মো. শাহীন ইকবাল
মো. শাহীন ইকবাল

অভিমত

ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এখন উদ্বৃত্ত ডলার, চাহিদা না থাকায় দামও কমছে

ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এখন বৈদেশিক মুদ্রা ডলারের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি। অনেক দিন ধরেই এই উদ্বৃত্ত অবস্থা বিরাজ করছে। তাই আমরা কয়েক মাস আগে থেকেই ধারণা করছিলাম, একসময় ডলারের দামে তার প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে গত ঈদুল আজহার আগে ডলারের সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে দামে প্রভাব দেখা যাচ্ছিল। আমাদের প্রবাসী ও রপ্তানি আয় ধারাবাহিকভাবে বাড়ছিল। এ কারণে আমরা অনুধাবন করছিলাম, একসময় না একসময় ডলারের দামে তার প্রভাব পড়বেই। সম্প্রতি সেটি আমরা দেখলাম। পাশাপাশি ডলারের বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা যাতে তৈরি না হয়, সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কয়েক দিন বড় অঙ্কের ডলার কেনার ঘটনাও দেখলাম। বিশ্বজুড়েই এটি হয়ে থাকে। দামের অস্থিরতা তৈরি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করে।

আমরা দেখেছি, কয়েক বছর আগে দেশে ডলারের সংকট দেখা দেওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। বিশেষ করে আমদানির ওপর এসব আরোপ করা হয়। তাতে আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। আবার দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে উৎপাদন খাতও সংকুচিত হয়েছে। এ কারণে শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়েনি। নতুন বিনিয়োগ বা ব্যবসা সম্প্রসারিত না হওয়ায় শিল্পের যন্ত্রপাতি বা কাঁচামালের চাহিদাও অনেক কমে গেছে। সে কারণে ডলারের চাহিদা কমতে থাকে। আবার ডলার–সংকটের সময় বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের পাওনাও আটকে যায়।

গত বছরের মাঝামাঝি থেকে যখন প্রবাসী ও রপ্তানি আয় বাড়তে শুরু করে, তখন আটকে যাওয়া পাওনাও ধাপে ধাপে পরিশোধ করা শুরু হয়। সে কারণে বেশ কিছুদিন ডলারের চাহিদা ভালো ছিল। এখন মোটামুটি আমাদের পুরোনো পাওনা বা দায় পরিশোধ শেষ পর্যায়ে। দায় পরিশোধের কারণে ডলারের চাহিদা কমে গেছে। একই সঙ্গে আমদানির চাহিদাও কম। ফলে গত রোজার ঈদের পর থেকে আমরা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ডলারের উদ্বৃত্ত দেখতে পাচ্ছিলাম। তখন থেকেই আমাদের আশঙ্কা ছিল, চাহিদা কমে যাওয়ায় ডলারের দামও কমবে। সম্প্রতি সেই পরিস্থিতি দেখা গেল। এ কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রতি ডলারের দাম কমে ১২০ টাকার নিচে নেমে যায়। তখনই বাংলাদেশ ব্যাংক ১২১ টাকা ৫০ পয়সা করে বড় অঙ্কের ডলার কিনল বাজার থেকে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত সিদ্ধান্ত ছিল।

ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যে ডলার কেনাবেচা বা লেনদেন হয়, তা মূলত কাগুজে বা বৈধ চাহিদা। এ ব্যবস্থায় তাৎক্ষণিক নগদ লেনদেন কম। খোলাবাজারে ডলারের যে লেনদেন হয়, তার পুরোটাই নগদ কেনাবেচা। সেখানে বৈধ ও অবৈধ—উভয় চাহিদাই থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিদেশ ভ্রমণের জন্য কোনো গ্রাহক ডলার কিনতে এলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী যে পরিমাণ ডলার বিদেশ ভ্রমণে তিনি ব্যবহার করতে পারবেন, তার বেশি ডলার ব্যাংক বিক্রি করবে না; কিন্তু খোলাবাজারে যে কেউ চাইলে নিয়মের বেশি বা প্রয়োজনের বেশি নগদ ডলার কিনতে পারেন। সে কারণে ব্যাংকিং ব্যবস্থা তথা বৈধ পথে ডলারের চাহিদা কিছুটা কমলেও খোলাবাজারে সেভাবে কমছে না। ফলে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ডলারের দাম কিছুটা কমলেও খোলাবাজারে সেভাবে কমেনি। আবার খোলাবাজারের সঙ্গে ব্যাংকে ডলারের দামের বড় ধরনের তারতম্য যেন না ঘটে, সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার কিনে দাম স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছে। কারণ, ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে ডলারের দামের পার্থক্য বেশি হয়ে গেলে বৈধ পথে প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সে কারণে ডলারের বাজারে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপকে আমি যৌক্তিক মনে করি।

বাংলাদেশ ব্যাংক সব সময় বাজারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে দাম স্থিতিশীল রাখবে তা–ও নয়। কখনো কখনো নানাভাবে বার্তা দিয়েও ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখতে পারে। যেমন নির্দিষ্ট সীমার নিচে দাম নেমে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে হস্তক্ষেপ করবে। তখন দেখা যাবে, দাম আর ওই সীমার নিচে নামছে না। ফলে বাজারের অস্থিরতাও কমবে।

মো. শাহীন ইকবাল

উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ট্রেজারিপ্রধান, ব্র্যাক ব্যাংক