
গৃহহীনদের ঘর দেওয়া কর্মসূচিতে সচ্ছল ব্যক্তিদের ঢুকে পড়া কিংবা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সহায়তা পাওয়ার যোগ্য না হয়েও অনেকেরই টাকা নেওয়ার ঘটনা বেশ পুরোনো। এবার সরকারের ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পেও একই চিত্র ধরা পড়েছে। উপযুক্ত না হয়েও টানা এক যুগ ধরে ঋণসুবিধা নিয়েছেন অনেক ধনী ব্যক্তি। গত ৩০ জুন প্রকল্পটি শেষ হয়।
২০০৯ সাল থেকে চলতি ২০২১ সালের ৩০ জুন শেষ হওয়ার দিন পর্যন্ত ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় কাগজপত্রে উপকারভোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৭ লাখ। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে এই তালিকার ১০ লাখ, মানে ১৭ শতাংশ উপকারভোগীই ছিলেন সচ্ছল মানুষ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। দেশের আটটি বিভাগের ৪০টি উপজেলার ৮০টি ইউনিয়নে ২৪০টি সমিতির তথ্য নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করে আইএমইডি।
আমার বাড়ি আমার খামার’ বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প। প্রথম দিকে অবশ্য এটির নাম ছিল ‘একটি বাড়ি, একটি খামার’। উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়, গরিব মানুষদের সংগঠিত করে ক্ষুদ্র সঞ্চয় পদ্ধতির মাধ্যমে তাঁদের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা তৈরি করা। সেই সঙ্গে স্থায়ী ঘূর্ণমান তহবিল গঠনের মাধ্যমে তাঁদের আয়বর্ধক কর্মসূচিতে ঋণ দেওয়া।
সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি গ্রামে গঠিত হয় ৬০ সদস্যের গ্রাম উন্নয়ন সমিতি। এর মধ্যে নারী সদস্য ৪০ ও পুরুষ সদস্য ২০ জন রাখতে বলা হয়। প্রতি মাসে সদস্যরা ২০০ টাকা করে জমা দেন, আর সরকার দেয় ২০০ টাকা। উপকারভোগী হিসেবে গ্রামের গরিব মানুষদেরই তালিকায় যুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও তা মানা হয়নি।
আইএমইডির সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬০ সদস্যের গ্রাম উন্নয়ন সমিতিতে ৪০ জন নারী থাকার নিয়ম রক্ষা করা হয়নি। বেশির ভাগ সমিতিতে ছিল পুরুষদের আধিক্য। আবার কোথাও কোথাও গ্রাম সমিতিতে ৬০ জন পাওয়া যায়নি। এ রকম কয়েকটি উদাহরণ দিয়েছে আইএমইডি। যেমন কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলায় লোলবাড়িয়া গ্রাম উন্নয়ন সমিতিতে ৬০ সদস্যের মধ্যে ৩০ জন পুরুষ, ৩০ জন নারী। ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার দক্ষিণ আনন্দপুর গ্রাম উন্নয়ন সমিতিতে মোট সদস্য ৫৬ জন। এর মধ্যে ৩৮ জনই পুরুষ, আর নারী ১৮ জন।
আইএমইডি বলছে, এই প্রকল্পের প্রথম দিকে গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠনের সময় নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। ফলে সত্যিকারের গরিব মানুষদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সদস্য বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দুই ধরনের ত্রুটি ছিল স্পষ্ট। প্রথমত, তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার উপযুক্ত নন, এমন মানুষদেরও রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও উপযুক্ত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অর্থাৎ অযোগ্যদের কারণে অনেক যোগ্য পরিবার সদস্য হওয়া থেকে বাদ পড়েছে।
তালিকায় সচ্ছল ব্যক্তিদের ঢুকে পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের পরিচালক আকবর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘৫৭ লাখ উপকারভোগীর মধ্যে কিছু সচ্ছল ব্যক্তির নাম থাকতে পারে, এটা স্বীকার করি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু আইএমইডি আমাদের সচ্ছল ব্যক্তির যে সংখ্যা বলেছে, এটা কিছুতেই হতে পারে না। এই সংখ্যা আরও কম হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকল্পটি যখন প্রথম শুরু হয়, তখন কিছু সচ্ছল মানুষ এতে ঢুকে পড়েন। তাঁদের আর বের করা যায়নি। তাই বলে ১০ লাখ হয় কীভাবে?’
উপকারভোগী নির্বাচনের মানদণ্ড
নীতিমালায় বলা ছিল, নারী যদি পরিবারের প্রধান হন এবং তাঁর নামে ৩০ শতক জমি থাকে তাহলে তিনি সদস্য হতে পারবেন। আর যদি পুরুষ পরিবারের প্রধান হন এবং তাঁর ৫০ শতক জমি থাকে তাহলে তিনি সদস্য হতে পারবেন। তবে চরাঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকার গরিব পরিবারগুলোর জন্য সর্বোচ্চ এক একর জমির মালিক হওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। কিন্তু সর্বত্রই নীতিমালার তোয়াক্কা না করে অনেক ধনী ও সচ্ছল ব্যক্তি তালিকায় ঢুকে পড়েন।
সদস্য চাঁদা ও ঋণ গ্রহণ
গরিব মানুষের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা তৈরি করার লক্ষ্য নিয়ে ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু হয় এই প্রকল্পের। এ জন্য তৈরি করা হয় ‘ক্ষুদ্র সঞ্চয় মডেল’। প্রত্যেক সদস্য মাসে ২০০ টাকা করে দেন। তাতে দুই বছর বা ২৪ মাসে প্রত্যেকের চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার ৮০০ টাকা। দুই বছরে ৬০ জন সদস্যের টাকা জমা হয় ২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। একই সময় সরকারও সমপরিমাণ অর্থ, মানে ২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা দেয়। এখান থেকে যেকোনো সদস্য যেকোনো আয়বর্ধক কাজের জন্য ঋণ পাওয়ার কথা। অথচ সচ্ছল ব্যক্তিরাও বিনা সুদেই এখান থেকে ঋণ নেন বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
নারী-পুরুষ অনুপাত মানা হয়নি
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির অধীনে সারা দেশে মোট ১ লাখ ২০ হাজার ৪৬৫টি গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠিত হয়। আর উপকারভোগী পরিবারের সংখ্যা ৫৭ লাখ। এর মধ্যে নারী উপকারভোগী ২৯ লাখ ৫২ হাজার বা ৫২ শতাংশ, পুরুষ ২৭ লাখ ২৫ হাজার বা ৪৮ শতাংশ। অথচ নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিটি গ্রাম সমিতিতে দুই–তৃতীয়াংশ বা ৬৭ শতাংশ নারী সদস্য থাকার কথা। কিন্তু বেশির ভাগ সমিতিতে নারী–পুরুষের অনুপাত রক্ষা করা হয়নি। এতে প্রকল্পের নীতিমালা ও নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি লঙ্ঘিত হয়।
নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার বাহেরচর পশ্চিম গ্রাম সমিতির সভাপতি আসমা বেগম প্রথম আলোকে জানান, তাঁর সমিতিতে সদস্য বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোনো উন্মুক্ত সভা আহ্বান করা হয়নি।
এক যুগ পরে প্রকল্প অবসান
২০০৯ সালে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ শীর্ষক ১ হাজার ১৯৭ কোটি টাকার এই প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। ২০১৪ সালে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে চার দফায় এটির মেয়াদ বাড়ানো হয়। এতে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। চলতি ২০২১ সালের ৩০ জুন প্রকল্পটি শেষ হয়।
থেকে যাবে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক
ঋণ কার্যক্রম সহজ করতে প্রকল্পের আওতায় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক স্থাপন করে সরকার। তবে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পটি শেষ হলেও এই ব্যাংক থেকে যাবে। সেই সুবাদে প্রকল্পটির সব কার্যক্রম, সম্পদ ও দায় স্থানান্তরিত হবে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে। এই ব্যাংকের ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক সরকার। বাকি ৪৯ শতাংশ শেয়ারের মালিক আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প। দেশের ৪৮৫ উপজেলায় ব্যাংকটির শাখা রয়েছে।