
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় এসেছিল কঠিন পথে; অসংখ্য মানুষের ত্যাগে ও সংগ্রামে, নানা রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক উদ্যোগে। গুরুত্বপূর্ণ সেসব ঘটনা নিয়ে এ আয়োজন।
খুব ঘন ছিল আমবাগানটি। অনেকগুলো পুরোনো আমগাছ। দিনের আলো ঝলমল করছিল। আনন্দঘন উৎসবে যেন সমর্থন দিচ্ছিল প্রকৃতিও। অবিস্মরণীয় ঘটনার সাক্ষী হলো মেহেরপুর সদরের বৈদ্যনাথতলা গ্রামের এক অখ্যাত আমবাগান।
তারিখ ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল, শনিবার। সকাল ৯টার মধ্যে অতিথিরা আসতে শুরু করেছেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে কলকাতা থেকে ৫০–৬০টি গাড়িতে করে এসেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। আছেন শতাধিক দেশি–বিদেশি সাংবাদিকও। অনুষ্ঠান শুরু হলো বেলা ১১টায়। যুদ্ধের দিনে প্রবাসে প্রথম বাংলাদেশ সরকার ঘোষণার অনুষ্ঠান।
পুরো আয়োজন সম্পন্ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ‘বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটি’কে। দুই দিনের মধ্যেই প্রস্তুতি শেষ। গহিন গ্রামে কোথায় পাওয়া যাবে চেয়ার-টেবিল? গ্রামের এবাড়ি-ওবাড়ি থেকে অল্প কিছু জোগাড় করা হলো। খোলা মাঠের এক কোণে, গাছতলায় বানানো হলো ছোটখাটো সভামঞ্চ।
এই সরকারের সংস্থাপনসচিব মোহাম্মদ নুরুল কাদেরের লেখা একাত্তর আমার বইয়ে সেদিনের ছবিটা উঠে এসেছে এভাবে, ‘আশেপাশের বাড়ি থেকে চৌকি এবং বাঁশ আনা হলো। উন্মুক্ত মঞ্চ এটি। উপরে শামিয়ানা লাগানো সম্ভব হলো না। নিভৃত গ্রাম এলাকা। লোকবসতি শহরের তুলনায় অনেক কম। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে যে আয়োজন তাতেও মানুষ হলো প্রচুর। দেখতে দেখতে সভাস্থলে অন্তত হাজার পাঁচেক লোক জমায়েত হলো।’
সমবেত অতিথিদের মধ্যে সেদিন অন্য রকম উত্তেজনা। বিএসএফের তৎকালীন আইজি গোলক মজুমদার জায়গাটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন। তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ২০১৯ সালে বিবিসি বাংলাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমাদের লোকজনকে নিয়েও একটি নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলা হলো, যাতে শত্রু আক্রমণ করলে প্রতিরোধ করে সবাই নিরাপদে চলে যেতে পারেন।’
বাংলাদেশ সরকারের আত্মপ্রকাশ ও শপথের এই অনুষ্ঠানের কথা প্রথমে ভাবা হয়েছিল চুয়াডাঙ্গায়। কিন্তু পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বোমা হামলার পর পরিকল্পনা বদলাতে হয়। তাজউদ্দীন আহমদের পরামর্শক এবং বিশেষ সহায়ক আইনজীবী এম আমীর–উল ইসলাম মেহেরপুরের আমবাগানে শপথের স্থান নির্ধারণের প্রস্তাব করেন।
এক ঘণ্টার অনুষ্ঠান
মঞ্চে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্যরা, এম এ জি ওসমানী, আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের তৎকালীন হুইপ আবদুল মান্নান। আবদুল মান্নান অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন।
পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী শেখ মুজিবুর রহমান এই সরকারের রাষ্ট্রপতি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ঘোষণা করলেন, ‘সমবেত সাংবাদিক বন্ধুগণ এবং উপস্থিত জনসাধারণ, আপনাদের সামনে আমার মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রীকে সর্বপ্রথমে উপস্থিত করছি। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ।’ সবাই হাততালি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানালেন।
এরপর এল পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামানের নাম। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে ঘোষিত হলো এম এ জি ওসমানীর নাম।
অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন গণপরিষদের স্পিকার ইউসুফ আলী। সেটি লিখেছিলেন এম আমীর–উল ইসলাম। ইউসুফ আলীই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীদের শপথবাক্য পাঠ করালেন। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই স্থানের নাম ‘মুজিবনগর’ ঘোষণা করলেন।
মাত্র এক ঘণ্টার কম সময়ের একটা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শপথ নিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার, মুজিবনগর সরকার নামেই যা ইতিহাসে পরিচিত।
অনুষ্ঠানের পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার দিলেন ঝিনাইদহ মহকুমার পুলিশপ্রধান মাহবুব উদ্দিন আহমদ, সঙ্গে ছিলেন ১২ জন আনসার সদস্য।
দুপুরের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ। অনুষ্ঠান দীর্ঘ করার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। অনুষ্ঠানের পর কলকাতায় ফিরে গিয়ে সাংবাদিকেরা বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীন সরকার গঠন সম্পর্কে সংবাদ পাঠাতে শুরু করলেন।
মুজিবনগর সরকারের পূর্বাপর
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা নিরস্ত্র বাঙালিকে নির্বিচার গণহত্যা শুরু করল। গ্রেপ্তার হলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগের নেতারা তখন দিশাহারা। দুই দিন আত্মগোপনে থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পৌঁছালেন ভারত সীমান্তে। তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী এম আমীর-উল ইসলাম। কলকাতা হয়ে দিল্লি পৌঁছালেন তাঁরা।
১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রথম বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভারতের সহযোগিতা চাইলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন ছিল একটি আইনানুগ কাঠামো। ১০ এপ্রিল গঠন করা হলো ছয় সদস্যের বাংলাদেশ সরকার। একই দিন জারি হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র।
সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন ১০ এপ্রিল দেশবাসীর উদ্দেশে যে ভাষণ দেন, তা ওই দিন ও পরদিন প্রচার করা হয়। ভাষণে তিনি বলেন, স্বাধীনতাসংগ্রামের ডাক গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। হাজারো মানুষ যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআরসহ বিভিন্ন বাহিনীর বাঙালি যোদ্ধাদের ঘিরে দ্রুত প্রশিক্ষিত মুক্তিবাহিনী শত্রুর মোকাবিলায় প্রস্তুত হয়েছে।
স্বাধীনতার স্বপ্নের বাস্তব রূপ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে। ১৭ এপ্রিলের শপথের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তব রূপ পেতে শুরু করে। মুজিবনগর সরকার ও বর্তমান বাংলাদেশ গ্রন্থে ড. আকবর আলি খান লিখেছেন, ‘এ (মুজিবনগর) সরকারের সবচেয়ে মূল্যবান ভূমিকা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়জুড়ে আশার আলোকবর্তিকা প্রজ্বলিত রাখা। এ সরকারই দেশের আপামর মানুষের মনে এই বিশ্বাস জুগিয়েছে যে দেশে মুক্তির যে লড়াই চলছে, তার শেষে নতুন সূর্য উঠবে।’
মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অস্ত্র হাতে মুক্তিযোদ্ধারা জানলেন, তাঁদের পেছনে আছে একটি বৈধ সরকার। আরও আছে একটি জাতির ঐক্যবদ্ধ আকাঙ্ক্ষা আর সর্বোপরি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি।
তথ্যসূত্র:
১. ড. আকবর আলি খান, মুজিবনগর সরকার ও বর্তমান বাংলাদেশ
২. এম আমীর–উল ইসলাম, সাক্ষাৎকার, প্রথম আলো, ১৭ এপ্রিল, ২০২১
৩. তৌফিক–ই–ইলাহী চৌধুরী, বিবিসি, ২০১৯
৪. মোহাম্মদ নুরুল কাদের, একাত্তর আমার