Thank you for trying Sticky AMP!!

বিভিন্ন দেশে পট ও নট পরিবর্তন হতে পারে

>পুরো বিশ্বই এখন করোনাযুদ্ধে লিপ্ত। মানুষের প্রাণ বাঁচাতে হিমশিম খাওয়া রাষ্ট্রগুলোর সামনে আরও আছে বিপর্যস্ত অর্থনীতি। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। করোনায় তছনছ হয়ে যাওয়া অর্থনীতি ফিরবে তো আগের অবস্থায়? কর্মহীন বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান হবে তো? স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিতে কোনো উন্নতি হবে কি? প্রশ্নগুলো এখন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে। যদিও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে এরই মধ্যে লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। তবু দেশজুড়ে ক্ষুধার্ত ও কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। করোনা-পরবর্তী অর্থনীতি, রাজনীতি, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সামাজিক খাতে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে, তা নিয়েই এই আয়োজন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

মোটামুটি সবাই একমত যে করোনা অতিমারি (মহামারির চেয়ে ভয়াবহ রূপ) উত্তর পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে তার সূচনাবিন্দুতে ফিরে যাবে না।

এই মতামত দুভাবে বিভক্ত। এর মধ্যে আশাবাদী পক্ষ মনে করে, এই দুর্যোগের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বুঝব যে দেশের সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা কত প্রয়োজন, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, বহুত্ববাদ ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন কতটা জরুরি। আর দেশকে শক্তিশালী করার জন্য মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আবশ্যক।

নিরাশাবাদী পক্ষের (হতাশাবাদী বলছি না) মতে, করোনার প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার আগে বিশ্বে যে পরিস্থিতি ছিল, যেমন অর্থনীতি নিম্নগামী ছিল, বহুপক্ষীয় অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ছিল, পরিবেশ সুরক্ষা দুর্বল হচ্ছিল, বৈষম্য বাড়ছিল—এই নেতিবাচক প্রবণতাগুলো আরও বেগবান হবে। বিশ্ব একটি নিয়ন্ত্রিত ও শক্তিশালীদের ইচ্ছাভিত্তিক ব্যবস্থায় পরিণত হবে। সহযোগিতার বদলে আগ্রাসী মনোভাব প্রাধান্য পাবে।

বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তিত রূপ বাংলাদেশের ওপরও প্রভাব ফেলবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কোনো প্রভাবক বা নির্ধারক নয়। বাংলাদেশ প্রাপক ও গ্রাহক। বৈশ্বিক পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে আমরা কতটা খাপ খাওয়াতে পারব, তা দেশের ভেতরে করোনা–উত্তর পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, সেটার ওপর অনেকটা নির্ভর করে।

করোনাভাইরাস বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে ভঙ্গুরতাগুলো নিষ্ঠুরভাবে উন্মোচন করেছে। যেমন অপর্যাপ্ত কর আহরণ, ব্যাংকব্যবস্থা ও পুঁজিবাজারের দুর্বলতা, অবৈধ টাকা পাচার, অতিমূল্যায়িত বড় প্রকল্প ইত্যাদি কারণে সরকারের ব্যয় করার সক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। সংস্কারের অভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা ও সমন্বয় খুবই দুর্বল। স্থানীয় সরকারের যোগ্যতার অভাব প্রকট।

আমরা দৃশ্যমান বড় প্রকল্পের বিপরীতে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) অনুপাতে খুব সামান্য বরাদ্দ দিয়ে এসেছি। সে জন্য আজ দুর্বল স্বাস্থ্য খাত যথোপযুক্তভাবে কাজে আসছে না। নিম্নমধ্যবিত্তের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা না থাকায় মানুষ যে কতটা অসহায়, তাও প্রকাশ্য। একধরনের রাজনৈতিক শূন্যতাও প্রকাশ পেয়েছে, যেটা তৈরি হয়েছে প্রতিযোগিতাপূর্ণ ও জবাবদিহিমূলক রাজনীতির অনুপস্থিতিতে।

দেশে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে যেসব ভঙ্গুরতা ছিল, করোনা অতিমারির ফলে তা আরও গভীর হওয়ার আশঙ্কা বেশি। যেমন দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি, দায়-দেনা ও বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং বৈষম্য বাড়তে পারে। একটি নজরদারিভিত্তিক নিয়ন্ত্রিত সমাজ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেখানে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব আরও বাড়তে পারে। পাশাপাশি নতুন ক্ষমতার উৎস ও শক্তি উঠে আসতে পারে।

এই সময়কালে আমরা দেশের কিছু শক্তির দিকও দেখেছি। যেমন সরকারের প্রধান নির্বাহীর আন্তরিকতা ও একাগ্ৰতা, তৃণমূল পর্যায়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টা, ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধির সুফল, সাধারণভাবে নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত সহমর্মিতা ইত্যাদি।

এখন কথা হলো, বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে। আমি চারটি সম্ভাব্য রূপকল্প দেখি। প্রথমত, এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে প্রচলিত ক্ষমতাবান ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের প্রাধান্য আরও একচ্ছত্র হবে। দ্বিতীয়ত, ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশ একটি নিবর্তনমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। তৃতীয়ত, আমরা সদাশয় কর্তৃত্ববাদী সরকার দেখতে পারি। চতুর্থত, বিকাশমান আর্থসামাজিক শক্তির রাজনৈতিক ঐক্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হতে পারে।

আমাদের পথরেখা কোন দিকে অগ্রসর হবে, সেটা নির্ভর করছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতা, অন্য প্রচলিত রাজনৈতিক শক্তির মনোভাব ও সক্রিয়তা, সামাজিক আন্দোলনের সুগঠিত কার্যকলাপ এবং নাগরিক মনোভাবের স্বতঃস্ফূর্ত অভিপ্রকাশের ওপর।

নিঃসন্দেহে চারটি সম্ভাবনার ভেতরে শেষেরটি দেশের জন্য সবচেয়ে কাম্য। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের একটি বড় অর্জন হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ। এই শ্রেণি অতিমারির কারণে চরমভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমরা একটি আমলানির্ভর, ব্যবসায়ীমুখী ও গরিব মানুষের জন্য একটি অদক্ষ ব্যবস্থাপনাই দেখতে পাচ্ছি। মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মনোভাব ও প্রতিক্রিয়া কী হয়, তা বাংলাদেশের সম্ভাব্য পথরেখাকে প্রভাবিত করবে।

সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এমন একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে, যেটি বৈশ্বিক ব্যবস্থার অনুষঙ্গ এবং সেটার ভেতর দিয়ে বিভিন্ন দেশে পট ও নট পরিবর্তন হতে পারে। দেখার বিষয়, জাতীয় বাস্তবতায় আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশে এই প্রক্রিয়া কীভাবে প্রতিফলিত ও প্রকাশিত হয়।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : বিশেষ ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)