
ইরান ও ইসরায়েলের সামরিক সংঘাতের তীব্রতা বাড়লে বা তা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নিলে বিশ্ব অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা। অতীতে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। এ কারণে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুদ্ধ শুরু হলে কী হবে, স্বাভাবিকভাবেই তা নিয়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
ইরানের প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা হলে কিংবা হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে এর অভিঘাত শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থনীতি ও জ্বালানির সরবরাহব্যবস্থায় গভীর প্রভাব পড়বে। এই অভিঘাত থেকে বাংলাদেশও মুক্ত থাকবে না।
হরমুজ প্রণালি বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্যপথ। এই পথ দিয়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল—বৈশ্বিক সরবরাহের প্রায় ২০ শতাংশ—পরিবাহিত হয়। এই প্রণালি সাময়িকভাবে বন্ধ হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম একঝটকায় অনেকটাই বেড়ে যাবে। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ বা ২০১৭ সালে সৌদি আরবের তেল স্থাপনায় হামলার সময় দেখা গেছে, এমন সংকটে তেলের দাম অনেকটাই বেড়ে যাবে।
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি
বাংলাদেশ জ্বালানি-আমদানিনির্ভর অর্থনীতি। দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি বড় অংশ গ্যাস ও তেলের ওপর নির্ভরশীল, বিশেষত এলএনজি ও পরিশোধিত জ্বালানি তেল। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বাড়বে, যার প্রভাব সরাসরি পড়বে শিল্প উৎপাদন, পরিবহন, কৃষি ও খুচরা বাজারে। ফলস্বরূপ, দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং ভোক্তা পর্যায়ে জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বেড়ে যাবে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি আমদানি করে। এসব দেশের একাধিক কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি আছে। কাতার থেকে এলএনজি আমদানির একমাত্র পথ হরমুজ প্রণালি। জ্বালানি–বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হরমুজ প্রণালি ইরান দীর্ঘ মেয়াদে বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশে এলএনজি আমদানির স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার বড় শঙ্কা রয়েছে। তাতে গ্যাস সরবরাহে প্রভাব পড়বে। এমনিতেই দেশের শিল্প খাতে গত কয়েক বছরে একাধিকবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে এলএনজি আমদানির ব্যয় বাড়লে তার ভার ব্যবসায়ীদের কাঁধেই বর্তাবে। এতে দেশের শিল্পোৎপাদনে প্রভাব পড়বে। শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির গতি কমে যাবে। সামগ্রিকভাবে আরও বিপদে পড়বে অর্থনীতি।
দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এখন ইরান–ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকবে না। বেড়ে যাবে দারিদ্র্য। এমনিতেই বিশ্বব্যাংক বলেছে, চলতি বছর দেশের চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৩০ লাখ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। মূলত প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়ায় এই পূর্বাভাস করেছে তারা। এখন তার সঙ্গে আরেক দফা মূল্যস্ফীতি হলে পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি হতে পারে বলেই শঙ্কা।
মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধি নিয়ে শঙ্কা
বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর বিষয়। খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবন–জীবিকায় প্রভাব ফেলে এবং অর্থনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী চাপ সৃষ্টি করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মুদ্রানীতির রাশ টেনে ধরতে হয়; কিন্তু এতে আবার বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অন্যদিকে আমদানি করা জ্বালানির ব্যয় বৃদ্ধি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে আবারও চাপ সৃষ্টি করবে। টাকার মান দুর্বল হলে অন্যান্য পণ্য আমদানির খরচ বেড়ে যাবে এবং সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে।
অর্থনীতি এমনিতেই একধরনের স্ট্যাগফ্লেশনে(উচ্চ মূল্যস্ফীতি+ নিম্ন প্রবৃদ্ধি) আছে—যেখানে প্রবৃদ্ধি গেলেও মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে—এখন ইরান-ইসরায়েলে যুদ্ধের কারণে স্ট্যাগফ্লেশনের চাপ বাড়লে অর্থনীতি সংকোচনের ধারায়ও চলে যেতে পারে। ২০২২ সালে দেশে যে ডলারের সংকট ও মূল্যস্ফীতিজনিত সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়, তার পেছনেও ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধজনিত জ্বালানির তেলের মূল্যবৃদ্ধি। সেই যুদ্ধের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে না উঠতে এখন ইরান-ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলা দেখে ঘরপোড়া গরুর মতো সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
শুধু জ্বালানি নয়, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিঘ্ন ঘটবে। এই প্রণালি বন্ধ না হলেও যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে বিশ্ববাণিজ্য ব্যাহত হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি রপ্তানিনির্ভর। তৈরি পোশাক খাত বৈদেশিক আয়ের প্রধান উৎস। পণ্য পরিবহনে বিলম্ব হলে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে। ফলে ক্রয়াদেশ বাতিলের ঝুঁকি, মূল্যছাড় দিতে বাধ্য হওয়া বা বাজার হারানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
শ্রমবাজার ও প্রবাসী আয়
মধ্যপ্রাচ্য বাংলাদেশিদের প্রধান শ্রমবাজার। ইরান ও তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোয় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে এই অঞ্চলে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়বে। এর আগেও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের সময় বাংলাদেশি শ্রমিকেরা দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। তবে ইরান ও ইসরায়েল কোনো দেশেই বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিক তেমন একটা নেই, ফলে এই যুদ্ধের কারণে সরাসরি বাংলাদেশি শ্রমিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কিন্তু সমস্যা হলো, এই যুদ্ধে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সমর্থনে এগিয়ে আসছে এবং ইরান মুসলিম দেশগুলোর সহায়তা চাইছে, তাতে এটি শিগগির আঞ্চলিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
সে ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশে কাজের সংকট হবে। ফলস্বরূপ, রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কমবে, যদিও এটিই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম প্রধান উৎস। গত মে মাসের হিসাব অনুযায়ী, ইরান বাংলাদেশের শীর্ষ ৩০টি প্রবাসী আয়ের উৎস–দেশের মধ্যে নেই, কিন্তু হরমুজ প্রণালির পাশের দেশ ওমান বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের ষষ্ঠ বৃহত্তম উৎস।
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যের নির্মাণ খাত, পরিষেবা খাত ও আবাসন খাত স্থবির হয়ে যেতে পারে। ফলে প্রবাসী শ্রমিকদের হঠাৎ করে কাজ হারানোর সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। চলমান যুদ্ধ কিংবা অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো নতুন কর্মী নেওয়া বন্ধ করতে পারে বা নিয়োগ কমিয়ে দিতে পারে। সেই সঙ্গে বিমান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে উড়ান বাতিল বা সীমিত হলে শ্রমিকদের যাতায়াতেও ব্যাঘাত ঘটবে। চলাচল করা গেলেও ব্যয় বৃদ্ধির আশঙ্কা থেকে যায়।
বিমান পরিবহন
গত শুক্রবার ইসরায়েলের হামলার পরপরই বাণিজ্যিক বিমান চলাচলে এর তাৎক্ষণিক প্রভাব দেখা যায়—এমনটাই দেখা গেছে ফ্লাইট ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট ফ্লাইট রাডারের এক টাইমল্যাপস ভিডিওতে। ইরানের আকাশে দিয়ে চলা বিমানের সংখ্যা প্রায় শূন্যে নেমে আসে। ইউরোপ থেকে এশিয়াগামী যাত্রীবাহী বিমানগুলো ইরানকে এড়িয়ে দুপাশ দিয়ে উড়ে যায়। হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দেখা যায়, অনেক বিমান মাঝ আকাশ থেকেই পথ বদলে ইরানের আকাশ ছেড়ে অন্য করিডরে চলে যাচ্ছে।
বিমানগুলোর এই গণহারে পথ পরিবর্তন এবং ইরানের আকাশপথ এড়িয়ে চলার যে প্রবণতা, তাতে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে জানা যায়, বাংলাদেশের হাতে গোনা কয়েকটি বিমান ইরানের আকাশসীমা ব্যবহার করে। ফলে খুব একটা প্রভাব পড়বে না বলে জানান বেসামরিক বিমান চলাচল খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। টিকিটের দাম বৃদ্ধির সম্ভাবনা কম। সে ক্ষেত্রে কেবল বিমানের সূচি পরিবর্তন করতে হয়। মে মাসে ভারত–পাকিস্তানের তিন দিনের যুদ্ধের সময়ও সূচি এগিয়ে আনা হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সেলিম রায়হান বলেন, সামগ্রিকভাবে এই যুদ্ধ পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে তাৎক্ষণিক হবে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং সে কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতির চাপ। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে; বেড়ে যাবে শিল্পের খরচ। এ ছাড়া বাণিজ্যের ব্যয় বেড়ে যাওয়া, প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বিকল্প জ্বালানির উৎস খোঁজা, এলএনজি সরবরাহের জন্য দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করা, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়ানো ও অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন বলে পরামর্শ দেন সেলিম রায়হান।
ইরান–ইসরায়েল যুদ্ধ পরিস্থিতি এমন সময় সৃষ্টি হলো, যখন বিশ্ববাজার এমনিতেই নানা অনিশ্চয়তায় জর্জরিত। সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে আমদানির ওপর উচ্চহারে শুল্ক বসানোর হুমকি ইতিমধ্যে বিশ্ববাণিজ্যকে বিপর্যস্ত করেছে। বিনিয়োগকারীরা হারাচ্ছেন আস্থা। এতে ভোক্তা ব্যয় ও ব্যবসার খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির গতি মন্থর হয়ে পড়ছে।