বহুরূপী শিক্ষাবৈষম্যের বহুমাত্রিক আঘাত

২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের উৎস ছিল শিক্ষাবৈষম্যের অনেক ক্ষেত্রের মধ্যে একটি—শিক্ষার সমাপ্তিতে কর্মসংস্থানে বৈষম্য, যা কোটা আন্দোলন নামে পরিচিত। গণ–অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলো। রাষ্ট্র ও সমাজে রূপান্তরের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে, শিক্ষা রূপান্তরের উদ্যোগ এতে থাকবে—এ রকম আশ্বাস পাওয়া গেল অধ্যাপক ইউনূসের জাতির উদ্দেশে প্রথম গণভাষণে (২৫ আগস্ট ২০২৪)। কিন্তু প্রথমেই খটকা লাগল, যখন দেখা গেল রাজনীতি, অর্থনীতি ও অন্যান্য বিষয়ে সংস্কারের পরামর্শ দেওয়ার জন্য ১১টি উচ্চমর্যাদার কমিশন গঠন করা হলো, কিন্তু শিক্ষার জন্য কোনো কমিশন গঠন করা হলো না। 

শিক্ষার সুযোগ ও মানের বৈষম্য ঔপনিবেশিক কালেই শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের আধা ঔপনিবেশিক আমলেও শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তন হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে প্রণীত কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন থেকে শুরু করে ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে অন্তত মৌলিক শিক্ষার স্তর পর্যন্ত রাষ্ট্রের দায়িত্বে সর্বজনীন সুযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে—এই প্রতিশ্রুতি ছিল। সেই শিক্ষানীতি এখনো বলবৎ আছে। কিন্তু সব শিশুর জন্য গ্রহণযোগ্য মানসম্মত শিক্ষার অধিকার বা সুযোগ ২০২৫ সালেও প্রতিষ্ঠিত হয়নি; বরং শিক্ষাব্যবস্থাই সমাজের বিদ্যমান বহুমাত্রিক বৈষম্যকে আরও পাকাপোক্ত করার ইন্ধন জোগাচ্ছে।

২ 

শিক্ষার সংকটের বর্ণনা হিসেবে বৈষম্য কথাটি বহুল আলোচিত। শিক্ষার নানা বিদ্যমান সমস্যা, ব্যক্তি ও সমাজজীবনে এর প্রতিক্রিয়া বৈষম্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সমস্যার প্রকৃতি বোঝা ও সমাধানের পথ খোঁজা সহজ হতে পারে। সে জন্য শিক্ষার বৈষম্যের প্রকাশ ও স্বরূপ বোঝার চেষ্টা করতে হবে। 

যেকোনো শিক্ষাব্যবস্থার তিনটি উপাদানে বৈষম্যের প্রতিফলন ঘটে—শিক্ষার সুযোগ প্রাপ্তি বা অভিগম্যতা, শিক্ষার সংস্থান ও সেবার মান এবং শিক্ষা থেকে অর্জিত ফল। অভিগম্যতা সাধারণত শিক্ষার সংখ্যাগত বিস্তার দিয়ে বোঝানো হয়। এটাকেই শিক্ষার অগ্রগতির বয়ান হিসেবে সব ক্ষমতাসীন সরকার প্রচার করে। কিন্তু এখানে রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি। প্রথমত, গড় ভর্তির হার থেকে সমাজের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর চিত্র পাওয়া যায় না। দারিদ্র্য অভিগম্যতায় এক বড় বাধা; কারণ, সরকারি বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক হলেও আসলে প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়া বা কোচিং অপরিহার্য মনে করা হয়। ২০২২ সালে শিশুশ্রম জরিপে দেখা যায়, ৫-১৭ বছরের শিশুদের ৪ দশমিক ৪ শতাংশ বা প্রায় ১৮ লাখ শিশুশ্রমে নিযুক্ত ছিল, যা তাদের পড়ালেখা ব্যাহত করেছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত ছিল, যা তাদের জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও পরিবেশ এখনো শহরের বিদ্যালয় থেকে পিছিয়ে আছে

স্কুলিং উইদাউট লার্নিং অর্থাৎ বিদ্যালয়ে গিয়েও কিছু না শেখা আমাদের অনেক বিদ্যালয়ের এক প্রকৃষ্ট বর্ণনায় দাঁড়িয়ে গেছে। তা ছাড়া যে শিশুরা প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়, তাদের অন্তত ১৫ শতাংশ পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই ঝরে পড়ে। প্রাথমিক শিক্ষাকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করার পরেও এই অবস্থা বিদ্যমান। 

মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাকে সর্বজনীন করার দায়িত্ব সরকার এখনো নেয়নি। এই স্তরের নির্দিষ্ট বয়সের শিশুদের দুই-তৃতীয়াংশ বিদ্যালয়ে নাম লেখায়; কিন্তু তাদের এক-তৃতীয়াংশ ঝরে পড়ে। অর্থাৎ মাধ্যমিক স্তরে (১১ থেকে ১৫ বছর) শিশুদের অর্ধেকও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে না। শিক্ষার গুণগত মানের বৈষম্যের দৃশ্যমান প্রকাশ বিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো, যথেষ্টসংখ্যক যোগ্য শিক্ষকের উপস্থিতি এবং শিক্ষাসামগ্রী ও উপকরণের সংস্থানে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বিনিয়োগ হয়েছে। সরকারি বয়ানে অবকাঠামোর সংস্থান আর সমস্যা নয় বলে বর্ণিত হয়। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণিকক্ষ, সীমানাদেয়াল ও খেলার মাঠবিহীন অসংখ্য স্কুল, শিক্ষকের অভাবে দুই শ্রেণির একসঙ্গে পাঠদান বা একই শ্রেণিতে ৬০ থেকে ১০০ শিক্ষার্থী, লাইব্রেরি বা ল্যাবরেটরির অভাব—এসব এক সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখায়। সমাজের বিত্তবান ও সুযোগভোগী অংশের সদস্যরা শহরের বস্তি এলাকার ও প্রত্যন্ত গ্রামের এসব বিদ্যালয় এড়িয়ে চলেন।

৩ 

শিক্ষার মান ও পরিমাণগত সংস্থান আলাদা করে দেখা যায় না। স্কুলে হাজিরা দিয়ে শিক্ষার্থী যদি কিছু না শেখে, তবে এই অভিগম্যতা অর্থহীন। কিন্তু বাস্তবে সেই চিত্রই দেখা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের পর্যালোচনায় বলা হয়, বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৪ বছরের কিশোর-কিশোরীদের ৫১ শতাংশের বেশি একটি সাধারণ বাংলা অনুচ্ছেদ পড়তে পারে না। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি কিশোর-কিশোরী ব্যবহারিক সাক্ষরতা অর্জন করেনি। সরকারের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীর দক্ষতা যাচাই জরিপ থেকেও একই ধরনের চিত্র পাওয়া যায়। যে অর্ধেক পড়তে ও লিখতে পারে না, তারাই তো সমাজের সুযোগবঞ্চিত, দরিদ্র ও হতভাগ্য অংশ। 

কী কারণে এবং কীভাবে সুযোগবঞ্চিতরা বঞ্চনার শিকার হয়? যে পরিস্থিতি ও শর্তে শিক্ষাবৈষম্যের প্রকাশ ঘটে, সেগুলোকে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা যায়—অর্থনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ব্যক্তি-বৈশিষ্ট্যজনিত। 

আগেই বলা হয়েছে, দারিদ্র্যের জন্য গ্রহণযোগ্য মানের শিক্ষায় অভিগম্যতা নিশ্চিত হয়নি। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক নিরীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, ২৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। ২০২২ সালে তা ছিল ১৯ শতাংশ। এদের সন্তানের শিক্ষার জন্য ভালো স্কুলের ফি দেওয়ার বা প্রাইভেট শিক্ষকের জন্য ব্যয়ের সামর্থ্য থাকার কথা নয়। দারিদ্র্যরেখার ওপরে থাকলেও যেকোনো সময় অন্তত ২০ শতাংশ পরিবারের একজন বড় অসুস্থতায় পড়লে বা প্রধান উপার্জনকারী বেকার হয়ে গেলে তারা দারিদ্র্যরেখার নিচে চলে যায়।

হাওর, চর, পাহাড়ি অঞ্চল, উপকূল—এসব এলাকার পরিস্থিতি প্রতিকূল। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এসব এলাকায় প্রবলতর। বাংলাদেশের অন্তত এক-চতুর্থাংশ লোক এসব এলাকায় বাস করে, যারা বিভিন্নভাবে শিক্ষাবৈষম্যে ভোগে। 

সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈষম্যের ক্ষেত্র হচ্ছে ভাষা, ধর্ম, নৃতাত্ত্বিক ভিন্নতা ইত্যাদি সামাজিক বৈশিষ্ট্য এবং এসব কারণে মূল জনগোষ্ঠীর বাইরে থাকা মানুষ। তাদের জন্য শিক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা না থাকলে তারা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। সমগ্র জনসংখ্যার অনুপাতে এই সংখ্যা কম হলেও গণনায় সংখ্যাটি মোটেই ছোট নয়। 

ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যজনিত কারণ হচ্ছে প্রয়োজনীয় বিশেষ সেবার ব্যবস্থা না থাকা। বিভিন্নভাবে প্রতিবন্ধীরা এই বৈষম্যের শিকার। এ ধরনের বৈষম্যের বড় এক ক্ষেত্র লিঙ্গপরিচয়জনিত। ট্রান্সজেন্ডার, অনির্দিষ্ট লিঙ্গ বা হিজড়া হিসেবে পরিচিতরা সামাজিক ও শিক্ষাগত বৈষম্যের শিকার। ডিজিটাল প্রযুক্তির কারণে এখন যুক্ত হয়েছে নতুন ধরনের বৈষম্য। ডিজিটাল প্রযুক্তি শিক্ষার সুযোগ ও মান বৃদ্ধির হাতিয়ার বলে প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বিত্তবান ও বিশেষ মেধাবীরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে এগিয়ে যাচ্ছে তরুণদের বৃহত্তর অংশকে পেছনে ফেলে।

৪ 

শিক্ষার বৈষম্যের ধরন ও এর বহুমুখী প্রকাশ নতুন প্রজন্মের এক বড় অংশের ভবিষ্যৎ বিপন্ন করছে এবং সমাজের সামষ্টিক আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষিত বেকার, হতাশাগ্রস্ত তরুণদের মাদকাসক্তি ও অপরাধে জড়িয়ে পড়া, ধর্মীয় বা রাজনৈতিক চরমপন্থার প্রতি আকর্ষণ, মানসিক বৈকল্যের শিকার হওয়া—এসব শিক্ষাবৈষম্যের বিষাক্ত ফল। 

সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে এই যে তরুণদের এক বড় অংশ সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়ের সমাজ গঠনে অংশ নিতে পারছে না; দেশ ও সমাজের রূপান্তরে অবদান রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। রাজনৈতিক শ্রেণি, ক্ষমতাবান আমলাতন্ত্র ও সুযোগভোগী ব্যবসা-বাণিজ্যের কর্ণধারেরা কি মৌলিক পরিবর্তনে আগ্রহী? 

শিক্ষার ভবিষ্যৎবিষয়ক ইউনেসকোর আন্তর্জাতিক কমিশনের প্রস্তাব হচ্ছে, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও সচেতন নাগরিককে সম্মিলিতভাবে এক লক্ষ্যে অনুপ্রাণিত হতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালকদের শিক্ষার রূপান্তরের উদ্দেশ্যে একটি সামাজিক চুক্তিতে আবদ্ধ করতে হবে। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান কি আংশিকভাবে হলেও সেই ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে? নাকি আমাদের আরেক অভ্যুত্থানের প্রতীক্ষায় থাকতে হবে? 

*মতামত লেখকের নিজস্ব, প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান নয়।

মনজুর আহমদ

শিক্ষাবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়