অর্থমন্ত্রীর নতুন রেকর্ড ও বাজেট বক্তৃতার গালগল্প

একসময় কে কত ঘণ্টা ধরে বাজেট বক্তৃতা পড়লেন—এ নিয়ে রীতিমতো লেখালেখি হতো। কিন্তু এখন বাজেট উপস্থাপনের ধরন বদলে গেছে। মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে বাজেট উপস্থাপন করা হয়। ফলে অর্থমন্ত্রীদের এখন আর বাজেট পুরোটা পড়তে হয় না।

বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী মানে বাজেটেরও সুবর্ণজয়ন্তী। অর্থাৎ আ হ ম মুস্তফা কামাল ৩ জুন যে বাজেটটি উপস্থাপন করলেন সেটি ছিল দেশের ৫০তম বাজেট। আর এই বাজেট দিতে গিয়েই সবার অগোচরে নতুন একটি রেকর্ড করলেন। পৃষ্ঠাসংখ্যার বিচারে বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম বাজেট দেওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করলেন তিনি।

এবারের বাজেট বক্তৃতা সব মিলিয়ে ১৯২ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে মূল বক্তৃতা ১৫৮ পৃষ্ঠার। এর আগের দীর্ঘ বক্তৃতাটি ছিল ২০১১-১২ অর্থবছরের, আর দিয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সেই বক্তৃতাটি ছিল ১৪৮ পৃষ্ঠার। অর্থাৎ ১০ পৃষ্ঠার ব্যবধানে জিতে গেলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল।

ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ আরনেস্ট ফ্রেডারিক সুমাখারের একটি বিখ্যাত বই আছে। ১৯৭৩ সালে অর্থনীতি নিয়ে লেখা সেই বইটির নাম ছিল, স্মল ইজ বিউটিফুল: আ স্টাডি অব ইকোনমিকস এজ ইফ পিপল ম্যাটারড। একজন অর্থনীতিবিদ লিখলেও অর্থমন্ত্রীরা কিন্তু স্মল ইজ বিউটিফুল–এ আস্থা রাখেন না। বিভিন্ন দেশের অর্থমন্ত্রীই এর প্রমাণ।

লাল ব্রিফকেস হাতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল

একসময় কে কত ঘণ্টা ধরে বাজেট বক্তৃতা পড়লেন—এ নিয়ে রীতিমতো লেখালেখি হতো। কিন্তু এখন বাজেট উপস্থাপনের ধরন বদলে গেছে। মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে বাজেট উপস্থাপন করা হয়। ফলে অর্থমন্ত্রীদের এখন আর বাজেট পুরোটা পড়তে হয় না। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষ বা একজন বিশেষজ্ঞ যখন বাজেট নিয়ে জানতে চাইবেন, তাঁকে তো পুরোটাই পড়তে হবে।

দীর্ঘতম বাজেট বক্তৃতা

ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি একসময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তিনি প্রথম বাজেট দিয়েছিলেন ১৯৮২ সালে। প্রণব মুখার্জির ১ ঘণ্টা ৩৫ মিনিটের বাজেট বক্তৃতা শুনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মন্তব্য করেছিলেন, ‘দ্য শর্টেস্ট ফিন্যান্স মিনিস্টার হ্যাজ ডেলিভারড দ্য লংগেস্ট বাজেট স্পিচ।’ একটু বড় বাজেট বক্তৃতা হলে অনেকেই এ কথাটি এখনো ব্যবহার করেন।

ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রণব মুখার্জি

তবে ভারতের ইতিহাসে দীর্ঘতম বাজেট বক্তৃতা দিয়েছিলেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন। ২০০০ সালে তাঁর দেওয়া বাজেট বক্তৃতাটি ছিল ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের। এর আগের বছরের বাজেট বক্তৃতাটি ছিল ২ ঘণ্টা ১৯ মিনিটের। টানা বক্তৃতা দিতে গিয়ে অধিবেশন কক্ষেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন নির্মলা সীতারমন। শেষ দুই পাতা ভালো করে পড়তেই পারেননি। এই বাজেট বক্তৃতার পরে কংগ্রেসের সাংসদ রাহুল গান্ধী টুইট করে এর তীব্র সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘অসংলগ্ন একটা বাজেট। শুধু ফালতু কথা। ২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের বক্তৃতায় শুধু একই কথা বারবার বলে গেলেন।’

সময়ের দিক থেকে নির্মলা সীতারমন রেকর্ডধারী হলেও শব্দ সংখ্যা বিচারে সবচেয়ে বড় বক্তৃতাটির মালিক মনমোহন সিং। তখন তিনি অর্থমন্ত্রী। ১৯৯১ সালে দেওয়া তাঁর বাজেট বক্তৃতায় শব্দসংখ্যা ছিল ১৮ হাজার ৬৫০। আর নির্মলা সীতারমনের বক্তৃতায় শব্দসংখ্যা ১৩ হাজার ২৭৫। তবে চলতি বছর ২০২১ সালে নির্মলা সীতারমন বাজেট বক্তৃতার ক্ষেত্রে নতুন একটি রেকর্ড করেছেন। তাঁর এবারের বাজেট বক্তৃতাটি ছিল পুরোপুরি কাগজশূন্য বা পেপারলেস।

উইলিয়াম গোল্ডস্টোন

বিশ্ব রেকর্ড কার

দীর্ঘতম বাজেট বক্তৃতার দিক দিয়ে নির্মলা সীতারমনও কিন্তু বিশ্ব রেকর্ড ছুঁতে পারেননি। এখন পর্যন্ত ইতিহাসের দীর্ঘতম বাজেট বক্তৃতার মালিক সাবেক ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী উইলিয়াম গোল্ডস্টোন। তিনি এই বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন ১৮৫৩ সালের ১৮ এপ্রিল। বক্তৃতাটি ছিল ৪ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের। দীর্ঘ বক্তৃতা শেষে অবশ্য তিনি ক্ষমা চেয়েছিলেন।

অর্থমন্ত্রীদের এসব দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতা শুনেই হয়তো অক্সফোর্ডের অধ্যাপক রবার্ট সার্ভিস বলেছিলেন, ‘আপনি তখনই দীর্ঘ বক্তৃতা দিতে পারবেন, যখন শ্রোতাদের পালিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে না।’ সংসদ অধিবেশন থেকে সরকারি দলের কারোরই পালানোর সুযোগ আসলেই তো নেই।

বাজেট ফাঁসের কাহিনি

এবার বাজেট ফাঁস কাহিনি। বাজেট ফাঁস হওয়ায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন এডওয়ার্ড জন ডালটন। তিনি ১৯৪৫ সালের ২৭ জুলাই থেকে ১৯৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ঘটনাটি ১৯৪৭ সালের, তখনো তিনি বাজেট বক্তৃতা শেষ করেননি। কিন্তু তার আগেই দ্য স্টার পত্রিকার সন্ধ্যাকালীন সংস্করণে বাজেট হুবহু ছাপা হয়ে যায়। এই ঘটনায় তিনি পদত্যাগ করেছিলেন।

১৯৯৬ সালে ব্রিটেনের রক্ষণশীল দলের অর্থমন্ত্রী কেনেথ ক্লার্কের বাজেট আগেই ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ডেইলি মিরর বাজেট আগাম পেয়েও তা প্রকাশ করেনি। ফলে খুব ঝামেলায় পড়তে হয়নি তাঁকে।

১৯৩৬ সালে ঘটেছিল মজার আরেক ঘটনা। ব্রিটেনের এক মন্ত্রী জেমস হেনরি থমাস শেয়ার ব্যবসায়ীদের কাছে বাজেটের তথ্য ফাঁস করে দেওয়ায় পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি গলফ খেলার সময় ‘টি আপ’ বলে চিৎকার দিয়েছিলেন। এর অর্থ হচ্ছে চায়ের ওপর শুল্ক বাড়ছে। এ নিয়ে হইচই হলে তিনি পদত্যাগ করেন।

আবার ১৯৯৬ সালে ব্রিটেনের রক্ষণশীল দলের অর্থমন্ত্রী কেনেথ ক্লার্কের বাজেট আগেই ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ডেইলি মিরর বাজেট আগাম পেয়েও তা প্রকাশ করেনি। ফলে খুব ঝামেলায় পড়তে হয়নি তাঁকে। ডেইলি মিরর–এর সম্পাদক পিয়ার্স মরগ্যান তখন এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘আমরা সাধারণত সরকারকে বিব্রত করার সুযোগ তেমন ছাড়ি না, বিশেষ করে এ রকম একটি স্কোপ পাওয়ার পরও। কিন্তু এ ধরনের একটি স্পর্শকাতর অর্থনৈতিক নথি অর্থমন্ত্রীকে ফেরত দেওয়া আমাদের জাতীয় কর্তব্য।’

তবে গণমাধ্যমের জন্য ভালো কাজটি করতে গিয়ে একবার বিপদও দেখা দিয়েছিল। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন (২০০৭-১০) সংসদে উপস্থাপনের আগে বাজেটের তথ্য সাংবাদিকদের জানানোর ব্যবস্থা করেছিলেন, যাতে গণমাধ্যম বাজেট রিপোর্ট ভালোভাবে করতে পারে। একবার বিপত্তিটি ঘটিয়েছিল ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা।

২০১৩ সালে জর্জ অসবর্ণের সময়ে একইভাবে আগাম বাজেট পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার এক সাংবাদিক প্রথম পাতার ছবি তুলে টুইটারে প্রকাশ করে দেন। অথচ তখনো বাজেট বক্তৃতা শুরুই হয়নি। এ জন্য ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ডকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে হয়।

দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতার সমস্যা হচ্ছে এর ভেতরের আসল কথাটি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের এবারের ১৫৮ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতা। তবে অন্যতম দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতার মধ্যে ইতিহাসে সত্যিকার অর্থে স্থান করে নিয়েছে ১৯৯১ সালে দেওয়া মনমোহন সিংয়ের দেওয়া বাজেট বক্তৃতা।
বাজেটের দিন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল

কতটা পাঠকবান্ধব বক্তৃতা

দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতার সমস্যা হচ্ছে এর ভেতরের আসল কথাটি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের এবারের ১৫৮ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতা। তবে অন্যতম দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতার মধ্যে ইতিহাসে সত্যিকার অর্থে স্থান করে নিয়েছে ১৯৯১ সালে দেওয়া মনমোহন সিংয়ের দেওয়া বাজেট বক্তৃতা। এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক সংস্কারের শুরু তখন থেকেই, যা অর্থনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। সেই বাজেট বক্তৃতায় ছিল সংস্কারের বিস্তারিত রূপরেখা।

এ ছাড়া অন্য প্রায় সবার বাজেট বক্তৃতা পড়লে রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতাটির কথাই মনে পড়বে। মন উড়ুউড়ু, চোখ ঢুলুঢুলু,/ ম্লান মুখখানি কাঁদুনিক--/ আলুথালু ভাষা, ভাব এলোমেলো,/ ছন্দটা নির্র্বাঁধুনিকা।/ পাঠকেরা বলে, ‘এ তো নয় সোজা,/ বুঝি কি বুঝিনে যায় না সে বোঝা।’ /কবি বলে, ‘তার কারণ, আমার/ কবিতার ছাঁদ আধুনিকা।’

অর্থাৎ বাজেট বক্তৃতাটিতে সবই উল্লেখ আছে, কিন্তু ব্যবসায়ীরা ছাড়া কেউই ভালো বুঝতে পারছেন না, বাজেটে আসলে তাদের জন্য কী আছে। এই বাজেট বক্তৃতাকে মোটেই পাঠকবান্ধব বলা যাচ্ছে না।