা করে পুলিশ। দুপুরে রাজধানীর কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনের রাস্তায় এ ঘটনা ঘটে।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছে বুয়েট কর্তৃপক্ষ। গতকাল পুলিশের এ হামলার নিন্দা জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলা হয়, শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যা সমাধানের বদলে পুলিশের এ ধরনের হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বুয়েট প্রশাসন পুলিশের এ আচরণে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, মর্মাহত এবং এই হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। যথাযথ তদন্ত করে হামলার ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নেবে—বুয়েট প্রশাসন এমনটাই আশা করছে।
রাত ১০টার দিকে শাহবাগ মোড়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন। ঘটনা তদন্তে আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) কমিটি গঠন করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
উপস্থিত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘তোমরা আমার পরম স্নেহের। আমার ছেলের বয়সও তোমাদের বয়সের চেয়ে বেশি। তোমাদের এই কষ্ট আমাকেও কষ্ট দেয়।’
শাহবাগ ছাড়ার আগে গত রাতে আন্দোলনকারীরা জানান, চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে তাঁরা আজ বৃহস্পতিবার সারা দেশে সব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন অব ইঞ্জিনিয়ার্স’ কর্মসূচি পালন করবেন। তাঁরা কোনো ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নেবেন না। আজ বিকেলে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা এবং চলমান আন্দোলনে বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানাবেন তাঁরা। এ জন্য তাঁরা রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের কাউন্সিল হলে সংবাদ সম্মেলন করবেন বলে জানিয়েছেন।
প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো হলো নবম গ্রেড সহকারী প্রকৌশলী পদে কেবল পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ ও ন্যূনতম যোগ্যতা বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার করা; দশম গ্রেডে শুধু ডিপ্লোমাধারীরা আবেদন করতে পারেন, সেখানে যেন উচ্চ ডিগ্রিধারীরাও আবেদন করতে পারেন সেই ব্যবস্থা করা এবং শুধু বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং যাঁরা সম্পন্ন করবেন, তাঁরাই যেন প্রকৌশলী (ইঞ্জিনিয়ার) লিখতে পারেন, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া।
প্রকৌশল পেশায় বিএসসি ডিগ্রিধারী ও ডিপ্লোমাধারী ব্যক্তিদের পেশাগত দাবির যৌক্তিকতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য গতকালই একটি কমিটি গঠন করেছে সরকার।
প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলনের সভাপতি মো. ওয়ালী উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তিনটি দাবির বিষয়ে জানিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবং মন্ত্রণালয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু আশানুরূপ কোনো সাড়া বা উদ্যোগ দেখিনি। সে জন্য গতকাল থেকে আমরা কঠোর কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হই।’
চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতেও সড়ক অবরোধ।আজ দেশের সব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন অব ইঞ্জিনিয়ার্স’ কর্মসূচি ঘোষণা।
দাবি আদায়ে গতকাল ছিল শিক্ষার্থীদের ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি। প্রকৌশল অধিকার আন্দোলনের ব্যানারে বেলা ১১টার দিকে দ্বিতীয় দিনের মতো শাহবাগ অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাব্বির মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, জনদুর্ভোগ এড়াতে এত দিন তাঁরা রাতে কর্মসূচি পালন করতেন। তবে দাবি না মানায় গত মঙ্গলবার থেকে তাঁরা দিনে সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি দেন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা সড়ক ছাড়বেন না।
অবরোধে বুয়েট ছাড়াও ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের সরকারি-বেসরকারি প্রকৌশল এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন বলে জানান আন্দোলনকারীরা। সরেজমিনে দেখা যায়, বেলা ১১টার দিকে প্রথমে শাহবাগের মূল সড়কে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। এতে বন্ধ হয়ে যায় শাহবাগ ও আশপাশের সড়ক।
এ সময় শিক্ষার্থীরা তাঁদের দাবির পক্ষে বক্তব্য ও স্লোগান দিতে থাকেন। পরে দুপুর ১২টার কিছু পরে প্রকৌশল অধিকার আন্দোলনের নেতারা একটি সংবাদ ব্রিফিং করেন। সংগঠনের সভাপতি ওয়ালী উল্লাহ দাবি মেনে নিতে সরকারকে বেলা একটা পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেন।
শিক্ষার্থীরা বলেন এ সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে তাঁরা সচিবালয় ঘেরাও করবেন। আন্দোলনকারীদের এমন ঘোষণার পর শাহবাগ থেকে ফার্মগেটগামী সড়কে থাকা পুলিশ সদস্যদের গুলিস্তানগামী সড়কে অবস্থান নিতে দেখা যায়। বেলা দেড়টা পর্যন্ত শাহবাগেই অবস্থান করেন আন্দোলনকারীরা। সে সময় তাঁরা ‘অবৈধ ডিপ্লোমা কোটা অবসান চাই’, ‘কোটাপ্রথা ভেঙে দাও, মেধাবীদের অধিকার ফিরিয়ে দাও’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।
এরই মধ্যে সড়কের এক পাশে আন্দোলনকারীদের একাংশের সঙ্গে ডিএমপির রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলমকে আলোচনা করতে দেখা যায়। আলোচনা চলাকালে আন্দোলনের মূল মঞ্চ থেকে হঠাৎ ঘোষণা দিয়ে শিক্ষার্থীরা যমুনা অভিমুখে রওনা দেন। উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা তড়িঘড়ি মিছিলের সামনে গিয়ে তাঁদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে শিক্ষার্থীরা ততক্ষণে মিছিল নিয়ে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের মোড়ে পৌঁছে যান।
পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে আরও কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলে হঠাৎ সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে পুলিশ। বিকট শব্দে পিছু হটেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় পরপর বেশ কয়েকটি সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা।
কিছু সময় পর শিক্ষার্থীরা আবারও জড়ো হওয়ার চেষ্টা করলে কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। এতে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। কাঁদানে গ্যাসের প্রভাবে পথচারীরাও এদিক–সেদিক ছোটাছুটি শুরু করেন। এ সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিপেটা করে পুলিশ। ব্যবহার করা হয় জলকামান। এতে অনেক শিক্ষার্থী আহত হন।
আহত আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাইম মির্জার সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি বলেন, ‘মিছিলের সামনে ছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দের সঙ্গে কিছু একটা এসে আমার বাঁ পায়ে আঘাত করে।’
পরে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের মোড়ে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। সেখানে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি জুবায়ের আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, প্রকৌশল অধিকার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে আন্দোলনকারীদের সামনে এসে ক্ষমা চাইতে হবে এবং জবাবদিহি করতে হবে।
তিন দফা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত কমিটি প্রত্যাখ্যান করে জুবায়ের আহমেদ বলেন, অনতিবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিনিধিসহ প্রকৌশল অধিকার আন্দোলনের অংশীজনদের নিয়ে কমিটি সংস্কার করতে হবে। পেশ করা তিন দফা দাবি দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেনে নিয়ে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে।
এরপর বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের মোড় ছেড়ে আবারও শাহবাগ অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় যেতে বাধা দেওয়ার ঘটনায় পুলিশের আট সদস্য আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গতকাল রাতে মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা (পরিচালক) ফয়সল হাসানের দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। আহত পুলিশ সদস্যদের রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দুজনের অবস্থা গুরুতর।
এর আগে ডিএমপির রমনা বিভাগের ডিসি মাসুদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমাধান নিয়ে আলোচনা চলছিল। সচিবালয়ে তিনজন উপদেষ্টা এটা নিয়ে কাজ করছেন। শিক্ষার্থীদের বলা হয়েছিল শাহবাগে অবস্থান করতে, আধা ঘণ্টার ভেতরে তাঁদের সমস্যা সমাধান হবে। আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা শিক্ষার্থীরা তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজিও হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা হঠাৎ যমুনা অভিমুখে রওনা হন। একপর্যায়ে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে যমুনার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
ডিএমপি বলেছে, জনসাধারণের চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে সভা-সমাবেশ না করার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে এর আগে অনুরোধ করা হয়েছে। জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করে এমন কর্মসূচি থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে আবার অনুরোধ করা হলো।
শাহবাগ বন্ধ থাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয় আশপাশের সড়কে। এতে ভোগান্তিতে পড়েন যাতায়াতকারীরা। কারওয়ান বাজারে কথা হয় বেসরকারি চাকরিজীবী ঐশী সাহার সঙ্গে। বেলা দুইটার দিকে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আজিমপুর থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত তাঁকে হেঁটে আসতে হয়েছে। নীলক্ষেত থেকে একবার রিকশায় উঠলেও যানজটে দীর্ঘ সময় বসে থেকে আবারও হাঁটতে হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের ‘ট্রাফিক অ্যালার্ট’ গ্রুপে ফারাবি আহমেদ নামের একজন ব্যবহারকারী যানজটের একটি ভিডিও পোস্ট করে লেখেন, ‘জনদুর্ভোগ, লক্ষাধিক মানুষ গরমে ঘণ্টাখানেক রাস্তায় আটকে। কত মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কারও কি কিছু বলার আছে?’