অর্থনীতির গেম চেঞ্জার–৪১

ব্যাটারিশিল্পের বিপ্লব যাদের হাতে

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য এখন অর্থনীতিতে। ৫০ বছরে বাংলাদেশ নামের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হয়ে উঠেছে চমকে ভরা জাদুর বাক্স। সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত। তবে যাত্রাপথটা সহজ ছিল না। বড় ঝুঁকি নিয়ে অভিনব পথে এগিয়ে গেছেন আমাদের সাহসী উদ্যোক্তারা। এ সাফল্যের পেছনে আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ যেমন ছিলেন, আছেন নীতিনির্ধারকেরাও। মূলত অর্থনীতির এসব অগ্রনায়ক, পথ রচয়িতা ও স্বপ্নদ্রষ্টারাই ৫০ বছরে বিশ্বে বাংলাদেশকে বসিয়েছেন মর্যাদার আসনে।
আমরা বেছে নিয়েছি সেই নায়কদের মধ্যে ৫০ জনকে। আমাদের কাছে তারাই অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’।

আবদুর রহিম সাত বছর বয়সে মা-বাবাকে হারান। বড় হয়েছেন মামার কাছে, কলকাতায়। লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। মামার ছোট ব্যবসা ছিল। লেখাপড়া জানতেন না বলে মামার অফিসেই পিয়নের কাজ নিয়েছিলেন। কিন্তু পিয়নের কাজ করতে ভালো লাগছিল না বলে ১৭ বছর বয়সে চাকরিটি ছেড়ে দেন। এরপর কলকাতায় দরজির কাজ শুরু করেন। সেখান থেকে ছোট্ট একটি কাপড়ের দোকান দিয়েছিলেন। সেই দোকান বিক্রি করে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন। এর মধ্যেই দেশ ভাগ হয়। কলকাতা থেকে চলে আসেন চট্টগ্রামে।

যেভাবে কোম্পানি গঠন

চট্টগ্রামে আবদুর রহিম পিডব্লিউডিতে পাইপলাইন মেরামতের কাজ করতেন। কাজের সূত্রেই পরিচয় হয় লুকাস ব্যাটারি প্রস্তুতকারক ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানের কয়েক কর্মকর্তার সঙ্গে। তাঁরা তখন বাংলাদেশে পরিবেশক খুঁজছিলেন। কাজটি নিলেন তিনি। আর এ জন্য ১৯৫৮ সালের ১৫ এপ্রিল তিনি ‘রহিমআফরোজ’ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।
আবদুর রহিম চট্টগ্রাম ছেড়ে ১৯৫৯ সালে পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। এ সময় ব্যবসারও প্রসার ঘটতে থাকে। তখন ব্রিটিশ কোম্পানি লুকাসের ব্যাটারির ছিল একচেটিয়া ব্যবসা। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত রহিমআফরোজ কোম্পানি ছিল লুকাস ব্যাটারির একমাত্র পরিবেশক। বিপণন করেছেন অস্ট্রেলিয়ার ডানলপ টায়ারও। ১৯৮০ সালে ব্রিটিশ কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে আবদুর রহিম কোম্পানিটি অধিগ্রহণ করেন। তারপর আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ব্যবসা পরিবর্তন না করে নিজেই নতুন করে ব্যাটারি প্রস্তুত শুরু করেন। কিন্তু এই সাফল্য বেশি দিন দেখতে পারেননি তিনি। ১৯৮২ সালে ৬৭ বছর বয়সে মারা যান আবদুর রহিম। এরপর তাঁর তিন সন্তান আফরোজ রহিম, ফিরোজ রহিম ও নিয়াজ রহিম ব্যবসার হাল ধরেন।

আবদুর রহিম

আবদুর রহিম কোম্পানি করেছিলেন বড় ছেলে আফরোজ রহিমের নামে। রহিম সবার নামের সঙ্গেই যুক্ত আছে। কোম্পানি গঠনের সময়ে তাঁর একটিই ছেলে ছিল। নিবন্ধনের সময়ে আফরোজের বানানে একটি অতিরিক্ত ‘ও’ বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যে কারণে ইংরেজিতে কোম্পানির নাম এখনো ‘RAHIMAFROOZ’।

দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে

নিয়াজ রহিমের জন্ম ১৯৫৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। সেন্ট প্লাসিড স্কুল, বিএএফ শাহীন স্কুল ও নটর ডেম কলেজের ছাত্র নিয়াজ রহিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮০ সালে আইন শাস্ত্রে স্নাতক সম্মান ও ১৯৮২ সালে কানাডার কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিং ম্যানেজমেন্টে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন।

ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন নিয়াজ রহিম। তাঁর মুখেই কিছুটা শোনা যাক। তিনি বলেন, ‘১৯৮২ সালে বাংলাদেশে তখন গার্মেন্ট ব্যবসা মাত্র এসেছে। আমি ও আমার তিন বন্ধু মিলে তখন ভিভা বাংলাদেশ লিমিটেড নামে একটি বায়িং হাউস খুলি। ১৯৮৩ সালে আমার ভাইয়েরা আমাকে বললেন, হয় তুমি আলাদা হও, নয় আমাদের সঙ্গে থাকো। আমাদের পারিবারিক সিদ্ধান্ত, আলাদা ব্যবসা আমরা করব না। পরিবারের সদস্যদের এখানে একটি ব্যবসা থাকবে আবার একেকজনের ব্যক্তিগত আরেকটি ব্যবসা থাকবে, এ রকম আমরা করব না। আমরা যা করব একসঙ্গে। ১৯৮৫ সালে সিদ্ধান্ত নিলাম যে বায়িং হাউস থেকে আস্তে আস্তে বের হয়ে যাব। ফলে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা আর বায়িং হাউসে থাকব না। আমরা বেরিয়ে আসব। আমি রহিমআফরোজে ঢুকলাম ১৯৮৪ সালে। শুরুতেই আমি দায়িত্ব নিই ব্যাটারি সেলসের। সারা দেশে ডিলার নিয়োগের প্রক্রিয়া আরম্ভ করি। দুই বছরেই একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করার মতো অবস্থানে আসি। ডিলার নেটওয়ার্ক করার পর থেকেই রহিমআফরোজের ব্যবসার প্রবৃদ্ধি আস্তে আস্তে ভালো হয়েছে।

নিয়াজ রহিম আরও বলেন, আমরা শুরু করেছিলাম প্রায় শূন্য থেকে। ওই সময়ে এই ব্যবসা যাঁরা করতেন, রাস্তা থেকে তাঁরা পুরোনো ব্যাটারি কিনতেন। আমরা তাঁদের নতুন ব্যাটারিতে নিয়ে আসি। সবাইকে নিয়মকানুন শেখাই। পুরোনো ব্যাটারির দাম প্রায় অর্ধেক। পুরোনো ব্যাটারির অভ্যস্ততা ছেড়ে ক্রেতারা নতুন ব্যাটারি কিনবেন কি না, এই আশঙ্কাও ছিল। গাড়িতে ব্যাটারির প্রয়োজন হয় মূলত স্টার্ট দেওয়ার সময়। একটি দুর্বল ব্যাটারি দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলে ইঞ্জিনের ওপর বেশি চাপ পড়ে। আমরা ডিলারদের বলতাম, তোমরা ওদের বোঝাও, যদি নতুন ব্যাটারির জন্য আড়াই বা তিন হাজার টাকা দেয়, তাহলে লাখ টাকার গাড়ি বেঁচে যাবে। স্টার্ট দেওয়া মাত্রই গাড়ি স্টার্ট নেবে। এভাবেই আমাদের বিক্রি বাড়ল। আবার সে সময়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেওয়া এক প্রকল্পের আওতায় গ্রামে গ্রামে টেলিভিশন বিতরণ করা হয়েছিল। বিদ্যুৎ না থাকায় টেলিভিশন চালাতে হতো ব্যাটারিতে। ফলে গ্রামেও ব্যাটারির চাহিদা বাড়ল। আমরা ব্যাটারি নিয়ে গ্রামে গেলাম, তাদের ঢাকায় আসতে হতো না।

ব্যবসার সম্প্রসারণ

শুধু গাড়ির ব্যাটারি উৎপাদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি রহিমআফরোজ গ্রুপ। এরপর শুরু হয় শিল্পে ব্যবহৃত ব্যাটারি উৎপাদনের কাজ। তারা সোলার এনার্জির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাটারি উৎপাদনের পরিকল্পনা নেয়। এই ব্যাটারি ইঞ্জিন স্টার্ট দেওয়ার জন্য শুধু নয়, বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্যও। তখন শিল্পে ব্যবহারের সব ধরনের ব্যাটারি আমদানি করতে হতো। ৯০ দশকেই রহিমআফরোজ শিল্প খাতের ব্যাটারি উৎপাদন শুরু করে।

সব মিলিয়ে দেশে ব্যাটারিশিল্পের বিপ্লব ঘটেছে রহিমআফরোজ গ্রুপের হাত ধরেই। ১৯৯২ সালে সিঙ্গাপুরে ব্যাটারি রপ্তানি করে নতুন মাইলফলক অর্জন করে তারা। ১৯৯৩ সালে প্রথম আইপিএস চালু করে কোম্পানিটি। সুপারস্টোরের সঙ্গেও দেশবাসীকে পরিচয় করিয়ে দেয় রহিমআফরোজ গ্রুপ। ২০০১ সালে চালু হয় ‘আগোরা’ নামের সুপারস্টোর। নীতিনৈতিকতার দিক থেকেও বিশেষ সুনামের অধিকারী ছিল এই গ্রুপ। ব্যবসায়ের পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও রহিমআফরোজ পিছিয়ে নেই। নিয়াজ রহিম বলেন, মূল্যবোধই তাদের ব্যবসায়ের মূলধন। বর্তমানে রহিমআফরোজ গ্রুপের অধীনে চালু আছে ১৫টির বেশি কোম্পানি। ২০১২ সালে বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে রহিমআফরোজে যুক্ত হয়েছেন নিয়াজ রহিমের জ্যেষ্ঠ সন্তান ফারাজ এ রহিম। অন্য ছেলেরাও যুক্ত হয়েছেন। অর্থাৎ তৃতীয় প্রজন্মও চলে এসেছে পারিবারিক এ প্রতিষ্ঠানে।

আগোরার চেয়ারম্যান নিয়াজ রহিম

ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির অনুষ্ঠানে নিয়াজ রহিম বলেছিলেন, ‘আমার বাবা-মা খুব শিক্ষিত মানুষ ছিলেন না। কিন্তু তাঁরা আমাদের সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন এবং ব্যক্তিগতভাবে আমাদের তাঁরা তাঁদের নিজস্ব দীক্ষা প্রদান করেছেন। তাঁরা আমাদের একজন মুসলিম হিসেবে বেঁচে থাকা ও প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং ব্যবসা করার মৌলিক মূল্যবোধ শিক্ষা দিয়েছেন। আমরা তাঁদের প্রতিটি মূল্যবোধই ধারণ করেছি। আমাদের এই মূল্যবোধের সঙ্গে যাঁর মূল্যবোধ না মেলে, তিনি আমাদের সদস্য হতে পারেন না।’

এখন কেমন আছেন

এখন খুব একটা ভালো নেই রহিমআফরোজ গ্রুপ। বিদ্যুৎ প্রকল্পে লোকসান ও করোনার সময়ের ব্যবসা ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি তারা। সহযোগী একটি দৈনিক শিরোনাম করে ‘৭০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্দিনে রহিমআফরোজ গ্রুপ’। বিপুল অঙ্কের ব্যাংক ঋণ নিয়ে তারা হিমশিম খাচ্ছে। নিয়াজ রহিম নিজেও ২০১৩ সাল থেকে বেশ অসুস্থ। দীর্ঘদিন বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন। এ সময়েও ব্যবসার ক্ষতি হয়েছে। রহিমআফরোজ ঘুরে দাঁড়াবে—এই প্রত্যাশা এখন সবার।