রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংকে খেলাপি ঋণও কমেনি, কারও শাস্তিও হয়নি

মতিঝিল শাপলা চত্বর
ফাইল ছবি

খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে গত বছরের শেষ প্রান্তিকে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ৪ ব্যাংককে লক্ষ্য বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে ওই সভায় জানিয়ে দেওয়া হয়, লক্ষ্যের নিচে খেলাপি ঋণ কমিয়ে না আনলে তাদের জরিমানা গুনতে হবে। লক্ষ্য অর্জন করলে তারা পাবে পুরস্কার। বছর শেষ হলেও কোনো ব্যাংক সেই লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। ফলে খেলাপি ঋণও কমেনি। এ জন্য ব্যাংক চারটিকে জরিমানাও করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। উপরন্তু নিজেদের নেওয়া সিদ্ধান্তই যেন ভুলতে বসেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

ব্যাংক চারটি হলো সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী। এর মধ্যে গত বছর রূপালী ছাড়া সব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে ৩৫ কোটি টাকা। শতাংশের হিসাবে ১৭ থেকে কমে হয়েছে ১৫ শতাংশ।

এ নিয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হককে পাওয়া যায়নি। তবে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গভর্নরের মৌখিক নির্দেশে জরিমানার বিষয়টি এসেছিল। আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড় হওয়ায় বিষয়টি আর এগোয়নি। পরের সভাতেও গভর্নর উপস্থিত থাকলেও এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলোকে তাদের পরিস্থিতির উন্নতি করতে বলা হয়েছে।

জানা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চাওয়া রাষ্ট্রীয় খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা। এর অংশ হিসেবে চার ব্যাংকের সঙ্গে সভা করে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

লক্ষ্য ও অর্জন কার কত

২০২১ সালে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ছিল ১৭ শতাংশ, তা ২০২২ সালের মধ্যে ১৩ শতাংশে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে ২০২২ সাল শেষে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ১৫ শতাংশ। আর খেলাপি ঋণ ১১ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১২ হাজার ৫ কোটি টাকা।

২০২১ সালে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ছিল ১৮ শতাংশ, তা ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে বলা হয়। তবে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হারে কোনো পরিবর্তন হয়নি, বরং পরিমাণের দিক থেকে খেলাপি ঋণ ১২ হাজার ৩২০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা।

২০২১ সালে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ছিল ১৭ শতাংশ, তা ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে বলা হয়। তবে গত বছর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার বেড়ে হয়েছে ২২ শতাংশ। আর খেলাপি ঋণ ৯ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংক এমন সিদ্ধান্ত মাঝেমধ্যে নেয়, যা কার্যকর করতে পারে না। ব্যাংকগুলোও জানে, বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুই করতে পারবে না। খেলাপি ঋণ প্রকৃতপক্ষে কমাতে হলে পুরো খাতের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে। ব্যাংকের পাশাপাশি অন্য সরকারি সংস্থাগুলোকেও খেলাপি ধরতে সক্রিয় করতে হবে।
মুস্তফা কে মুজেরী, সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক।  

২০২১ সাল শেষে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ছিল ১৯ শতাংশ, তা ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে বলা হয়। তবে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার কমে হয় ১৭ শতাংশ। আর খেলাপি ঋণ ৬ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা থেকে কমে হয়েছে ৬ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা।

বিষয়টি নিয়ে কোনো ব্যাংকের এমডিই কথা বলতে চাননি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এমন সিদ্ধান্ত মাঝেমধ্যে নেয়, যা কার্যকর করতে পারে না। ব্যাংকগুলোও জানে, বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুই করতে পারবে না। খেলাপি ঋণ প্রকৃতপক্ষে কমাতে হলে পুরো খাতের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে। ব্যাংকের পাশাপাশি অন্য সরকারি সংস্থাগুলোকেও খেলাপি ধরতে সক্রিয় করতে হবে। না হলে কাগজে–কলমে খেলাপি ঋণ কমবে, বাস্তবে নয়, যা একসময় আরও বড় আকার ধারণ করবে।

ছাড়ের পরও বাড়ছে খেলাপি ঋণ

গত জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন দিয়েছে। এই ঋণ দিতে আইএমএফ শর্ত দিয়েছিল, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে হবে, যাতে দেশের ব্যাংক খাত বড় ধরনের কোনো ঝুঁকিতে না পড়ে। সংস্কারের এই উদ্যোগ নেওয়ার মধ্যেই ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ যাতে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে না যায়, সে জন্য গত ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করে ব্যবসায়ীদের বিশেষ ছাড় দেয়।

ঋণ পরিশোধে কিস্তি সুবিধায় ৭৫ শতাংশ অর্থ জমা দেওয়ার বিধান থেকে সরে এসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৫০ শতাংশ সীমা বেঁধে দেয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রলম্বিত হওয়ায় দেশে শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ও ঋণগ্রহীতাদের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে এই ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি টাকার বেশি। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে তা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকায়। সে হিসাবে ১ বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা।

ঋণ পেতে আইএমএফকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিতে বাংলাদেশ বলেছে, ২০২৬ সালের মধ্যে সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের মধ্যে ও বেসরকারি খাতের ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ চলছে। এ জন্য ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হচ্ছে, যেখানে মূলধন পর্যাপ্ততার হার ও খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।