রাজধানীর বনশ্রীর স্যান্ড্রা ফুডস ইন্টারন্যাশনালের একটি আউটলেট
রাজধানীর বনশ্রীর স্যান্ড্রা ফুডস ইন্টারন্যাশনালের একটি আউটলেট

কেন বাংলাদেশে বেকারি ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন নিউজিল্যান্ডের ৮১ বছরের স্যান্ড্রা

রাজধানীর বনশ্রীর একটি খাবারের দোকানে ঢুকতেই একজন বয়স্ক বিদেশি নাগরিকের ছবি দেখা গেল। কেক, পাউরুটি, মিষ্টি, শিঙাড়া, জুস—এমন খাবারের দোকানে একজন বিদেশি নাগরিকের ছবি কেন? এই প্রশ্ন জেগে বসল। সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে এই নারীর পরিচয় জানা গেল। ৮১ বছর বয়সী নিউজিল্যান্ডের এই নাগরিকের নাম স্যান্ড্রা ম্যাকারসি। তিনি পেশায় একজন শিক্ষক ছিলেন। এখন বিভিন্ন ধরনের সমাজসেবামূলক কাজ করেন।

স্যান্ড্রা ম্যাকারসি ২০১৮ সালে বাংলাদেশে বেকারি ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৭৪ বছর। তৈরি করেন স্যান্ড্রা ফুডস ইন্টারন্যাশনাল। এখানে প্রায় ৩০০ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। স্যান্ড্রা ম্যাকারসি বিনিয়োগ করলেও কোনো মুনাফা নেন না। মুনাফার টাকা খরচ আবার বিনিয়োগ করেন। প্রতি মাসে মুনাফার একটি অংশ নারায়ণগঞ্জের একটি অনাথ আশ্রমে দান করেন।

কে এই স্যান্ড্রা ম্যাকারসি

স্যান্ড্রা ম্যাকারসি বসবাস করেন নিউজিল্যান্ডের ওয়াঙ্গারেই শহরে। এই শহর নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড থেকে দেড় শ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। স্যান্ড্রা ম্যাকারসি পেশায় ছিলেন শিক্ষক। তবে পারিবারিক ব্যবসা হিসেবে নিউজিল্যান্ডে রয়েছে লাইব্রেরি। এ ছাড়া নিউজিল্যান্ডে ‘পিপল পটেনশিয়াল’ নামে একটি ভকেশনাল প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানও রয়েছে তাঁর। শিক্ষা ও সামাজিক খাতে সেবামূলক কাজের জন্য ২০২০ সালে যুক্তরাজ্যের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের কাছ থেকে ‘কুইন্স সার্ভিস মেডেল’ পেয়েছেন স্যান্ড্রা ম্যাকারসি। ২৫ বছর বয়স থেকেই তিনি কাজ করছেন সেবামূলক বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান রোটারি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে।

অসম্ভব প্রাণশক্তির মানুষ স্যান্ড্রা ম্যাকারসি। ৭৩ বছর বয়সে প্যারাস্যুট দিয়ে বিমান থেকে ঝাঁপ দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘নিউইয়র্ক ম্যারাথন, অকল্যান্ড ম্যারাথন, লন্ডন ম্যারাথনও দৌড়েছি। আমার দর্শন হলো যা কিছু সামনে আসে হ্যাঁ বলতে হবে।’ গত মাসে তিনি নিউজিল্যান্ড থেকে ঢাকায় আসেন। তখন তিনি প্রথম আলোকে তাঁর এই অভিজ্ঞতার কথা জানান। তিনি বছরে অন্তত একবার বাংলাদেশে আসেন।

স্যান্ড্রা ফুডস ইন্টারন্যাশনালের নিউজিল্যান্ডের বিনিয়োগকারী স্যান্ড্রা ম্যাকারসি

যেভাবে শুরু

২০১৫ সালে প্রথম বাংলাদেশে আসেন স্যান্ড্রা ম্যাকারসি। রোটারি ইন্টারন্যাশনাল থেকে ভকেশনাল শিক্ষার নিরীক্ষক হিসেবে কিছু বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন। সে সময় রোটারি ক্লাব অব নারায়ণগঞ্জ মিডটাউনের সহায়তায় একটি সেলাই প্রশিক্ষণের স্কুল দেখতে যান তিনি। তিনি দেখতে পান, স্কুলের পাশে একটি টিনশেড ঘরের অনাথ আশ্রম। সেখানে শিশুরা অস্বাস্থ্যকর ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে বসবাস করত। ন্যূনতম মৌলিক সুবিধাও পেত না এসব শিশু। বিষয়টি স্যান্ড্রাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। পরে এ নিয়ে তিনি কথা বলেন রোটারি ক্লাব নারায়ণগঞ্জ মিডটাউনের সাবেক জেলা গভর্নর জামাল উদ্দিনের সঙ্গে। জামাল উদ্দিন তাঁকে জানান, তাঁরা আধুনিক সুবিধাসংবলিত অনাথাশ্রম নির্মাণ করতে চান। নকশাও প্রস্তুত। তবে পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে সেই উদ্যোগ থমকে আছে। এটি ২০১৫ সালের কথা।

ওই বছর বাংলাদেশ থেকে নিউজিল্যান্ডে ফিরে গিয়ে স্যান্ড্রা ম্যাকারসি শুরু করেন ‘বাই এ বেড’ নামের একটি উদ্যোগ। সেই উদ্যোগের মাধ্যমে কিছু অনুদান জোগাড় করেন। সেসব অনুদানের অর্থ পাঠান বাংলাদেশে। অনুদানের প্রায় আড়াই কোটি টাকায় গড়ে ওঠে নতুন অনাথাশ্রম। যেখানে একসঙ্গে ১০০ শিশুর থাকার ব্যবস্থা আছে। যার নাম রাখা হয় ‘আমিজ উদ্দিন এতিমখানা’। প্রতিটি রুমে চারটি খাট, কেবিনেট ও টেবিল আছে। পাশাপাশি রয়েছে একটি মিলনায়তন।

ওই সময় রোটারি ক্লাব অব নারায়ণগঞ্জ মিডটাউনের মাধ্যমে স্থানীয় ব্যবসায়ী তাসবিহ হুসেইনের পরিচয় হয় স্যান্ড্রা ম্যাকারসির। তাসবিহ হুসেইন অনাথ আশ্রম নির্মাণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সে সময় স্যান্ড্রা ম্যাকারসি জানতে পারেন, তাসবিহ হুসেইনের নারায়ণগঞ্জে আনন্দ বেকারি নামের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অনাথ আশ্রমটি চালানোর জন্য প্রয়োজন অর্থের। এই উপলব্ধি থেকেই স্যান্ড্রা ফুডস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামে বেকারি ব্যবসা শুরু করেন স্যান্ড্রা ম্যাকারসি ও তাসবিহ হুসেইন। বেকারিটিতে দুজনেরই ৫০ শতাংশ হারে অংশীদারত্ব রয়েছে। সব মিলিয়ে ৪ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগে ২০১৮ সালে শুরু হয় স্যান্ড্রা ফুডস ইন্টারন্যাশনাল। এর মধ্যে দুই কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেন স্যান্ড্রা ম্যাকারসি। তবে লভ্যাংশের অর্থ তিনি কখনো নেবেন না—এই ভাবনা থেকেই বিনিয়োগ করেছেন। বর্তমানে প্রতি মাসে লভ্যাংশ থেকে ১ লাখ টাকা অনুদান করেন অনাথাশ্রমে।

বর্তমানে স্যান্ড্রা ফুডস ইন্টারন্যাশনালের ১৫টি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে তিন হাজার বর্গফুটের একটি কারখানা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসবিহ হুসেইন বলেন, ‘স্যান্ড্রা ম্যাকারসি বলেছেন, যত দিন তিনি বেঁচে থাকবেন, তত দিন কোনো লভ্যাংশ নেবেন না। তাঁর মৃত্যুর পরও যেন আমরা এই কার্যক্রম চালিয়ে যাই, এই আবেদন করেছেন তিনি। আমরা খুব বেশি লাভজনক ব্যবসা না হলেও সব সময় চেষ্টা করেছি মানুষকে কিছু দিতে।’

রাজধানীর বনশ্রীর স্যান্ড্রা ফুডস ইন্টারন্যাশনালের একটি আউটলেটের ভেতরের একাংশ

‘আমি বাংলাদেশকে ভীষণ ভালোবাসি’

গত মাসে (সেপ্টেম্বর) দেশে আসেন স্যান্ড্রা ম্যাকারসি। ওই সময় তাঁর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। কেন বাংলাদেশে ব্যবসায় বিনিয়োগ করলেন—এমন প্রশ্নের জবাবে স্যান্ড্রা ম্যাকারসি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ বেছে নেওয়ার কারণ আমি এখানে এলে খুশি থাকি এবং নিরাপদ বোধ করি। এখনো আমার অনেক কিছু দেওয়ার রয়েছে। আমি যত দিন সম্ভব আমি আসতে চাই। আমি বাংলাদেশকে ভীষণ ভালোবাসি। আমি এ দেশের মানুষের প্রাণশক্তিকে ভালোবাসি।’

স্যান্ড্রা ম্যাকারসি আরও বলেন, ‘আমার উদ্দেশ্য শুধু তরুণদের চাকরির সুযোগ তৈরি করা নয়; তাদের নির্দিষ্ট কাজেও প্রশিক্ষণও দিতে চাই। আমরা এমন প্রতিষ্ঠান চাই, যেখানে দক্ষতা ছাড়া এসে মানুষ দক্ষ হয়ে উঠতে পারে। এখন আমাদের কোম্পানিতে ৩০০ জন কাজ করে। এর মানে ৩০০টি পরিবার চলছে। এটাই আমার আনন্দ। মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা একটি মহৎ কাজ।’

এ দেশে কাজের চ্যালেঞ্জ নিয়ে এক প্রশ্নে স্যান্ড্রা ম্যাকারসি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আমি ভালো বাংলা জানি না। তবে হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিয়ে এই দেশে ভাষা ছাড়াও মানুষের সঙ্গে কথা বলা যায়। তবে সবচেয়ে খারাপ লাগে আমি এখনো বাংলাদেশের কাজের ভিসা পাইনি। প্রতিবার আমাকে ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়েই বাংলাদেশে আসতে হয়। এ ছাড়া বৈধ পথে বিনিয়োগেও নানা ধরনের জটিলতা পার করতে হয়েছে।’

তরুণদের উদ্দেশে স্যান্ড্রা ম্যাকারসি বলেন, ‘আমি ঝুঁকি নিতে ভালোবাসি। আমি বিশ্বাস করি, সমাজকে কেউ কিছু দিলে অবশ্যই তা আবার ফিরে পাবে।’