
সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই মানুষ টাকা ধার দেয় ও নেয়। আজ থেকে ৫ হাজার বছর আগে সেই মেসোপটেমিয়া (বর্তমানে ইরাক) সভ্যতায় টাকা ধার দেওয়া-নেওয়ার নজির পাওয়া যায়। কিন্তু আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে এই কেবল ১৪ শতকে, ইউরোপের ইতালিতে।
ইংরেজি বেঞ্চ শব্দের ইতালীয় প্রতিশব্দ থেকে ব্যাংক শব্দটি এসেছে। মূলত বেঞ্চে বসে ব্যাংকাররা ব্যবসা পরিচালনা করতেন, সেখান থেকেই ব্যাংক শব্দটি এসেছে। ১৪ শতকে ইতালি ছিল নগররাষ্ট্রের সমষ্টি। তখন রোম ছিল খ্রিষ্টধর্মের বড় এক কেন্দ্র। ফলে ইতালিতে তখন টাকাপয়সার অভাব ছিল না। পাশাপাশি ভৌগোলিক দিক থেকেও ইতালি খুব সুবিধাজনক স্থানে অবস্থিত। এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের উদীয়মান দেশগুলোর একদম কেন্দ্রে অবস্থান ইতালির। ফলে ইতালির ফ্লোরেন্স ও ভেনিস শহরে বিপুল টাকার সমাগম ঘটত। ভেনিসের শক্তির উৎস ছিল নৌশক্তি। সমুদ্রযাত্রার বিমা ও অর্থায়নে দেওয়ার জন্য ভেনিস শহরে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। অন্যদিকে ফ্লোরেন্স শহর উৎপাদনশীল খাত এবং উত্তর ইউরোপের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে জোর দেয়। এ পরিস্থিতিতে সেখানকার বণিক ও অর্থদাতারা মেডিসি ব্যাংক গঠন করে।
শুধু মেডিসি নয়, ফ্লোরেন্স শহরে আরও বেশ কিছু ব্যাংকিং পরিবার ছিল। এর মধ্যে অন্যতম হলো পেরুজ্জি ও বারদি। পাশাপাশি শহরটিতে আরও বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছিল সেই সময়। বন্ধকি কারবার থেকে শুরু করে স্থানীয় ব্যাংক কী ছিল না সেখানে। বন্ধকি কারবারিরা যেখানে মানুষের সম্পদ বন্ধক নিত, সেখানে স্থানীয় ব্যাংকগুলো আবার বিদেশি মুদ্রায় ঋণ দিত; একই সঙ্গে তারা আবার আমানতও রাখত এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ঋণ দিত। কিন্তু ১৩৯৭ সালে জিওভানি দ্য বিসি দে মেডিসি যে ব্যাংক স্থাপন করলেন, তা এগুলো থেকে ভিন্ন।
মেডিসি ব্যাংক উলের মতো পণ্যের দীর্ঘ পথের বাণিজ্যে অর্থায়ন করত। প্রথাগত ব্যাংক থেকে তিনটি কারণে এটি ভিন্ন ছিল। প্রথমত, এটি আকারে-আকৃতিতে অনেক বড় হয়ে উঠেছিল। স্বর্ণযুগে এই ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতার সন্তান কোসিমোর নেতৃত্বে এটি লন্ডন, ব্রুগস, জেনেভাসহ ১১টি শহরে কার্যক্রম পরিচালনা করত। দ্বিতীয়ত, এর নেটওয়ার্ক বিকেন্দ্রীকৃত ছিল। শাখা পরিচালনার দায়িত্ব কোনো কর্মীর হাতে ছিল না, ছিল স্থানীয় ছোট অংশীদারের ওপর। এই অংশীদারেরা মুনাফার ভাগ পেতেন। ফ্লোরেন্সের এই মেডিসি পরিবার ব্যাংকিং জগতের বড় অংশীদার। নেটওয়ার্ক দেখভাল করার দায়িত্ব ছিল তাদের ওপর। স্বাভাবিকভাবেই মুনাফার সিংহভাগ তাদের পকেটে যেত। বিনিময়ে এই ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক মেডিসি পরিবারের ব্র্যান্ডমূল্য লাভ করত। তৃতীয়ত, শাখাগুলো ধনী সঞ্চয়কারীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে আমানত নিত। ফলে প্রাথমিকভাবে যে পুঁজি নিয়ে এই ব্যাংকিং ব্যবসা শুরু হয়েছিল, তার সঙ্গে সঞ্চয়কারীদের আমানত যুক্ত হওয়ায় ব্যাংকের সক্ষমতা বেড়ে গেল। এতে তাদের ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা অনেকাংশে বাড়ল।
অর্থনীতিতে ব্যাংকিং ব্যবসা বিশেষ জায়গা নিয়ে আছে। কারণ ব্যাংকিং ব্যবসা অন্য ব্যবসা থেকে ভিন্ন। সেটা হলো, টাকা থেকে টাকা বানানো। এই ব্যবসা করতে পণ্য উৎপাদন করতে হয় না। আবার পণ্য কিনে এনে বিক্রিও করতে হয় না। কিন্তু ব্যবসা করতে গেলে শুধু নিজের টাকা দিয়ে তো ব্যবসা করা যায় না, ঋণ লাগে। আর তখনই ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হয়।
-দ্য ইকোনমিকস বুক অবলম্বনে প্রতীক বর্ধন