
সকাল শুরু হতে না–হতেই কিশোরী পার্বতী মণ্ডলের দিনের কাজ শুরু হয়। তবে বই-খাতার ব্যাগ নয়, সপ্তাহের অধিকাংশ দিনই হাতে তুলে নিতে হয় পানির কলসি। স্কুলে যাওয়ার বদলে তাকে বাড়ি থেকে ২০–২৫ মিনিট হাঁটতে হয় খাওয়ার পানির খোঁজে। যে বয়সে তার ক্লাসে বসে পড়াশোনা করার কথা, সেই বয়সেই সংসারের প্রয়োজন তাকে প্রায় সময়ই টেনে নিয়ে যায় ফুলতলায়, পানি আনতে।
পানি না আনলে চলে না সংসার, আর পানি আনতে গেলে থেমে যায় স্কুলে যাওয়া। সাতক্ষীরা অঞ্চলের শুধু পার্বতী নয়, অসংখ্য কিশোরীর দিন শুরু হয় এই একই দুশ্চিন্তা নিয়ে। খাওয়ার পানির সংকট তাদের পড়াশোনাকে ঠেলে দিচ্ছে পেছনে। সপ্তাহে দুই–তিন দিন স্কুল কামাই হয়ে উঠছে যেন অনিবার্য বাস্তবতা।
পার্বতীর বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের পশ্চিম ধানখালী গ্রামে। এ গ্রামের সুন্দরবন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী সে। বাবা ঠাকুরদাস মণ্ডল ও মা সুখদেবী মণ্ডল দিনমজুর। দুই বোন ও এক ভাইয়ের সংসার। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে; আর ভাই চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। সংসারের ভার সামলাতে গিয়ে মায়ের একার পক্ষে সব কাজ করা সম্ভব হয় না। তাই খাওয়ার পানি সংগ্রহের দায়িত্ব প্রায় পুরোপুরি এসে পড়ে পার্বতীর কাঁধে।
গত ২২ সেপ্টেম্বর স্কুলে গিয়ে পার্বতীর সঙ্গে দেখা হয়। সে জানায়, পানি আনা ও ঘরের কাজের কারণে সপ্তাহে দুই–তিন দিন তার স্কুলে যাওয়া হয় না। পানি আনতে গেলে অনেক সময় নষ্ট হয়, পড়াশোনার ক্ষতি হয়। অনুপস্থিতির দিনগুলোর ক্লাসের পড়া কীভাবে পায়, জানতে চাইলে সে বলে, ‘বান্ধবীর কাছ থেকে পড়া নিয়ে নিই।’
শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জ ও বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নে পার্বতীর মতো অনেক কিশোরীর সঙ্গে দেখা হয়েছে, যারা মূলত পানি সংগ্রহ ও ঘরের কাজের কারণে সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। ওই কিশোরীদের মা–বাবা ও শিক্ষকেরাও এই প্রতিবেদককে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
পানিসংকটে স্কুল ফাঁকা
ভাঙা রাস্তা পেরিয়ে বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের আড়পাংগাশিয়া গ্রামে গিয়ে কথা হয় আড়পাংগাশিয়া প্রিয়নাথ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দেবাশীষ জোয়ার্দারের সঙ্গে।
দেবাশীষ জোয়ার্দার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ এলাকার পানির সংকটের কথা বলে শেষ করা যাবে না। সব পরিবার টাকা দিয়ে পানি কিনতে পারে না। হেঁটে দূর থেকে পানি আনতে হয়। এই বাস্তবতায় স্কুলে উপস্থিতি বাড়াতে কাউকে জোর করা যায় না। এরপরও সবাইকে স্কুলে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করি।’
শ্যামনগর বঙ্গোপসাগর, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকা ও সুন্দরবনের কাছে। উপজেলায় ১১টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে এলাকাগুলো বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলা ও ২০২০ সালের আম্পানের জলোচ্ছ্বাসে মিঠাপানির উৎসগুলো লোনাপানিতে ডুবে যায়। ভাঙে ৫৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। এর পর থেকে সংকট আরও তীব্র হয়।
বিদ্যালয়টির অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী প্রিয়া রানী মণ্ডল প্রায় দিনই অনুপস্থিত থাকে। তার বাবা পলাশ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, সপ্তাহে ৩০ লিটার পানি ভ্যান থেকে কিনলেও সংসারের সব কাজ তাতে চলে না। তাঁর স্ত্রী অসুস্থ। বড় মেয়ে হোস্টেলে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। আর ছেলের বয়স মাত্র তিন বছর। তাই প্রিয়াকে দিনে দুই বেলা পানি আনাসহ ঘরের কাজ সামলাতে হয়। এ কারণে অনেক সময় সে স্কুলে যেতে পারে না।
প্রিয়া রানী জানায়, সে প্রতিদিন বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার হেঁটে পানি আনে। স্কুলে এত অনুপস্থিত থাকলে শিক্ষকেরা কিছু বলেন কি না, জানতে চাইলে সে বলল, ‘বলে তো! ছুটির আবেদনপত্র নিয়ে যাই।’ আবেদনপত্রে কী লেখো? এ প্রশ্নের ঝটপট উত্তর দেয়, ‘লিখি জল আনতে গেছিলাম।’
চারদিকে পানি, তবু পানির হাহাকার
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত শ্যামনগর উপজেলাটিতেও চারপাশে জলাশয়ের অভাব নেই, অভাব হলো খাওয়ার উপযোগী নিরাপদ পানির। এই অঞ্চলে এলে স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের সেই লাইন, ‘ওয়াটার, ওয়াটার, এভরিহোয়্যার, নর অ্যানি ড্রপ টু ড্রিংক’ (চারদিকে পানি আর পানি; কিন্তু এক ফোঁটাও পান করার মতো নয়) যেন বাস্তব হয়ে ওঠে।
শ্যামনগর বঙ্গোপসাগর, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদী অববাহিকা ও সুন্দরবনের কাছে। উপজেলায় ১১টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে এলাকাগুলো বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলা ও ২০২০ সালের আম্পানে জলোচ্ছ্বাসে মিঠাপানির উৎসগুলো লোনাপানিতে ডুবে যায়। ভাঙে ৫৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। এর পর থেকে সংকট আরও তীব্র হয়।
এ এলাকার পানিসংকটের কথা বলে শেষ করা যাবে না। সব পরিবার টাকা দিয়ে পানি কিনতে পারে না। হেঁটে দূর থেকে পানি আনতে হয়। এই বাস্তবতায় স্কুলে উপস্থিতি বাড়াতে কাউকে জোর করা যায় না। এরপরও সবাইকে স্কুলে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করি।দেবাশীষ জোয়ার্দার, আড়পাঙ্গাশিয়া প্রিয়নাথ মাধ্যমিক স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক
শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এই এলাকায় বরাবরই খাওয়ার পানির সংকট ছিল। আইলার পর থেকে শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার পুরোটা এবং কালীগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের পানি খুব লবণাক্ত হয়ে যায়। এর মধ্যে শ্যামনগর উপজেলার পৌরসভা, ভুরুলিয়া, বুড়িগোয়ালিনী, ঈশ্বরীপুর ও নূরনগর ইউনিয়নে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর না থাকা ও লবণাক্ততার কারণে গভীর নলকূপও বসানো যায় না।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ট্যাংক, পন্ড স্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুকুরের পানি শোধন ও পানি বিশুদ্ধকরণে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রিভার্স ওসমোসিস (আরও) প্ল্যান্ট—এই তিন উৎস থেকে খাওয়ার পানি নিতে হয় বাসিন্দাদের।
নারী ও কিশোরীদের ওপর চাপ
শ্যামনগর উপজেলায় ৪০ বছর ধরে কাজ করছে নওয়াবেঁকী গণমুখী ফাউন্ডেশন। এই সংস্থার নির্বাহী পরিচালক লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শুধু পানি আনতেই এলাকার নারী, পুরুষ ও শিশুদের প্রতিদিন অনেক সময় ব্যয় হয়। এ কারণে স্কুল-কলেজের ক্লাস মিস হচ্ছে।
বাসার কাজ, দিনমজুরের কাজ করে রান্নাবান্নার পানি সংগ্রহের কাজ সব সময় কুলিয়ে উঠতে পারি না। তখন ওরে (পার্বতী) বলি, মা আজ স্কুলে যাইয়ো না। জল আইনে দাও। জল ছাড়া তো বাঁচা যায় না বোঝেনই।সুখদেবী মণ্ডল, পার্বতী মণ্ডলের মা
নওয়াবেঁকী গণমুখী ফাউন্ডেশন উপজেলায় ১১টি আরও প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে। একটি প্ল্যান্ট থেকে ৪০০ পরিবার পানি নিতে পারে। এ ছাড়া উপজেলায় ৪০টি পানির ট্যাংক ও একটি প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স নামের একটি সংস্থা। সংস্থাটির জেলা কর্মসূচি ব্যবস্থাপক শরীফুল ইসলাম বলেন, খাওয়ার পানি সংগ্রহের চাপ মূলত নারী ও কিশোরীদের ওপর বেশি। দূর থেকে পানি আনতে গিয়ে অনেক সময় কিশোরীরা মৌখিকভাবে যৌন হয়রানির শিকারও হয়।
কিশোরীদের অভিভাবকেরা বলেন, আরও প্ল্যান্ট থেকে প্রতি লিটার পানি ৩০ থেকে ৫০ পয়সা করে কিনতে হয়। এই পানি আনতে অনেকে নিজে যান না। অর্থের বিনিময়ে কিছু প্রতিষ্ঠান ভ্যানে করে বাড়ি বাড়ি পানি পৌঁছে দেয়। এতে প্রতি লিটার পানির দাম পড়ে এক টাকা। দরিদ্র অনেক অভিভাবক পানির জন্য কোনো অর্থ ব্যয় করতে পারেন না।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বিজ্ঞানবিষয়ক অনলাইন সাময়িকী এমডিপিআই-এ ২০২৩ সালের ১২ জুলাই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার পানির সংকট নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ‘দ্য চেঞ্জিং ক্লাইমেট ইজ চেঞ্জিং ড্রিংকিং ওয়াটার, ইমপ্যাক্টিং হেলথ: আ কেস ইন দ্য সাউদার্ন কোস্টাল রিজিয়ন অব বাংলাদেশ (এসডব্লিউসিআরবি)’ শিরোনামের ওই গবেষণা করা হয় শ্যামনগর উপজেলায়।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দরিদ্র পরিবারগুলো সাধারণত পুকুর বা নদীর পানি পান করতে বাধ্য হন। রান্না ও গৃহস্থালির কাজে পুকুর ও বৃষ্টির পানিই প্রধান উৎস। গ্রীষ্মকালে পানির সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ট্যাংক ও পিএসএফ পর্যাপ্ত নয়। পুরুষ, নারী ও শিশু—সবাইকে প্রতিদিন দূরদূরান্তে হাঁটতে হয় পানি আনতে। প্রতিবেদনে অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া এক ছাত্রীর কথা উল্লেখ করে বলা হয়, সে প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে ঈশ্বরীপুর গ্রাম থেকে দেবালয় গ্রামের চার কিলোমিটার দূরত্বে গিয়ে পানি আনে। এতে তার পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দরিদ্র পরিবারগুলো সাধারণত পুকুর বা নদীর পানি পান করতে বাধ্য হয়। রান্না ও গৃহস্থালির কাজে পুকুর ও বৃষ্টির পানিই প্রধান উৎস। গ্রীষ্মকালে পানির সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে ট্যাংক ও পিএসএফ পর্যাপ্ত নয়। পুরুষ, নারী ও শিশু সবাইকে প্রতিদিন দূরদূরান্তে হাঁটতে হয় পানি আনতে।
প্রতিবেদনে অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া এক ছাত্রীর কথা উল্লেখ করে বলা হয়, সে প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে ঈশ্বরীপুর গ্রাম থেকে দেবালয় গ্রামের চার কিলোমিটার দূরত্বে গিয়ে পানি আনে। এতে তার পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তার মা বলেন, তিনি গৃহস্থালির কাজে ব্যস্ত, আর বাবা বাইরে কাজ করেন, তাই মেয়েকেই পানি আনতে হয়।
‘মা আজ স্কুলে যাইয়ো না, জল আইনে দাও’
পার্বতীর মা সুখদেবী মণ্ডল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাসার কাজ, দিনমজুরের কাজ করে রান্নাবান্নার পানি সংগ্রহের কাজ সব সময় কুলিয়ে উঠতে পারি না। তখন ওরে (পার্বতী) বলি, মা আজ স্কুলে যাইয়ো না, জল আইনে দাও। জল ছাড়া তো বাঁচা যায় না বোঝেনই।’
সুখদেবী মণ্ডল আরও বলেন, তিনি যখন পানি আনতে যান, তখন ১০–১২ লিটারের পানির কলসি নিয়ে যান। পার্বতী ছোট হওয়ায় তাকে ছোট কলসি দিয়ে পাঠান।
এই স্কুলের ছাত্রীদের অধিকাংশই জেলে বা বাওয়ালি পরিবারের। দূর থেকে বিনা মূল্যের খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে হয় মেয়েদের। অনেকের মা–বাবা দুজনই শ্রমজীবী। তাই পানি সংগ্রহের পাশাপাশি ঘরের কাজও করতে হয় কিশোরীদের। এসব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক মেয়েকেই সপ্তাহে দু-একদিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকতে হয়।রণজিৎ মণ্ডল, সুন্দরবন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক
ফুলতলায় পিএসএফ থেকে শুধু খাওয়ার পানি আনে পার্বতীর পরিবার। রান্না, হাঁড়ি-পাতিল ধোয়া, গোসলসহ বাকি কাজ সারে বাড়ির কাছের পুকুরের পানি দিয়ে। বর্ষার সময় বাড়ির পুকুর পানিতে থই থই করে। পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ কমে আসে। তখন সেটিই খাওয়ার পানি হিসেবে ব্যবহার করে।
পার্বতীর সহপাঠী বনশ্রী মণ্ডল। বাবা হরিদাস মণ্ডল ও উমা রানী মণ্ডলের একমাত্র সন্তান বনশ্রী জানিয়েছে, বাসা থেকে প্রায় আধা ঘণ্টা দূরত্বে হেঁটে গিয়ে প্রতিদিন দুই বেলা খাওয়ার পানি আনতে হয় তাকে। এ কারণে সপ্তাহে কমপক্ষে দুই দিন সে স্কুলে যেতে পারে না।
একই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী অঞ্জনা গাইনের বাবা পরিতোষ গাইন অসুস্থ। মা পূর্ণিমা গাইন কৃষিশ্রমিক। অঞ্জনার বড় বোনের গত বছর বাল্যবিবাহ হয়েছে। ছোট ভাই প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। এ কারণে তার ওপর পরিবারের পানি সংগ্রহের ভার পড়েছে।
অঞ্জনা বলে, সে প্রতিদিন ৩০ মিনিট হেঁটে কদমতলা খালের ওপরের সেতু পেরিয়ে পানি আনতে যায়। দিনে একবার পানি আনতে গেলে স্কুল কামাই হয় না। তবে যেদিন দিনে দুইবার পানি আনতে হয়, সেদিন স্কুল কামাই হয়।
ওই এলাকার সুন্দরবন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রণজিৎ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, পরিবারগুলো পড়াশোনাকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে না। অভিভাবকদের বুঝিয়ে বলেও এসব কাজের ভার কমানো ও স্কুলে উপস্থিতি বাড়ানো যাচ্ছে না।
অবশ্য কিছুটা সচ্ছল পরিবারের কিশোরীরা এই পানি সংগ্রহের চাপ থেকে মুক্ত। একই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মরিয়ম আক্তার ও রাফিয়া আক্তার জানায়, তাদের বাসায় বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ট্যাংক আছে। এ কারণে তাদের পানি আনতে যেতে হয় না।
জাকিয়া জামান নামের আরেকজন ছাত্রী জানায়, তাদের বাড়িতে ভ্যানে করে পানি পৌঁছে দিয়ে যায়।
সমাধানের পথ কী
বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় পানি সংগ্রহ ও কিশোরীদের স্কুলে অনুপস্থিতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো গবেষণা পাওয়া যায়নি।
তবে ডাচ প্রকাশনা সংস্থা এলসিভিয়ারের ওয়েব সাময়িকী সায়েন্স ডিরেক্টে ২০২৩ সালে ‘ড্রিঙ্কিং ওয়াটার অ্যান্ড দ্য ইমপ্লিকেশন্স ফর জেন্ডার ইকুইটি অ্যান্ড এম্পাওয়ারমেন্ট: আ সিস্টেমেটিক রিভিউ অব কোয়ালিটেটিভ অ্যান্ড কোয়ান্টিটেটিভ এভিডেন্স (খাওয়ার পানি এবং লিঙ্গভিত্তিক সমতা ও ক্ষমতায়নের প্রভাব: গুণগত ও পরিমাণগত প্রমাণের একটি পদ্ধতিগত পর্যালোচনা)’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকায় খাওয়ার পানি সংগ্রহের কারণে কিশোরীদের স্কুলে অনুপস্থিতির তথ্য পাওয়া যায়।
এতে ১৯৮০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে প্রকাশিত বিভিন্ন দেশের ১ হাজার ২৮০টি গবেষণা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা হয়। এর মধ্যে ৮৮টি প্রতিবেদনে খাওয়ার পানির প্রবেশগম্যতা, খাওয়ার পানির গুণগত মান ও স্কুলের শিশুদের বিষয়টি তুলে আনা হয়।
ওই প্রতিবেদনে ভারতের ৫০০ পরিবারের ওপর গবেষণার উদাহরণ তুলে বলা হয়েছে, পানির সংকটের সময় পানি আনতে গিয়ে মাসে পাঁচ দিনের স্কুলে বেশি অনুপস্থিত থাকে মেয়েরা। ইথিওপিয়ার ১৯৭টি পরিবারের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, সেখানে নারী ও কিশোরীরা প্রতিদিন পানি সংগ্রহ করতে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন। বছরে ৩৭ থেকে ৫১ দিন শিক্ষায় ক্ষতি হয়।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, শুধু পানি সংগ্রহ নয়, পাশাপাশি গৃহস্থালির কাজে কিশোরীদের সম্পৃক্ত করার কারণেও স্কুলে অনুপস্থিত থাকার ঘটনা ঘটতে পারে।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে উপজেলার ৭০ শতাংশ এলাকা খাওয়ার পানির আওতায় আনা গেছে। তবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর না থাকায় ও পানি ব্যবস্থাপনায় এলাকাবাসীর দুর্বলতার কারণে এই এলাকার পানিসংকট পুরোপুরি কখনো যাবে না। একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অপর দিকে কাঁকড়া ও চিংড়ি চাষের জন্য জলাশয়গুলো লবণাক্ত করার প্রক্রিয়া খাওয়ার পানির উৎসের জন্য ক্ষতিকর। খাসপুকুর খনন, চিংড়ি ও কাঁকড়ার ঘের নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ করার মাধ্যমে সমস্যার তীব্রতা কমানো যাবে।
সাবেক তত্ত্ববধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, পানি সংগ্রহ, জ্বালানি সংগ্রহ, গৃহস্থালির কাজ, মাসিক—এমন যেসব কারণে স্কুলে মেয়েরা অনুপস্থিত থাকে, সে কারণগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। কোন এলাকায় কী কারণে অনুপস্থিতি বেশি হচ্ছে, সেসব এলাকার আর্থসামাজিক পরিস্থিতি কী, সেসব বিবেচনায় নিয়ে লক্ষ্যভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত তুলে আনতে হবে। সেই তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করলে সংকট কমানো সম্ভব হবে।
প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সাতক্ষীরায় প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক কল্যাণ ব্যানার্জি