নিহত সোহেল মোল্লা, দীপ্ত সাহা ও ইমন তালুকদার
নিহত সোহেল মোল্লা, দীপ্ত সাহা ও ইমন তালুকদার

গোপালগঞ্জে হামলা

পরিবারের দাবি, তাঁরা রাজনীতি করতেন না

গোপালগঞ্জে নিহত চারজন কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বলে পরিবারগুলো দাবি করেছে। নিহত চারজনের মধ্যে দুজন দোকানি, একজন দোকান কর্মচারী ও অন্যজন রাজমিস্ত্রি। দুজনের বয়স ২০-এর নিচে।

বুধবার জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় ওই চারজন নিহত হন। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর প্রতিবেদকেরা নিহত ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলেছেন।

নিহত চারজন হলেন মুঠোফোনের যন্ত্রাংশের দোকানি সোহেল মোল্লা (৩৫), পোশাক দোকানি দীপ্ত সাহা (২৫), সিরামিকপণ্যের দোকানের কর্মচারী ইমন তালুকদার (১৭) ও রাজমিস্ত্রি রমজান কাজী (১৮)। এর মধ্যে দীপ্ত সাহাকে নিজেদের কর্মী দাবি করে আসছেন নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা।

সোহেল মোল্লা

ভিডিও করছিলেন সোহেল’

গোপালগঞ্জ শহরের পূর্ব মিয়াপাড়ায় ভাড়া বাসায় মা-বাবা, স্ত্রী এবং চার ও দুই বছর বয়সী দুই ছেলেকে নিয়ে থাকতেন সোহেল মোল্লা। গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়া উপজেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। গোপালগঞ্জ শহরের চৌরঙ্গীর কেরামত উদ্দিন প্লাজায় মুঠোফোনের যন্ত্রাংশের দোকান আছে তাঁর। তিনি মা-বাবার একমাত্র সন্তান।

গতকাল দুপুরে সোহেল মোল্লার ভাড়া বাসায় গিয়ে কথা হয় তাঁর মা লাইলি বেগমের সঙ্গে। তিনি বিলাপ করে বলতে থাকেন, ‘আমাগো বাড়ি গোপালগঞ্জ হইতে পারে। আমরা তো কোনো রাজনীতি করি না বাবা। তার কেন এই হইল?’ সোহেলের স্ত্রী নিশি বেগম বলেন, তাঁর স্বামী কোনো রাজনীতি করতেন না। ছেলে হত্যার বিচার চান সোহেলের ষাটোর্ধ্ব বাবা ইদ্রিস আলী। তাঁদের ভাষ্য, বুধবার বাসা থেকে বের হয়ে দোকানে যান সোহেল। দুপুরে সংঘর্ষ শুরু হলে তিনি মুঠোফোনে ঘটনার ভিডিও ধারণ করছিলেন।

সোহেলের মামা জাহিদুল ইসলাম তালুকদার বলেন, তাঁর ভাগনের লাশের ময়নাতদন্ত হয়নি এবং হাসপাতাল থেকে মৃত্যুসনদ দেওয়া হয়নি। গতকাল সকালে গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। দাফন শেষে পরিবারের সদস্যরা আবার শহরের বাসায় চলে আসেন।

ইমন তালুকদার

ইমনের টাকায় চলত সংসার

নিহত ইমন গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার গ্রামের আজাদ তালুকদারের ছেলে। গতকাল সকালে তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনের ছোট ঘর। সামনের ছোট উঠান ভরে ছিল স্বজন-প্রতিবেশীতে। সন্তান হারানো শোকে কথা বলতে পারছিলেন না ইমনের মা রোকসানা বেগম।

উপস্থিত লোকজনের সান্ত্বনায় এক পর্যায়ে রোকসানা বলে ওঠেন, ‘আমার বাপে (ইমন) সংসারটা টানত। এখন আমার চারটে-পাঁচটা ছেলেমেয়ে নিয়ে বাঁচার পথ নাই।’

প্রতিবেশী রাজু তালুকদার বলেন, ইমনেরা দুই বোন ও তিন ভাই। বড় ভাই অসুস্থ। একটা বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট বোন আর ভাইটা পড়াশোনা করে, ইমনই খরচ চালাত। ওর বাবা অসুস্থ। এ নিয়েই কখনো কখনো ভ্যান চালান। ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে একদম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ছেলের জানাজায় পর্যন্ত থাকেননি। বাড়ি থেকে কোথায় যেন চলে গেছেন, কেউ জানে না।

পরিবারের সদস্যরা জানান, ইমন বেলা ১১টার দিকে বাড়ির উদ্দেশে দোকান থেকে বের হয়। কিন্তু সে বাড়ি না গিয়ে সংঘর্ষস্থলে যায়। স্থানীয় লোকজন তাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নেন। গতকাল সকালে পৌর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে।

রমজানও ছিলেন প্রধান উপার্জনক্ষম

রমজান গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার বান্ধাবাড়ী ইউনিয়নের হরিণাহাটি গ্রামের কামরুল কাজীর ছেলে। কামরুল কাজী ২০ বছর আগে গোপালগঞ্জে চলে আসেন। পরিবার নিয়ে তিনি গোপালগঞ্জের বিসিক এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। গতকাল বেলা দুইটার দিকে সেখানে কথা হয়।

রমজানের মামা কলিম মুন্সি বলেন, ‘আমার ভাগনে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নয়। তার বাবা প্রতিবন্ধী, এক বেলা ভ্যান চালায়। রমজানের রাজমিস্ত্রির টাকায়ই সংসার চলত। ভিডিওতে দেখলাম ভাগনেকে গুলি করে মেরেছে। লাশও ময়নাতদন্ত করাতে পারলাম না।’

দীপ্ত সাহা

‘দাঁড়িয়ে ছিলেন দীপ্ত’

দীপ্ত সাহা গোপালগঞ্জের উদয়ন রোডের সন্তোষ সাহার ছেলে। গতকাল বেলা আড়াইটায় তাঁর পরিবারের সঙ্গে কথা হয়। ‌বুধবার রাতে গোপালগঞ্জ পৌর মহাশ্মশানে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

দীপ্ত সাহার ভাই সঞ্জয় সাহা বলেন, ‘আমরা দুই ভাই পোশাক ব্যবসায়ী। কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নই। প্রতিদিনের মতো আমার ভাই দোকানে যায়। শহরের অবস্থা খারাপ দেখে দোকান বন্ধ করে পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। পরে সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তাড়া খেয়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিতে গেলে গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজ মসজিদের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়। তার পেটের ডান পাশে গুলি লেগে বাঁ পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়।’

ছেলের পোশাক ধরে স্মৃতিচারণা করে কেঁদে কেঁদে দীপ্তর মা বিভা রানী সাহা বলেন, ‘আমার ছেলেকে এনে দিতে পারবে? যদি না–ই দিতে পারো তাহলে কথা বলে কী লাভ? কী অপরাধ করেছে আমার ছেলে?’