বিশ্লেষণ

ঈদে দেশে ফেরা মানুষের বঞ্চনা ও উন্নয়ন

ঝুঁকি নিয়ে ঘরে ফেরা। আজ বৃহস্পতিবার সকালে দৌলতদিয়া ঘাট সড়কে।
ছবি। এম রাশেদুল হক

এক সিএনজি অটোচালকের কাছে এক বৃদ্ধ ভিক্ষুকের গল্প শুনেছিলাম। গল্পটা এ রকম: সন্তানদের দ্বারা ঘর থেকে বিতাড়িত নেত্রকোনার সেই বৃদ্ধ প্রতি রোজায় ঢাকায় আসতেন। থাকতেন সেই চালকের পাশের ঘরে। দিনরাত ভিক্ষা করে ভালোই উপার্জন হতো। এমনকি রোজার সময় মানুষ বৃদ্ধকে ফলমূলও দিত। সেই ফল দিয়ে তিনি সিএনজি অটোচালকের পরিবারের সঙ্গে ইফতার করতেন। ভিক্ষার টাকা রাখতেন আবার চালকের কাছে। চালকের হিসাবমতে, প্রতি রোজায় সেই বৃদ্ধ এক মাস ঢাকায় থেকে ৬০-৭০ হাজার টাকা জমিয়ে বাড়ি ফিরতেন। সেই টাকা দিয়েই তাঁর সারা বছরের খোরাকি হয়ে যেত। তবে গত দুই বছর ধরে বৃদ্ধ আর ঢাকায় আসছেন না।

ব্যাপারটা হলো, নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে ঢাকা নিছক অর্থ উপার্জনের জায়গা ছাড়া কিছু নয়। তারা যে আয় করেন, তা দিয়ে এই শহরে কিছু করা সম্ভব নয়। ফলে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে যে আয় হয়, তা জমিয়ে গ্রামে কিছু একটা করাই তাঁদের লক্ষ্য। এই শহরে তাঁদের অংশীদারি নেই বলেই বিধিনিষেধের মধ্যে গণপরিবহন বন্ধ থাকা সত্ত্বেও ঘরে ফেরার এই তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁদের। অথচ এই যাত্রায় খরচ হচ্ছে কয়েক গুণ। সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তাঁদের। কথা একটাই, বাড়ি গিয়ে মা-বাবার সঙ্গে ঈদ করতে হবে।
গণপরিবহন বন্ধ থাকায় এবার ঈদে মধ্যবিত্তের বাড়ি যাওয়া একরকম বন্ধ হলেও শ্রমজীবী মানুষের এই বাড়ি ফেরার আকুতি দেখে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়, আমাদের সমাজটা এখন দুই ভাগে বিভক্ত। পাকিস্তান আমলে যেমন ছিল দুই অর্থনীতি, এখন সেখানে দুই সমাজ। অধ্যাপক রেহমান সোবহান তাই যথার্থই বলেছেন, ফ্রম টু ইকোনমিস টু টু সোসাইটিস।

নগরায়ণ ও সামাজিক নিরাপত্তা

উন্নয়নশীল দেশে অর্থনৈতিক বিকাশের সাধারণ নিয়মেই গ্রামের মানুষ শহরে আসবে। কিন্তু সেই শহরে তাঁর কপালে জোটে স্যাঁতসেঁতে বস্তির আলো-বাতাসহীন ঘিঞ্জি ঘর। তাই দেখা যায়, ঘরের চেয়ে বাইরেই তাঁরা বেশি সময় কাটায়। রাজধানীর হাতিরঝিল লাগোয়া বস্তির মানুষদের ঘুমানোর আগ পর্যন্ত ফুটপাতে বসে থাকার দৃশ্য সেই রাস্তায় যাতায়াতকারীদের নিশ্চয়ই চোখে পড়ে।

বাস্তবতা হলো, এই নগরায়ণের খপ্পরে পড়ে যাঁরা শহরে আসছেন, তাঁরাই সবচেয়ে অরক্ষিত। মহামারির মতো দুর্যোগের অভিঘাত তাঁদের জীবনেই সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়। পিপিআরসি ও বিআইজিডির এক যৌথ সমীক্ষায় দেখা গেছে, শহরে বস্তিবাসীর আয় কমেছে। এই বছরের মার্চে শহরের বস্তিবাসীদের ঘরপ্রতি সঞ্চয় ১৬ হাজার ৭০৭ টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ১১ শতাংশ কমেছে। এ বছরের মার্চে এই মানুষের ঋণের পরিমাণ ৪২ হাজার ৯৬১ টাকায় দাঁড়িয়েছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারির চেয়ে যা ৮৬ শতাংশ বেশি। অথচ শহরের এই শ্রমজীবীদের কথা মাথায় রেখে দেশের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রণীত হয় না। শহরের শ্রমজীবীদের আয় গ্রামের চেয়ে বেশি হলেও তাঁদের জীবন অনেক বেশি অরক্ষিত। শহরের এই জীবনে নেই মর‌্যাদা, তাই ঈদের মতো উৎসবে তাঁদের এভাবে গ্রামে ফেরার তাড়া।

প্রণোদনা

সরকারের প্রণোদনা বড় ব্যবসায়ীদের ঘরেই গেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত কিছুটা পেয়েছে। কিন্তু শহরের এই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবী মানুষ কিছুই পাননি। অথচ এরাই শ্রমশক্তির ৮৬ শতাংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিন দফার যে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, তাতে নতুন অভিবাসী ছাড়া আর প্রায় সবার কাছেই নগদ অর্থের চেক পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এবার ১ হাজার ৪০০ ডলারের চেক দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য ধনী দেশেও তা হয়েছে। সে কারণে ওই সব দেশে এখন সঞ্চয় বেড়ে গেছে। এমনকি এই প্রণোদনার ওপর ভর করে এবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধির হার ১৯৮৬ সালের পর ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

আমাদের দেশেও ৩৫ লাখ গরিব পরিবারকে পরপর দু বছর এককালীন ২ হাজার ৫০০ টাকা নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এ জন্য সরকার এবার ৯৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এ টাকা যে যথেষ্ট নয়, তা বলাই বাহুল্য। কথা হচ্ছে, অর্থনীতি সচল রাখতে ভোগব্যয় বাড়ানোর বিকল্প নেই। আমাদের মতো দেশের সরকারের অত টাকা নেই। আবার নানা কারণে সরকার ঋণও বাড়াতে পারে না। সে কারণে আইএমএফের এক অর্থনীতিবিদের পরামর্শ বিবেচনা করা যেতে পারে। সেটা হলো, ধনীদের টাকায় পুনরুদ্ধার তহবিল তৈরি। এ ছাড়া মহামারির মধ্যে যেসব খাতের ব্যবসা ভালো হয়েছে, তাদের ওপর অতিরিক্ত করারোপ করা যেতে পারে। বলা বাহুল্য, আমাদের কর-জিডিপির অনুপাত এখন ১০ শতাংশের নিচে। উন্নয়নশীল দেশের মানদণ্ডেও যা অনেক কম।

সরকার এখন বয়স্ক ও বিধবা ভাতা দিচ্ছে। অসহায়, পঙ্গু, দরিদ্র পরিবারের গৃহবধূ—এই শ্রেণির মানুষদের প্রতি মাসে ভাতা দেওয়া গেলে তাঁদের ভোগব্যয় বাড়বে। নারীরও ক্ষমতায়ন হবে।

দুই সমাজ

এত ঝুঁকি নিয়ে ও কষ্ট করে কেন বাড়ি যাচ্ছেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই প্রশ্নের জবাবে শ্রমজীবী মানুষেরা কিন্তু তাঁদের প্রতি সরকারের উদাসীনতার দিকেই আঙুল তুলেছেন। বলেছেন, ‘লকডাউনের মধ্যে নিজের বিপদ নিজেই সামলেছি, এখন কিছু হলেও নিজেকেই সামলাতে হবে। আর মরি-বাঁচি, বাবা-মা ছাড়া ঈদ করমু না।’

অনেক ভাসমান শ্রমিক নির্মাণাধীন ভবনে থাকতেন, কিন্তু ঈদের ছুটিতে তাঁদের সেখানে থাকতে দেওয়া হবে না বলে গ্রামে ফিরছেন, এমন কথাও জানা গেছে। এই ভাসমান মানুষদের কারওয়ান বাজারসংলগ্ন হাতিরঝিলের নোংরা পানিতে গোসল করতে দেখা যায়। এই মানুষদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা না গেলে নগর ব্যবস্থাপনা সম্ভব নয়, এ কথা মাথায় রাখা দরকার। এটা নিছক সমাজতন্ত্রের কথা নয়, অনেক উন্নত দেশেই সে ব্যবস্থা আছে।

শহরে মাথা গোঁজার শোভন ব্যবস্থা, সন্তানের শিক্ষা, চিকিৎসা নিশ্চিত করা গেলে এবং সর্বোপরি আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি করা গেলে এই মানুষেরা হয়তো এভাবে শহর ছাড়তেন না। তাতে মহামারির ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা হ্রাস পেত। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার গতি পেত। কথা হচ্ছে, অধিকাংশ মানুষকে বিপন্ন করে উন্নয়ন হতে পারে না। উন্নয়নের জন্যই তাই গণতন্ত্র দরকার।