নতুন অর্থবছর শুরু

তবু তিন চ্যালেঞ্জের মুখে অর্থনীতি

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি কমানোর পাশাপাশি রাজস্ব ও বিনিয়োগ বাড়ানো, নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা দূর, ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অনিশ্চয়তা ।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১১ মাস পার হচ্ছে, আরেকটি নতুন অর্থবছর শুরু হয়েছে। আগের সরকারের সময় অর্থনীতির প্রায় সব সূচক ছিল নিম্নমুখী। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার টানা ১৫ বছরের বেশি ক্ষমতায় থেকেও সংকটে পড়া অর্থনীতিকে টেনে তুলতে জোরালো কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর অর্থনীতিতে সংস্কার ও পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।

ফলে রিজার্ভের পতন যেমন থামানো গেছে, তেমনি ব্যাংক খাতের ভঙ্গুর দশার কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। ডলারের বাজারেও স্থিতিশীলতা ফিরেছে। গত এক বছরে নানা ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যেও রপ্তানি আয়ে বড় অগ্রগতি না হলে ছিল সন্তোষজনক। বৈধ পথে প্রবাসী আয়ের প্রবাহও খুব ভালো ছিল।

অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে কিছু অগ্রগতি হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত স্বস্তি আসেনি। কারণ, মূল্যস্ফীতির চাপ পুরোপুরি সামাল দেওয়া যায়নি। মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও এখনো সাধারণ মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির যথেষ্ট চাপ রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগও অনেকটা স্থবির। ফলে কর্মসংস্থান আশানুরূপ বাড়েনি। উল্টো আশঙ্কা করা হচ্ছে, গরিব মানুষের সংখ্যা বাড়তে পারে।

রিজার্ভের পরিমাণ দেখে মনে হচ্ছে, এটি ভালো আছে। কিন্তু আমদানি খরচ কম হওয়া এবং বিদেশি ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় রিজার্ভ বেড়েছে। তাই রিজার্ভ পরিস্থিতি ভালো, এটা বলা যাবে না।
—সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম

এমন অবস্থায় নতুন অর্থবছরে (২০২৫-২৬) অর্থনীতিতে তিন ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি কমানোর পাশাপাশি রাজস্ব ও বিনিয়োগ বাড়ানো, নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা দূর করা এবং ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ।

জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অর্থনীতিতে দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে। কারণ, অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নির্বাচনের বছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিতে কিছুটা শ্লথগতি থাকে। নতুন ব্যবসা চালুর ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতি অবলম্বন করেন উদ্যোক্তারা। ব্যবসা-বাণিজ্যে কিছুটা মন্দাভাব থাকে।

এ ছাড়া ৯ জুলাই থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পাল্টা শুল্ক আরোপের স্থগিতের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। নতুন বন্দোবস্ত না হলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের রপ্তানি বিপাকে পড়তে পারে।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি, বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং রাজস্ব আদায়ে নাজুক পরিস্থিতি বিদ্যমান। রিজার্ভের পরিমাণ দেখে মনে হচ্ছে, এটি ভালো আছে। কিন্তু আমদানি খরচ কম হওয়া এবং বিদেশি ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় রিজার্ভ বেড়েছে। তাই রিজার্ভ পরিস্থিতি ভালো, এটা বলা যাবে না।

সেলিম রায়হানের মতে, অর্থনীতি এখনো চাপের মধ্যে আছে। সরকারের ভাষ্য অনুসারে, চলতি অর্থবছরে নির্বাচন হবে। কিন্তু শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে কি না, তা নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অস্বস্তি আছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মার্কিন প্রশাসনের পাল্টা শুল্ক আরোপ হলে রপ্তানি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা নিয়েও দুশ্চিন্তা আছে।

যেসব সূচকে উন্নতি

অর্থনীতিতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম বড় সাফল্য হলো বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের (রিজার্ভ) পতন ঠেকানো গেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম-৬ হিসাব অনুসারে, ৯-১০ মাস ধরে রিজার্ভ ২ হাজার কোটি ডলারের বেশিই আছে। সর্বশেষ গত রোববারের হিসাবে, মোট রিজার্ভ ছিল ৩১ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী, ওই দিন রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ২৬ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারে।

রিজার্ভ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ—বৈধ পথে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ এবং রপ্তানি আয় বৃদ্ধি। একদিকে আমদানি প্রবৃদ্ধি কমেছে। অন্যদিকে সর্বশেষ জুন মাসের শেষ সপ্তাহে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছ থেকে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের মতো অর্থঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। এসব কারণে রিজার্ভ বেড়েছে।

এ ছাড়া ডলারের দামও একটি স্থিতিশীল জায়গায় রয়েছে, যা অর্থনীতিতে নতুন করে স্বস্তি দিয়েছে।

অর্থনীতিতে অস্বস্তি

নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে তিন বছরের বেশি সময় ধরে সাধারণ মানুষ বেশ কষ্টে আছেন। ১৯৮৬ সালের পর দেশে কখনোই এত দীর্ঘ সময় ধরে এমন মূল্যস্ফীতি দেখা যায়নি। কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ঘরে নেমেছে। কিন্তু বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসের (জুলাই-মে) হিসাবে, গড় মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ।

গত ১১ মাসে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। গত জুলাই মাসে এই হার ওঠে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বৃদ্ধি না পাওয়ায় মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, ঝুঁকিতে থাকা প্রায় ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে অতিদরিদ্র হয়ে যেতে পারেন।

এদিকে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতিও নাজুক। বিদায়ী অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ৩ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব আদায় করেছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নানা শর্তের পরও কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় বাড়াতে পারছে না এনবিআর।

গত এক দশকের মতো বিদায়ী অর্থবছরেও দেশি–বিদেশি বিনিয়োগ অনেকটা স্থবির ছিল। দেশি–বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে যেসব বাধা রয়েছে, সেগুলো পুরোপুরি দূর হয়নি। নীতি ধারাবাহিকতার অভাব, নিবন্ধন, লাইসেন্স গ্রহণসহ নানা ক্ষেত্রে জটিলতা বিনিয়োগের পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে রয়েছে। তার সঙ্গে আছে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট।