বহুজাতিকদের করপোরেট কর

দিল্লি এখনো বহুদূর

বিশ্ব সম্প্রদায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ওপর ন্যূনতম করপোরেট কর আরোপ করতে যাচ্ছে। এটা সময়ের দাবি হলেও ঠিক যথেষ্ট না–ও হতে পারে।

বিদ্যমান আইনের আওতায় যা ঘটে তা হলো, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো মুনাফার উৎস পরিবর্তন করে কর ফাঁকি দেয়। অর্থাৎ এক দেশে তারা মুনাফা করে, কিন্তু সেই দেশে কর বেশি বলে এমন দেশে তারা সেই মুনাফা দেখায়, যেখানে করহার খুবই কম। তবে ক্ষেত্র বিশেষে আইন তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তখন তারা ওই ট্যাক্স হ্যাভেন বা করবান্ধব দেশগুলোয় কিছু ব্যবসা স্থানান্তরিত করে।

এই কর ফাঁকির নজির হচ্ছে অ্যাপল। ইউরোপে বিপুল ব্যবসা করে তারা যে মুনাফা করেছে, তার উৎস হিসেবে আয়ারল্যান্ডকে বেছে নেয় তারা। কিন্তু সেখানেও করহার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। সেটা এড়ানোর জন্যও পরবর্তীকালে অ্যাপল নানা কায়দা-কৌশল করেছে। তবে অ্যাপল একাই নয়, আরও অনেক কোম্পানি এই কাজ করেছে।

পণ্য উদ্ভাবন ও উৎপাদনে তারা যে প্রতিভার পরিচয় দেয়, কর ফাঁকি দেওয়ার বেলায়ও তারা সেটা করে। অ্যাপল আবার দাবি করে যে প্রতিটি ডলার তারা পরিশোধ করছে। কথা ঠিক, তবে প্রকৃত ঘটনা হলো, বিদ্যমান ব্যবস্থার সব সুবিধা তারা কাজে লাগাচ্ছে।
এই বাস্তবতায় ন্যূনতম ১৫ শতাংশ বৈশ্বিক করহার নির্ধারণ নিঃসন্দেহে বড় ঘটনা।

কিন্তু বিশদে প্রবেশ করলে বোঝা যাবে, বিপদটা কোথায়। এখন বৈশ্বিক করপোরেট করের গড় হার বেশিই বলা যায়। এমন সম্ভাবনা যথেষ্ট প্রবল যে এই বৈশ্বিক ন্যূনতম করপোরেট কারহার সর্বোচ্চ হার হয়ে যাবে। ফলে যে উদ্যোগের উদ্দেশ্য ছিল বহজাতিক কোম্পানিগুলোকে তাদের প্রদেয় কর দিতে বাধ্য করা, তা থেকে শেষমেশ খুব বেশি অতিরিক্ত রাজস্ব মিলবে না। এখন বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার কর ফাঁকি দিচ্ছে এরা। নতুন উদ্যোগের ফলে যে অতিরিক্ত রাজস্ব আহরিত হবে, তা এই অঙ্কের চেয়ে যথেষ্ট কমই হবে। আবার অনেক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, তার সবচেয়ে কম অংশ যাবে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর হাতে। ফলে দিল্লি এখনো বহুদূর।

কথা হচ্ছে, করপোরেট কর ফাঁকি রোধ করতে কেবল ন্যূনতম করহার নির্ধারণ করলেই চলবে না; বরং করপোরেট মুনাফার সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে হবে। হিসাব রক্ষণে নানা ফাঁকির বন্দোবস্ত আছে। তাই নতুন নিয়মে পুরোনো ফাঁকি রোধ করতে হিসাব রক্ষণের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিয়ে ঐকমত্য সৃষ্টি করতে হবে।

ধনী দেশগুলোর সংগঠন ওইসিডি যে প্রস্তাব দিয়েছে, তার মধ্যে গলদ আছে। এতে বলা হয়েছে, শুধু বিশালাকার বহুজাতিক কোম্পানির ওপরই করারোপ করা যাবে। আগে তো ট্রান্সফার প্রাইসিং ছিল, এখন আর সেটা যথোপযুক্ত না হওয়ার বহুজাতিকেরা নতুন কায়দা বের করেছে। সেটা হলো, যেসব দেশে করহার কম, সেখানে মুনাফা দেখানো। যুক্তরাষ্ট্র তো দেশের ভেতরই সে ব্যবস্থা চালু করেছে। বিক্রয়, নিয়োগ, বিনিয়োগ বাবদ যে মুনাফা হচ্ছে, তা রাজ্যগুলোর মধ্যে ভাগ করে দেওয়া।

তবে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কোথায় কোন সূত্র ব্যবহার করা হবে, তার ওপরই নির্ভর করবে কে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেমন, বিক্রয়ে প্রাধান্য দেওয়া হলে উন্নয়নশীল দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কিন্তু ডিজিটাল কোম্পানিগুলো যে অসমতার মুখে পড়ে, এতে তার সুরাহা হতে পারে। আবার বড় প্রযুক্তি কোম্পানির বেলায় বিক্রয়মূল্য অবশ্যই তাদের সংগৃহীত তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। তাদের ব্যবসায়িক মডেলের জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে সব শিল্পের বেলায় এক সূত্র কাজ না–ও করতে পারে।

তবে জি–৭-এর প্রস্তাবে নিঃসন্দেহে কিছু অগ্রগতি আছে, তা আমাদের মানতে হবে। বিশেষ করে করারোপের ক্ষেত্রে নিবাসী হওয়ার যে শর্তের ব্যাপার ছিল, তা তুলে দেওয়া বড় ঘটনা। ডিজিটাল যুগে এটার অর্থ হয় না।

তবে বহুজাতিকদের ওপর করারোপে একপক্ষীয় ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার যে প্রস্তাব করা হয়েছে, নিঃসন্দেহে তার লক্ষ্য হচ্ছে ডিজিটাল কর পরিহার করা। তবে করারোপের ক্ষেত্রে ২০ বিলিয়ন ডলার টার্নওভারের যে সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে অনেক বড় বহুজাতিক পার পেয়ে যাবে। এরপর তো আইনজীবীরা আছেনই, তাঁরা আরও অনেক ফাঁক–ফোকড় খুঁজে বের করার জন্য মুখিয়ে আছেন। আন্তর্জাতিক ঐকমত্য হওয়া সহজ কম্ম নয়, তার ওপর বহুজাতিকদের যে ক্ষমতা, সেই পরিপ্রেক্ষিতে একপক্ষীয় ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেশগুলোর হাতে থাকা উচিত।

এই বাস্তবতায় ওইসিডির পিলার ওয়ান খ্যাত প্রস্তাবের আলোকে করারোপের একপক্ষীয় অধিকার ছেড়ে দেওয়া কাজের কথা হবে না। অঙ্গীকারের সাপেক্ষে প্রাপ্তির যে সম্ভাবনা আছে, তা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

জি২০-এর নেতারাও ন্যূনতম ১৫ শতাংশ করের প্রস্তাবে রাজি হবেন ঠিক। ১৩৯টি দেশ এখন এই দরবারে অংশ নিচ্ছে। তবে শেষমেশ করের যে হার নির্ধারিত হোক না কেন, কোনো কোনো দেশ একক বা যৌথভাবে এর চেয়ে বেশি করারোপ করলে ভালো হতো। যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত ২১ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এখনেই শেষ নয়, কর নিয়ে বৈশ্বিক ঐকমত্যে আসতে আরও অনেক বিষয় নিয়েই আলোচনা করতে হবে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও উদীয়মান দেশগুলোর সঙ্গে জি-৭-এর বসতে হবে, কারণ ছোটদের কথা অনেক সময়ই কেউ শোনে না।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট