গাড়ি থেকে নেমে খানিক হাঁটতেই পাশ থেকে এক লোকের কথা শোনা গেল, মোবাইলে ডিজিটাল পেমেন্টের মাধ্যমে টিকিট কেটে নিলে লাইনে দাঁড়ানোর ঝামেলায় যেতে হবে না। তাই কৌতূহল নিয়ে নিজেই মুঠোফোনে মিনিট খানিকের মধ্যে টিকিট কেটে ফেললাম। এরপর প্রধান ফটকে ডিজিটাল টিকিট স্ক্যান করে ঢুকে পড়লাম। সময়টা ভরদুপুর, ভিড় জমেনি। এখানে–ওখানে অল্পসংখ্যব ক্রেতা-দর্শনার্থী দেখা যাচ্ছে।
ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার (ডিআইটিএফ) কথা বলছি। ২০২২ সালে রাজধানীর আগারগাঁও থেকে পূর্বাচলের বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে স্থানান্তরিত হয় এ মেলা। সেখানে আধুনিক ও স্থায়ী অবকাঠামোতে চতুর্থবারের মতো মেলা হচ্ছে। এতে বাহ্যিক কিছুটা পরিবর্তন এলেও আগারগাঁওয়ের বাণিজ্য মেলার বারোয়ারি চেহারা এতটুকু বদলায়নি। কারণ, নতুন জায়গাতেও অধিকাংশ স্টল–প্যাভিলিয়নজুড়ে শুধু গৃহস্থালি পণ্য, তৈরি পোশাক আর খাবারের সম্ভার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এবারে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে অংশ নেওয়া ৩৬২টি প্যাভিলিয়ন, স্টল ও রেস্তোরাঁর মধ্যে বিদেশি প্রতিষ্ঠান মাত্র ১১টি। অনেক বছর ধরেই সংখ্যাটি ১৫-এর নিচে আটকে আছে।
দেশি পণ্যের প্রচার, প্রসার ও বিপণনের পাশাপাশি এসব পণ্যের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যে ১৯৯৫ সাল থেকে ডিআইটিএফ আয়োজন করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। শুরু থেকেই এ মেলায় বারোয়ারি পণ্য বেচাবিক্রি হচ্ছে। ফলে গত তিন দশকেও আন্তর্জাতিক হওয়ার ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি ডিআইটিএফ।
পূর্বাচলের পুরো ডিআইটিএফের মধ্যে প্রদর্শনী কেন্দ্রের হল ‘এ’ কিছুটা পরিকল্পিত বলে মনে হলো। এখানেই নয়টি আসবাব ও ছয়টি ইলেকট্রনিকস ব্র্যান্ডের প্যাভিলিয়ন রয়েছে। সোর্সিং জোনে রয়েছে চা বোর্ড, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, চামড়াজাত পণ্য এবং রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকমালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর প্যাভিলিয়ন।
পাশের হল ‘বি’-তে ঢুকতেই হোটেল-রিসোর্ট ও আবাসন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অনবরত ডাকাডাকি দর্শনার্থীদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই সব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা প্যাভিলিয়নের সামনে দাঁড়িয়ে যাঁকেই পাচ্ছেন, তাঁর কাছেই হোটেল-রিসোর্টের শেয়ার কিনতে বলেন। মূল হলের পেছনে যাওয়া মাত্রই কানে বাজল, রাজধানীর গুলিস্তান–ফার্মগেট ও নিউমার্কেটের ফুটপাতের চিরচেনা সেই হাঁকডাক, ‘দেইখ্যা লন, বাইচ্ছা লন, একদাম ১৩০’। এমন কয়েকটি স্টলে ১০০ থেকে ১৩০ টাকায় গৃহস্থালি পণ্য বিক্রি হচ্ছে। প্রতিটিতেই সুরে সুরে ডেকে ক্রেতাদের আকর্ষণের চেষ্টা করছেন বিক্রেতারা। যদিও এসব পণ্য রাজধানীর অনেক ফুটপাতে পাওয়া যায়। বরাবরের মতো আরেকটি বিষয় চোখে পড়ল, কম দামের ব্লেজারের ভূরি ভূরি স্টল। এ ছাড়া ভুঁইফোড় রেস্তোরাঁও আছে। সালাদ কাটার মেশিন বিক্রির স্টল আগের চেয়ে কমলেও এখনো বেশ কয়েকটি আছে। এসব দোকানদারির কারণে দর্শনার্থীদের মেলায় আসার উদ্দেশ্য যেন নিরুদ্দেশ হওয়ার জোগাড়।
গত বুধবার মেলা প্রাঙ্গণ চার ঘণ্টা ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেল। অবশ্য এটি বারোয়ারি মেলায় পরিণত হওয়ার কারণেও প্রতিদিনই হাজারো মানুষ আসছেন। বেচাবিক্রিও হচ্ছে দেদার। যদিও মেলায় অংশ নেওয়া অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা খুব একটা সন্তুষ্ট নন। তাঁদের দাবি, দূরত্বের কারণে শুক্রবার ছাড়া অন্যান্য দিন ক্রেতা-দর্শনার্থী কম আসেন। এতে বিক্রি আশানুরূপ হচ্ছে না। সব মিলিয়ে মেলার খরচ উঠবে না—এমন শঙ্কা প্রকাশ করলেন কেউ কেউ।
জানতে চাইলে ইপিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, প্রথম এক সপ্তাহ ক্রেতা-দর্শনার্থীর সংখ্যা কম থাকলেও পরে বাড়তে শুরু করে। গত শুক্রবার এক দিনেই আড়াই লাখ মানুষ মেলায় এসেছেন।
পণ্যের প্রচারণায় জোর
আগেই বলেছি, হল ‘এ’ হলো মেলার সবচেয়ে পরিপাটি জায়গা। এখানে ইলেকট্রনিক ও আসবাব ব্র্যান্ডের সঙ্গে সোর্সিং কর্নার রয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই নিজেদের প্যাভিলিয়ন দৃষ্টিনন্দনভাবে সাজিয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান শুধু পণ্যের প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে।
আসবাব খাতের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড হাতিলের প্যাভিলিয়নে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন দর্শনার্থী বেশ আগ্রহ নিয়ে আসবাব দেখছেন। একজন তো আরামকেদারায় বসে তা পরখ করে নিলেন। মেলায় নতুন নকশার খাট, ড্রেসিং টেবিল, রকিং চেয়ারসহ বিভিন্ন আসবাব নিয়ে এসেছে প্রতিষ্ঠানটি। তারা মেলায় ক্রয়াদেশ নিচ্ছে।
যদিও হাতিলের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা শাহ আলম বলেন, ‘বিক্রির চেয়ে আমরা পণ্যের প্রচারেই বেশি জোর দিচ্ছি। শুক্রবারে ভিড় বেশি হলেও অন্যান্য দিন কম হয়। তারপরও খাট, আলমারি ও ড্রেসিং টেবিলের ক্রয়াদেশ পাচ্ছি। কিছু ক্রয়াদেশ আবার বাতিলও হয়ে যায়।’
দেশের ইলেকট্রনিক পণ্য খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন কয়েকটি নতুন পণ্য মেলায় প্রদর্শন করছে। এর মধ্যে রয়েছে ২৯ ইঞ্চি ডিসপ্লেসহ শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি)। তাদের এমন দেড় টন এসির দাম ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। আগামী দু–এক মাসের মধ্যে পণ্যটি বাজারে আসবে। এ ছাড়া ৩২ ইঞ্চি এলইডি ডিসপ্লেসহ ৬৪৬ লিটারের রেফ্রিজারেটর প্রদর্শন করছে তারা। এটি এখনো বাজারে আসেনি।
জানতে চাইলে ওয়ালটন প্যাভিলিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাসুদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মেলায় কোনো পণ্য বিক্রি করছি না। বুকিংও নিচ্ছি না। তবে আমাদের নতুন পণ্যগুলোর বিষয়ে ক্রেতারা বেশ আগ্রহ দেখিয়েছেন। পণ্যগুলো কিনতে ইচ্ছুক এমন ক্রেতাদের তথ্য নিয়ে রেখেছি। পণ্যগুলো বাজারে এলে তাঁদের আমরা অবহিত করব।’
বেচাবিক্রিই মূল লক্ষ্য
হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেরই ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় অংশ নেওয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো পণ্যের বেচাবিক্রি। এর জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে স্টল বা প্যাভিলিয়ন নিয়েছে তারা। যদিও মেলায় বেশ কিছু প্যাভিলিয়ন ও স্টল ফাঁকা রয়েছে। ১ জানুয়ারি মেলা শুরু হওয়ার পর শেষ ১৫ দিনের জন্য ভাড়া দিতে বিজ্ঞাপন দেয় ইপিবি। যে কারণে বুধবারও বাঁশ আর টিন দিয়ে দু-তিনটি স্টলের নির্মাণকাজ চলতে দেখা গেছে।
মেলার পেছনের দিকে গিয়ে দেখা যায়, রেস্তোরাঁর জন্য বিশাল জায়গা। সেখানে নামীদামি ব্র্যান্ডের পাশাপাশি অখ্যাত খাবারের দোকানও আছে। এর পাশেই শিশুপার্ক। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পথে চোখে পড়ে সারি সারি ব্লেজারের দোকান। এক পাশে দেখা গেল, কয়েকজন সুরে সুরে ক্রেতাদের ডাকছেন। আবার পাশাপাশি চার-পাঁচটি স্টলে খেলনা থেকে শুরু করে গৃহস্থালি বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন বিক্রেতারা। ১০০, ১২০ ও ১৩০ টাকায় এসব পণ্য কিনতে ক্রেতাদের বেশ ভিড় দেখা গেল।
মিরপুরের রিলাক্স ফ্যাশন কম দামের ব্লেজার বিক্রি করতে ১০ লাখ টাকা দিয়ে স্টল নিয়েছে। তারা ১ হাজার ৩০০ টাকায় ব্লেজার বিক্রি করছে। প্যান্টসহ কিনলে দাম ৩ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয়কর্মী রনি দাশ বলেন, বিক্রিবাট্টা খুব খারাপ। সারা দিনে ২০-২৫টি ব্লেজার বিক্রি হচ্ছে। এভাবে চললে নির্ঘাত লোকসান হবে।
হল ‘বি’তে ভাইয়া হাউজিং, ম্যানগ্রোভ, ছুটি রিসোর্টসহ কয়েকটি হোটেল-রিসোর্ট ও আবাসন প্রতিষ্ঠান স্টল পেয়েছে। তারা কক্সবাজার ও কুয়াকাটায় হোটেল-রিসোর্টে বিনিয়োগ খুঁজছে। যাঁরাই স্টলগুলোর সামনে দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদেরই বিনিয়োগ করতে বলছেন এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। তাঁরা সারাক্ষণ স্টলের বাইরে দাঁড়িয়ে ডাকাডাকি করায় ক্রেতা-দর্শনার্থীরা বিরক্ত হচ্ছেন।
ডিআইটিএফের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বারোয়ারি মেলা হলেও প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মেলায় আসছেন। মেলা ঘিরে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। তবে ডিআইটিএফকে আন্তর্জাতিক মেলায় রূপ দিতে আমরা এবার কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। সোর্সিং কর্নার চালু করেছি। সেখানে ভালো সাড়া মিলছে।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে আনোয়ার হোসেন বলেন, প্যাভিলিয়ন বা স্টলের বরাদ্দ দু-তিন হাত বদল হয়। মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে অখ্যাত ট্রেডিং ব্যবসায়ীরা প্যাভিলিয়ন বা স্টল পেয়ে যায়। ভবিষ্যতে এটি বন্ধ করার পাশাপাশি স্বনামধন্য দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হবে। একই সঙ্গে বিদেশি ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জানানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। বারোয়ারি মেলা থেকে ধাপে ধাপে বেরিয়ে যাওয়ার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেওয়ার কথা জানান তিনি।
এক কাপ চা
সোর্সিং কর্নারে বাংলাদেশ চা বোর্ডের উদ্যোগে ছয়টি চা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান—মেঘনা, কাজী অ্যান্ড কাজী, ইস্পাহানি, আবুল খায়ের, ফিনলে ও সিটি অংশ নিয়েছে। পাশাপাশি পঞ্চগড়ের একটি চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানও আছে। ক্রেতারা চাইলে বিনা মূল্যে এক কাপ চা খেয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পারছেন। কেনার সুযোগও আছে। চা বোর্ডের বিপণন কর্মকর্তা আহসান হাবিব বলেন, ‘আমাদের দেশে উৎপাদিত চা সম্পর্কে ক্রেতা-দর্শনার্থীদের জানাতে আমরা মেলায় অংশ নিয়েছি।’
দেশের শীর্ষ রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক ও চামড়া পণ্য প্রদর্শনীর জন্য মেলায় পৃথক তিনটি প্যাভিলিয়ন আছে। সোর্সিং কর্নারে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ এবং লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এফএফএমইএবি) প্যাভিলিয়ন তিনটি দিয়েছে। এসব প্যাভিলিয়নে বিভিন্ন ধরনের তৈরি পোশাক, চামড়ার জুতা, ব্যাগ, বেল্ট ইত্যাদি পণ্য প্রদর্শন করা হচ্ছে।
কারাগারে বন্দী থাকা ব্যক্তিরা বিভিন্ন ধরনের পণ্য উৎপাদন করে থাকেন। সেসব পণ্য মেলায় নিয়ে এসেছে কারা অধিদপ্তর। তাদের প্যাভিলিয়নে কারারক্ষীদের তৈরি মোড়া, টুল, দোলনা, চেয়ার, লুঙ্গি, জামদানি, নকশিকাঁথা, শোপিসসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ জেলের সহকারী প্রধান রক্ষী খন্দকার মনির বলেন, একটি পণ্য বিক্রি হলে লাভের ৫০ শতাংশ বন্দীরা পান। মেলায় ৩২-৩৫টি কারাগারের বন্দীদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হচ্ছে।