কেমন বাজেট চাই

ব্যাংক খাত পুনর্গঠনে বাজেটে চাই সাহসী পদক্ষেপ ও কাঠামোগত সংস্কার

আগামী ২ জুন ঘোষিত হতে যাচ্ছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের এটিই প্রথম বাজেট। দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে বাজেটকে ঘিরে তাই বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের প্রত্যাশাও বেশি। তাঁরা চান ব্যবসা-বাণিজ্যের পথে যেসব বাধা রয়েছে, সেগুলো দূর করার দিকনির্দেশনা থাকবে বাজেটে। বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের বাজেট প্রত্যাশা নিয়েই এবারের মূল আয়োজন।

আগামী বাজেটে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষায় এবং দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠনের জন্য কাঠামোগত ও প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা থাকা উচিত। আমানতের সুরক্ষায় সম্পূর্ণ আমানত বিমা চালু করে আমানতকারীদের আস্থা পুনঃস্থাপন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ব্যাংকে মূলধন সংস্থান সহজ করা—বিশেষত  প্রাইভেট প্লেসমেন্ট, রূপান্তরযোগ্য বন্ড এবং গণপ্রস্তাবের ব্যবস্থা করা দরকার। এ ছাড়া খেলাপি ঋণের নিরাপত্তা সঞ্চিতির ওপর কর মওকুফ করার ঘোষণা থাকা উচিত বাজেটে। ভারত ও মালয়েশিয়ায় ইতিমধ্যে এই ব্যবস্থা চালু আছে। এই উদ্যোগ নেওয়া হলে ব্যাংকের মূলধন সংরক্ষণ সহজ হবে। 

দুর্বল ব্যাংককে শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেটির বাস্তবায়নের বিষয়ে বাজেটে সুস্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া দরকার। ইন্দোনেশিয়া ১৯৯৭ সালের সংকটে এই ধারা অনুসরণ করেছিল। সম্পদ পুনরুদ্ধার কর্তৃপক্ষ গঠন করে মালয়েশিয়া ও কোরিয়ার আদলে একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা গঠন করা যেতে পারে। সংস্থাটি খেলাপি ঋণ উদ্ধারে কাজ করবে। নতুন মূলধন সংস্থানকারীদের জন্য কর ও রেগুলেটরি প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য এক্সক্লুসিভ লভ্যাংশ ও বোনাস লভ্যাংশে কর মওকুফ করা যেতে পারে। একটি কেন্দ্রীয় বন্ধক সম্পত্তি ডেটাবেস গঠন করা প্রয়োজন, যাতে প্রতারণা ও এক জমির দুবার বন্ধক প্রবণতা কমে আসে। ভারত ও মালয়েশিয়ার মতো ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠনকে ব্যাংক সংস্কার কমিটিতে যুক্ত করা যেতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে কার্যকর করহার প্রায় ৪০ শতাংশ, যা আন্তর্জাতিক গড় হারের চেয়ে অনেক বেশি। সরকার রাজস্ব আদায়ের জন্য ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভর করলেও করকাঠামোকে প্রগতিশীল ও ভারসাম্যপূর্ণ করতে হবে। এ জন্য খেলাপি ঋণের নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে ছাড় দিতে পারে, ভারত ও মালয়েশিয়ায় এই ব্যবস্থা রয়েছে। বোনাস লভ্যাংশের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কর প্রত্যাহার করা প্রয়োজন, যাতে মূলধন সংরক্ষণ সহজ হয়। পাশাপাশি ছোট বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ করহার কমিয়ে শেয়ারবাজারে তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে বাজেটে উদ্যোগ নেওয়া হবে—এমনটাই প্রত্যাশা করি। 

আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে না পারা ব্যাংকগুলোর সমস্যা সমাধানে বাজেটে উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য আমানত বিমা কাঠামো চালুর কথা ভাবতে পারে সরকার। অসাধু পরিচালকদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে আইন প্রণয়নেরও উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। বাজেটে বিশেষ বরাদ্দের মাধ্যমে ব্যাংকের মূলধন শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা নিয়ে আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। 

সুদের হার কমানো ছাড়া উৎপাদন ও বিনিয়োগ গতি পাবে না। এ জন্য সরকারি ঋণ গ্রহণ কমানো দরকার, যাতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ে। আধুনিক কর ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে রাজস্ব ঘাটতির জন্য উচ্চ সুদের ওপর নির্ভর করতে না হয়। মূল্যস্ফীতি কমাতে শুধু সুদের হার নয়, সরবরাহ ব্যবস্থা ও নীতির ওপর আস্থাটাও গুরুত্বপূর্ণ। খেলাপি ঋণ কমাতে উচ্চ আদালতকেও ভূমিকা রাখতে হবে, যাতে অপব্যবহার বন্ধ হয়। খেলাপি ঋণের চূড়ান্ত সুবিধাভোগীদের নামের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। ফরেনসিক নিরীক্ষা ধাপে ধাপে চালু করা যেতে পারে, যাতে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে। বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এখন একটি ক্রান্তিকালে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ভারতের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা শিখতে পারি—সুশাসন, প্রগতিশীল নীতি ও দৃঢ় আইনি কাঠামোই হতে পারে স্থিতিশীল ভবিষ্যতের ভিত্তি।