মেট্রোরেল স্টেশনে আনিসুল হক
মেট্রোরেল স্টেশনে আনিসুল হক

মেট্রোরেলে চড়ে এলাম, চড়ার আগে ১০টি তথ্য জেনে রাখা ভালো

জানুয়ারি ৬, ২০২৩। পৌষের কুয়াশামোড়া শীতে কাঁপা সকাল। ঢাকার আগারগাঁও আইডিবি ভবনের সামনে মেট্রোরেল স্টেশনের দক্ষিণ প্রান্ত। মানুষের দীর্ঘ লাইন দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। শত শত নারী, পুরুষ ও শিশু শীতের রঙিন জামাকাপড় গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন। দীর্ঘ লাইন দেখে প্রথমে আঁতকে উঠলাম। ঘড়িতে ১০টা ২০। লাইনের মাথায় পৌঁছাতে বুঝি ১২টা পেরিয়ে যায়। কিন্তু অভিজ্ঞ যাত্রীরা অভয় দিলেন, হাজার যাত্রী এক ট্রেনে উঠতে পারে। ১০ মিনিট পর ট্রেন আছে। কাজেই লাইনের অপেক্ষা মোটেও দীর্ঘ নয়।

স্টেশন ঝকঝকে। নতুন ট্রেন ঝলমলে। সবুজ আসনগুলো দেখে আবেগাপ্লুত হয়েছি। বসে পড়ে ট্রেনের এদিক–ওদিক তাকাচ্ছি। চোখ ভিজে আসতে শুরু করেছে।

সত্যি, অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা খোলা আকাশের নিচ থেকে স্টেশনের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। এস্কেলেটরে দোতলায় উঠলে টিকিট কাউন্টার। দুভাবে টিকিট বিক্রি হচ্ছে। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে আর টিকিট বিক্রেতার সাহায্যে। যাত্রীদের সহযোগিতা করতে, পথ দেখাতে কাজ করছেন তরুণ স্কাউটরা। তাঁরা বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। হাসিখুশি, সাহায্য করতে উদগ্রীব এবং সদাপ্রস্তুত।

আমরা আগারগাঁও থেকে উত্তরা উত্তর স্টেশনে যাব। একটাই গন্তব্য। টিকিটের দাম ৬০ টাকা। আমার দুটি টিকিট লাগবে।  টাচস্ক্রিনে গন্তব্যে আঙুল ছোঁয়ালাম, ওয়ানওয়ে, দুটো টিকিট, ১২০, ঠিক আছে—এই ঘরগুলো স্পর্শ করলে ১২০ টাকা বিল দেখাল। ১০০ টাকা আর ২০ টাকার নোট যন্ত্রে ঢোকালাম। টিকিট একটা একটা করে বেরিয়ে এলো। এক টিকিটের পর আরেকটি টিকিট আসতে একটু সময় নেয়।

টিকিট হাতে পেয়ে গেটে টিকিট ধরতেই স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে গেল। ভেতরে গেলাম। আরেক ধাপ ওপরে উঠে ট্রেনের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছালাম। ইলেকট্রনিক পর্দায় দেখানো হচ্ছে কোন গন্তব্যের ট্রেন কোন প্ল্যাটফর্মে আসবে। একটাই গন্তব্য আর একটাই আরম্ভস্থল হওয়ায় এখনো দিককানা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

আগারগাঁও থেকে উত্তরা উত্তর স্টেশন পর্যন্ত টিকিটের দাম ৬০ টাকা

স্কাউটরা সবাইকে অনুরোধ করছেন, যেন রেললাইনের সমান্তরালে আঁকা হলুদ দাগের বাইরে সবাই দাঁড়ান। কোথায় কোথায় ট্রেনের দরজা, তা চিহ্নিত করা আছে। আমরা ভিড় কম দেখে একটা দরজার চিহ্ন আঁকা জায়গায় দাঁড়ালাম। ট্রেন চলে এলো। ফাঁকা ট্রেন। দরজা খুললে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

স্টেশন ঝকঝকে। নতুন ট্রেন ঝলমলে। সবুজ আসনগুলো দেখে আবেগাপ্লুত হয়েছি। বসে পড়ে ট্রেনের এদিক–ওদিক তাকাচ্ছি। চোখ ভিজে আসতে শুরু করেছে।

আমার ঢাকা শহরে এমন একটা সুন্দর দৃশ্য আমি দেখছি, এমন একটা যাত্রায় আমি অংশ নিচ্ছি, জানি লন্ডনে টিউব হয়েছে ১৮৬৩ সালে, নিউইয়র্কে সাবওয়ে হয়েছে ১৯০৪ সালে, সে জন্যই বোধহয় বেশি করে আজকের দিনটাকে বিশেষ বলে মনে হচ্ছে। ১৬০ বছর পরে যাত্রা শুরু করলাম, কিন্তু ধরে ফেলব একদিন, উন্নত দেশগুলোকে।

ট্রেন চলছে। চট্টগ্রাম থেকে আসা চিকিৎসক ফিজিসিস্ট দুই বোন, মাদ্রাসার ওয়ানের ছাত্র আবু মুসা, ঠাকুরগাঁও থেকে আসা যুবক, কুমিল্লা থেকে ঢাকায় নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করতে থাকা তরুণ—আমরা সবাই এক ট্রেনের যাত্রী। সবার এককথা, ‘ভীষণ এক্সাইটেড লাগছে।’

ট্রেন চলছে। চট্টগ্রাম থেকে আসা চিকিৎসক ফিজিসিস্ট দুই বোন, মাদ্রাসার ওয়ানের ছাত্র আবু মুসা, ঠাকুরগাঁও থেকে আসা যুবক, কুমিল্লা থেকে ঢাকায় নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করতে থাকা তরুণ—আমরা সবাই এক ট্রেনের যাত্রী। সবার এককথা, ‘ভীষণ এক্সাইটেড লাগছে।’ বেশির ভাগ যাত্রীই এসেছেন শখে, প্রথম মেট্রোতে চড়ার অভিজ্ঞতা নিতে। প্রয়োজনের যাত্রী নেই বললেই চলে। সবাই আগারগাঁও থেকে উত্তরা বা উত্তরা থেকে আগারগাঁও আসা-যাওয়া করছেন আনন্দের জন্য। তবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অফিস করতে আসছেন, এমন মানুষেরা বেজায় খুশি। তাঁদের সময় বাঁচছে, খরচও বাঁচছে প্রচুর।

ট্রেনের ভেতরে যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ

ট্রেন মিরপুর হয়ে ক্যান্টনমেন্ট পাশে রেখে, নানা স্টেশন দ্রুত পার হয়ে বিরতিহীনভাবে উত্তরা উত্তর স্টেশনে এসে পৌঁছাল। আমরা নামলাম। বেরোনোর গেটে টিকিট ঢোকাতে হলো গেটের হাঁ-মুখে। টিকিটটা নিয়ে নিল, আর ফেরত দিল না। বের হয়ে স্টেশন চত্বরে আমরা দেখা পেলাম ঢাকা মাস র‍্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের অতিরিক্ত পরিচালক প্রকৌশলী আবদুল মতিন চৌধুরী আর মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) মোহাম্মদ ইখতিয়ার হোসেনের।

মতিন চৌধুরী ও ইখতিয়ার হোসেনের কাছ থেকে জানলাম, মেট্রো এ বছরের শেষ নাগাদ চলা শুরু করবে মতিঝিল পর্যন্ত। তখন প্রতি ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী চলাচল করবেন। দিনে ১৬ ঘণ্টা ট্রেন চললে প্রায় ১০ লাখ মানুষ এই ট্রেনে আসা-যাওয়া করবেন। ঢাকার রাজপথের ওপরে চাপ কমবে। বায়ুদূষণ কমে যাবে। লাখ লাখ শ্রমঘণ্টা বেঁচে যাবে।

টিকিট কেনার জন্য ১০০ টাকা বা এর চেয়ে ছোট নোট নেওয়া ভালো। ২০০ বা ৫০০ টাকা মেশিন চেনে না। তবে মেশিনে না কিনে বিক্রেতার কাউন্টার থেকেও টিকিট কেনা যায়।

মহাব্যবস্থাপক বিস্তারিতভাবে জানালেন, ১ জানুয়ারির ফানুসবিভ্রাটের ঘটনা। যে পরিষ্কারকারী ট্রেন রোজ সকালে মহড়া দিতে বের হয়, ১ জানুয়ারি তা বেরিয়ে থেমে যেতে বাধ্য হয়। অসংখ্য ফানুস পড়ে আছে ইলেকট্রিক লাইনে, ট্রেনের লাইনে। সেসব পরিষ্কার করতে দুই ঘণ্টা লেগে যায়। তিনি অনুরোধ করলেন, ঢাকা ও আশপাশে কেউ যেন ফানুস না ওড়ান।

এবার আমাদের ফেরার পালা।  উত্তরা স্টেশনের টিকিট কাউন্টারে দাঁড়ালাম। এবার যন্ত্রে নয়, মানুষের হাত থেকে টিকিট নিলাম। চলন্ত সিঁড়িতে আরেক ধাপ উঠলে প্ল্যাটফর্ম। বিপরীত প্ল্যাটফর্মে ট্রেন এলো আগারগাঁও থেকে। দুই মিনিট পরে আমাদের প্ল্যাটফর্মে এলো আগারগাঁওগামী ট্রেন। উঠে পড়লাম। সত্যি সত্যি ১০ মিনিটে এসে গেলাম আগারগাঁও। স্টেশন থেকে বেরোনোর পথটা আইডিবি ভবনের উত্তর পাশে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে দেখি, ঘড়িতে বাজে ১১টা ৫০।

উত্তরা থেকে আগারগাঁও স্টেশনে যেতে সময় লাগল ১০ মিনিট

মেট্রোরেলে ওঠার আগে ১০টি তথ্য জেনে নিন:
১. মেট্রোরেলের ট্রেন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলাচল করে। মঙ্গলবার বন্ধ।
২. আগারগাঁও আইডিবি স্টেশন বা উত্তরা দিয়াবাড়ি স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়তে পারেন।
৩. টিকিট একদিকে জনপ্রতি ৬০ টাকা।
৪. টিকিট কেনার জন্য ১০০ টাকা বা এর চেয়ে ছোট নোট নেওয়া ভালো। ২০০ বা ৫০০ টাকা মেশিন চেনে না। তবে মেশিনে না কিনে বিক্রেতার কাউন্টার থেকেও টিকিট কেনা যায়।
৫. উত্তরা থেকে আগারগাঁও যেতে বা ফিরতে লাগবে ১০ মিনিট ১০ সেকেন্ডের মতো। তবে লাইনে দাঁড়ানো, টিকিট কেনা, ট্রেনে চড়া মিলে আরও কুড়ি মিনিট লাগতে পারে। কাজেই যাওয়া-আসা মিলে আপনার এক ঘণ্টা লেগে যাবে।

৬. সিজন টিকিট কেনা যাবে। সে জন্য ফরম পূরণ করে নিয়ে যেতে হবে। ফরম পাওয়া যাবে এই সাইটে। সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নিতে হবে। আর লাগবে ৫০০ টাকা। রোজ বেলা তিনটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত আগারগাঁও বা উত্তরা স্টেশন থেকে সিজন টিকিট কেনা যাবে।
৭. স্টেশনগুলোতে স্কাউটরা আছেন পরামর্শ দিতে। পথ দেখাতে। যন্ত্র থেকে টিকিট কাটার জায়গাতেও সাহায্য করার জন্য লোক নিয়োজিত আছেন। গেটে কার্ড দেখানো বা বেরোনোর সময় কার্ড ঢোকানোর জন্য আপনাকে সাহায্য করতে কর্মীরা প্রস্তুত আছেন।

৮. প্ল্যাটফর্ম দেখিয়ে দেওয়ার জন্য স্কাউট আছেন। মনিটরেও প্ল্যাটফর্ম নম্বর ওঠে। লাইনের পাশের হলুদ দাগ পার না হওয়ার কথা কর্মীরা সারাক্ষণ মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
৯. একবার স্টেশনের ভেতরে ঢুকে গেলে দুপুর ১২টার পরেও আপনাকে নিয়ে ট্রেন চলবে। তবে টিকিটের সময়সীমা ১১টা ৫০ পর্যন্ত।
১০. ট্রেনে, প্ল্যাটফর্ম, আশপাশে কোনো ধরনের ময়লা ফেলবেন না। আমাদের প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার কমাতে হবে। ফানুস ঢাকা ও আশপাশে নিষিদ্ধ করতে হবে। ট্রেনের দরজা বন্ধ হওয়ার সময় ঢোকা বা বেরোনোর চেষ্টা করা উচিত হবে না। সম্প্রতি ভারতে এক স্টেশনে এক নারীর পোশাক ট্রেনের দরজায় আটকে যাওয়ার পর ট্রেন তাঁকে প্ল্যাটফর্মে অনেকটা পথ টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছে। আমাদের মেট্রোতে এমন কিছু ঘটুক, আমরা চাই না।