
স্বাধীনতার পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের করা প্রথম চুক্তিটি ছিল ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী চুক্তি। এর পরপরই হয় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি। দুই দেশের মধ্যকার এই বাণিজ্য চুক্তি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য ছিল। বলা যায়, ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক দ্রুতগতিতে এগিয়েছে। আবার একই সঙ্গে সেই সময়টা ছিল চোরাচালানের জন্য শ্রেষ্ঠ সময়। আর এতে বাংলাদেশই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করার পর ফারাক্কা বাঁধসহ নানা বিষয় নিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। এরশাদ আমলে অবশ্য সম্পর্কের মধ্যে উত্থান-পতন ছিল কম। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আবারও ব্যাপক আলোচনা শুরু হয় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর। এ সময় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অনেক ধরনের অগ্রগতি দেখা দেয়। ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমর্থনও পেয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আবারও টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। বাণিজ্যব্যবস্থা নিয়ে পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে অর্থনীতিতে। তবে এর প্রভাব শেষ পর্যন্ত কত দূর পর্যন্ত গড়ায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এবার দেখা যাক গত ৫৪ বছরে দুই দেশ অর্থনীতি ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কত ধরনের চুক্তি ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য টাইমলাইন (১৯৭২-২০২৫)
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের ভূমিকাকে স্বীকৃতি ও কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি সই হয়। এটি ছিল দুই দেশের মধ্যে ২৫ বছরের একটি কৌশলগত ও কূটনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি। প্রাথমিকভাবে ২৫ বছরের জন্য চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। মেয়াদ শেষে ১৯৯৭ সালে এই চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে নবায়ন করা হয়নি।
বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য প্রথম কৌশলগত বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তি। যদিও এ চুক্তিকে ‘ভারতের আধিপত্যবাদ’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বলেও সমালোচনা আছে।
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে প্রথম দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর হয় ১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ। এ নিয়ে ২৯ ও ৩০ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রথম বাণিজ্য চুক্তি অনুসারে উভয় দেশ আন্তর্জাতিক সীমানার ১৬ কিলোমিটারের মধ্যে পণ্যসামগ্রী বিনিময় করবে এবং ট্রানজিট–সুবিধা পাবে। চুক্তিটি এক বছর মেয়াদের জন্য, তবে ছয় মাস পরে দুই দেশ বাস্তবায়ন পুনর্বিবেচনা করবে। চুক্তিতে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাক্ষর করেন বাণিজ্যমন্ত্রী এম আর সিদ্দিকী এবং ভারতের পক্ষে বৈদেশিক বাণিজ্যমন্ত্রী এল এন মিশ্র।
চুক্তি অনুযায়ী, দুই দেশের মধ্যে আগামী এক বছরে ১০০ কোটি টাকা মূল্যের বাণিজ্য অনুষ্ঠিত হবে। এ সময় বাংলাদেশ থেকে ভারতে আমদানি করবে মাছ, কাঁচা পাট, ফারনেস অয়েল, ন্যাপথাল, জুট ব্যাচিং অয়েল, আধা পাকা গরুর চামড়া, সিল্কের সুতা, তাঁতের তৈরি সুতি দ্রব্য, গুড়, আয়ুর্বেদীয় ওষুধ এবং বইপুস্তক ও সাময়িক পত্রপত্রিকা। ভারত থেকে বাংলাদেশে আমদানি করবে সিমেন্ট, অ্যাসফল্ট, স্টোন, জিপসাম, লাইমস্টোন, তুলার সুতা, কেমিক্যাল ও ওষুধপত্র, মসলা, তামাক, যন্ত্রের খুচরা অংশ, বইপুস্তক ও সাময়িক পত্রপত্রিকা।
ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট ও ট্রেড প্রোটোকল চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশ তাদের অভ্যন্তরীণ জলপথ ব্যবহার করে পারস্পরিক বাণিজ্য ও পণ্য পরিবহনের জন্য একটি কাঠামো স্থাপন করে। এ কাঠামো ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
১৯৭২ সালের ২ নভেম্বর এ বিষয়ে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ-ভারত প্রথম বাণিজ্য চুক্তির আলোকে নতুন নৌপরিবহন চুক্তি সই করা হয়। চুক্তিটি প্রথম পর্যায়ে পাঁচ বছর স্থায়ী হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের নদীপথে ভারত চলাচল ও পরিবহনের সুবিধা লাভ করবে, যা ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় বন্ধ করা হয়েছিল।
ভারতের পরিবহন ও জাহাজ চলাচল দপ্তরের সচিব পিমপুংকর এবং বাংলাদেশের নৌচলাচল সচিব সুলতানুজ্জামান চুক্তিতে সই করেন। এই চুক্তির ফলে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের মধ্যে বাংলাদেশ হয়ে নৌপথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন এবং নদীপথে পণ্যসামগ্রী পরিবহনের ব্যবস্থা হবে।
প্রসঙ্গত, এই প্রোটোকল পরে নবায়ন ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। যেমন ২০১৫ সালে এটি পাঁচ বছরের জন্য নবায়ন করা হয় এবং পরে ২০২০ সালের ২০ মে দ্বিতীয় সংযোজন সই করা হয়। এর মাধ্যমে নতুন রুট ও পোর্ট অব কল যুক্ত করা হয়।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিন বছর মেয়াদি একটি বাণিজ্য চুক্তি সই হয় ঢাকাতেই। বাংলাদেশ ও ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও অধ্যাপক ডি পি চট্টোপাধ্যায় দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে সই করেন।
এ নিয়ে ৬ জুলাই দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, চুক্তির অধীনে প্রথম বছর সাড়ে ৩০ কোটি টাকা করে মোট ৬১ কোটি টাকার পণ্যসামগ্রী উভয় দেশের মধ্যে বিনিময় করা হবে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে চুক্তি কার্যকর হবে এবং প্রতি ছয় মাস পরপর চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে উভয় দেশের কর্মকর্তা পর্যায়ে আলোচনা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে দুই দেশের মন্ত্রী জানান, নতুন চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ ভারতে ২০ কোটি টাকার কাঁচা পাট, সাড়ে ৪ কোটি টাকার নিউজপ্রিন্ট, সাড়ে ৩ কোটি টাকার শুঁটকি ও তাজা মাছ, ১ কোটি টাকার চামড়া, ২২ লাখ টাকার সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন, ৫ লাখ টাকার আয়ুর্বেদী ও ইউনানি ওষুধ, ১০ লাখ টাকার ছায়াছবি, ৫ লাখ টাকার শিমুল তুলা, ৫ লাখ টাকার ওষুধ, ৫ লাখ টাকার মসলা এবং আরও ১ কোটি টাকার বিবিধ পণ্য রপ্তানি করবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ভারত থেকে ৬ কোটি টাকার কয়লা, ৫ কোটি ২০ লাখ টাকার কাঁচা তামাক, সাড়ে ৭ কোটি টাকার তুলা, ২ কোটি টাকার সুতা, ১ কোটি টাকার টেক্সটাইল সুতা, ২২ লাখ টাকার সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন, ১০ লাখ টাকার ছায়াছবি ছাড়াও খুচরা যন্ত্রাংশ, কেমিক্যাল, টুথব্রাশ, যন্ত্রপাতি, বাইসাইকেল, মসলা ইত্যাদি আমদানি করবে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ট্রেড অ্যান্ড পেমেন্টস অ্যারেঞ্জমেন্ট চুক্তি (টিপিএ) সই হয় ১৯৭৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। এই চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশ একটি ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্য ও অর্থ পরিশোধ (ব্যালান্স ট্রেড অ্যান্ড পেমেন্ট অ্যারেঞ্জমেন্ট) ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে। এর মাধ্যমে দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে একটি ক্লিয়ারিং অ্যাকাউন্ট পরিচালনার ব্যবস্থা চালু হয়, যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় পরপর বাণিজ্যিক লেনদেনের হিসাব মেলানো হতো।
পরে ১৯৭৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর একটি প্রোটোকল স্বাক্ষরিত হয়, যার মাধ্যমে রুপিভিত্তিক বাণিজ্য বাতিল করে মুক্ত রূপান্তরযোগ্য মুদ্রায় বাণিজ্য পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
প্রোটোকলটি ১৯৭৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর সই হলেও কার্যকর হয় পরের বছরের ১ জানুয়ারি থেকে। এই প্রোটোকলের মাধ্যমে রুপিভিত্তিক বাণিজ্য বাতিল করে মুক্ত রূপান্তরযোগ্য মুদ্রায় বাণিজ্য পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। দিল্লিতে বাংলাদেশের বাণিজ্যযন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমেদ ও ভারতে বাণিজ্যমন্ত্রী দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় চুক্তিতে সই করেছিলেন।
১৯৭৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদে এটা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ ও ভারত বর্তমান টাকায় বাণিজ্যের বদলে ১লা জানুয়ারি থেকে অবাধ বিনিময়যোগ্য মুদ্রার বাণিজ্য করতে একমত হয়েছে। টাকার বাণিজ্যের মেয়াদ ছিল আরও আঠারো মাস। ১৯৭৩ সালের ৫ই জুলাই স্বাক্ষরিত ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য চুক্তির অধীনে বর্তমান সুষম বাণিজ্য ও দায় পরিশোধ ব্যবস্থা ১৯৭৬ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত টাকায় কার্যকর থাকার কথা ছিল। টাকায় এই বাণিজ্য ব্যবস্থাতেই পরিবর্তন আনা হয়।’ খসড়া চুক্তিতে স্বাক্ষর দেওয়ার পর ভারতে বাণিজ্যমন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, টাকার বাণিজ্যিক লেনদেনে উভয় দেশে সরকারি সংস্থা ও বেসরকারি খাতের যে অনীহা রয়ে গেছে, যার ফলে বাণিজ্যে আকাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হয়নি, সে কারণে বিনিময় পদ্ধতি পাল্টানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।
আওয়ামী লীগ সরকার আর নেই। নতুন সরকারের সময় সম্পর্ক অনেকটা তিক্ত হয়েছে। কমে গেছে পারস্পরিক বাণিজ্য। এ অবস্থায় সম্পর্ক উন্নয়ন, বিশেষ করে বাণিজ্য বাড়াতে সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ জন্য তৎকালীন বাণিজ্যসচিব নুরুল ইসলাম ভারত সফর করেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল ছয় দিন আলোচনা শেষে একটি সম্মত কার্যবিবরণীতে সই করেছিলেন। আলোচনায় ভারতের পক্ষে নেতৃত্ব দেন দেশটির বৈদেশিক বাণিজ্য সচিব ড. পি সি আলেকজান্ডার। এ সময় কয়লা ও নিউজপ্রিন্টের মতো পণ্যের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়।
মূলত ১৯৭২ সালে দুই দেশের যে বাণিজ্য চুক্তি হয়েছিল, এটা ছিল তারই সম্প্রসারিত সংস্করণ বা নবায়ন। এ নিয়ে দৈনিক ইত্তেফাকে ৫ অক্টোবর প্রকাশিত প্রতিবেদনের মূল শিরোনাম ছিল, ‘পারস্পরিক আনুকূল্যের শর্তে বাংলাদেশ-ভারত নয়া বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর’। ভারতের তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফরে এলে এই চুক্তি সই হয়। বাংলাদেশের পক্ষে সই করেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী চৌধুরী তানভীর আহমদ সিদ্দিকী। এই চুক্তির মেয়াদ ছিল তিন বছর। তবে দুই দেশ সম্মত হলে চুক্তিটি আরও তিন বছর বাড়ানো যাবে।
নবায়ন করার সময় নতুন রুট ও পোর্ট অব কল যুক্ত করা হয়। ঢাকায় দুই দেশের প্রতিনিধিরা তিন দিন আলোচনা শেষে ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট প্রোটোকল নবায়ন করা হয়। এটা নিয়ে ৯ নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘ভারতীয় জাহাজ চলাচলের প্রোটোকল নবায়ন’।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত সার্কের সপ্তম শীর্ষ সম্মেলনে সার্ক সদস্যরা সাপটা (সার্ক অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যব্যবস্থা) চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
দক্ষিণ এশিয়া অগ্রাধিকার বাণিজ্যব্যবস্থা বা সাপটার পরিবর্তে কার্যকর হয় দক্ষিণ এশিয়া মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল বা সাফটা। এই ব্যবস্থা কার্যকর হয় ২০০৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে। এর আগে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে ২০০৪ সালের ৬ জানুয়ারি এ–সংক্রান্ত চুক্তি সই হয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়া মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল কার্যকর হওয়ায় সার্ক সদস্যদেশগুলো নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যে পর্যায়ক্রমে শুল্ক হ্রাস শুরু করে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) হংকং সম্মেলনে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) ক্ষেত্রে ৯৮ দশমিক ২ শতাংশ পণ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত–সুবিধা দেওয়ার নীতি নেওয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে ভারত ২০০৮ সালের ১৩ আগস্ট ডিউটি ফ্রি ট্যারিফ প্রেফারেন্স (ডিএফটিপি) স্কিম ফর এলডিসিজ নামে একটি ব্যবস্থা চালু করে, যাতে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত হয়।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় বেশ কিছু চুক্তি সই হয়। সে সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং।
সে সময়ে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো হলো:
বাংলাদেশ ও ভারত একে অন্যের সমুদ্র, রেল ও সড়কপথ ব্যবহার করবে।
নেপাল ও ভুটানে ট্রানজিটের জন্য বাংলাদেশকে তার ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ভারতের।
অন্যদিকে বাংলাদেশ চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ভারতকে ব্যবহার করতে দেবে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও মোংলা বন্দর নেপাল ও ভুটানও ব্যবহার করতে পারবে।
ভারতকে আশুগঞ্জ ও বাংলাদেশকে শিলঘাট পোর্ট কল ব্যবহারে দুই পক্ষ সম্মত।
বাংলাদেশের রেলব্যবস্থার সংস্কার, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ও নদী পুনঃখননের জন্য ১০০ কোটি ডলারের ঋণসহায়তা দেওয়ার ঘোষণা ভারতের।
টিপাইমুখ প্রকল্পকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়, এমন কিছু না করার ঘোষণা ভারতের।
বাংলাদেশের অন্যতম অগ্রাধিকার তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সইয়ের বিষয়টি ত্বরান্বিত করতে দুই দেশের পানিসম্পদমন্ত্রীদের বৈঠক আয়োজনের সিদ্ধান্ত।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ–ঘাটতি মেটাতে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিতে রাজি ভারত।
চার দিনের সফরে যেসব চুক্তি হয়:
বাংলাদেশের জন্য ৪৬টি পণ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার ঘোষণা।
সীমান্ত ব্যবস্থাপনা চুক্তি, সীমান্তে যৌথ টহল, অনুপ্রবেশ ও হত্যাকাণ্ড কমাতে ঐকমত্য।
ছিটমহলের বাসিন্দাদের জন্য পাসপোর্ট ছাড়াই দুই দেশের নির্দিষ্ট এলাকার চলাচলের ব্যবস্থা।
লাইন অব ক্রেডিট সম্প্রসারণ। ভারত আগের ঘোষিত ১ বিলিয়ন ঋণের অংশবিশেষ প্রকল্পে খরচে সম্মতি।
তবে হয়নি তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি।
অথচ মূল আলোচনাই ছিল তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির তীব্র আপত্তি জানিয়ে সফরে যোগ না দেওয়ায় চুক্তি আর হয়নি। বলে রাখা ভালো সেই চুক্তি আর কখনোই হয়নি।
২০১৫ সালের ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথমবার ঢাকা সফরে আসেন। সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে ২২টি সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল:
স্থলসীমান্ত চুক্তি: ১৯৭৪ সালের ল্যান্ড বাউন্ডারি অ্যাগ্রিমেন্ট (এলবিএ) বাস্তবায়নে সম্মতি ও বিনিময় দলিল হস্তান্তর। ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়। এর মধ্যে ভারতের ১১১টি ছিটমহল (১৭ হাজার ১৬০ জন বাসিন্দা) ও বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল (৩৭ হাজার ৩৬৯ জন বাসিন্দা)
২০০ কোটি ডলারের লাইন অব ক্রেডিট বা ঋণসীমার ঘোষণা।
উপকূলীয় শিপিং চুক্তি: এর আওতায় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বন্দরগুলোর মধ্যে সরাসরি সমুদ্রপথে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের অনুমতি।
রেলপথ সংযোগ চুক্তি ও পুনরায় চালু ঘোষণা।
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির নবায়ন।
সীমান্ত হাট সম্প্রসারণ চুক্তি।
বিদ্যুৎ সহযোগিতা ও সংযোগ চুক্তি।
শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক চুক্তি: এর আওতায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষক বিনিময়, রবীন্দ্র-নজরুল স্মরণোৎসব ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে ঘিরে গবেষণা ও প্রকাশনা।
আগরতলা-ঢাকা-কলকাতা সরাসরি বাস সার্ভিস চালু।
অভ্যন্তরীণ নৌপথে বাণিজ্য ও ট্রানজিট চুক্তির নবায়ন।
নৌপথে বাণিজ্য ও ট্রানজিট চুক্তি প্রথম স্বাক্ষরিত হয় ১৯৭২ সালে। চুক্তি ২০১৫ সালের ৬ জুন পুনরায় নবায়ন করা হয় পাঁচ বছরের জন্য, যাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নবায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়।
পরে ২০২০ সালের ২০ মে দ্বিতীয় সংযোজন স্বাক্ষরের মাধ্যমে চুক্তিটি আবার সম্প্রসারিত হয়। এতে ভারতের হলদিয়া এবং বাংলাদেশের মোংলাসহ নতুন রুট ও বন্দর যুক্ত করা হয়।
পাঁচ বছরের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির আবার নবায়ন।
২০১৭ সালে আদানির সঙ্গে ক্রয় চুক্তি করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। চুক্তিটি পিডিবি এবং আদানি পাওয়ার (ঝাড়খন্ড) লিমিটেডের মধ্যে সম্পাদিত হয়, যার আওতায় ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের গড্ডা জেলায় অবস্থিত ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। যদিও উচ্চমূল্যসহ এই চুক্তি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে।
ভারতীয় পণ্যের ট্রানজিটের জন্য চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের চুক্তি স্বাক্ষর। এর মাধ্যমে ভারত চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে (নর্থ–ইস্ট ইন্ডিয়া) পণ্য পরিবহনের ট্রানজিট–সুবিধা পায়। যদিও এ থেকে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে লাভবান হবে না বলে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল।
প্রথম পরীক্ষামূলক ট্রানজিট চালান চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে ভারতীয় ট্রাক ত্রিপুরায় পৌঁছায়।
ভারতের আসাম থেকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ডিজেল সরবরাহ এর উদ্দেশ্য। জ্বালানি খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির অংশ হিসেবে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ১৩১ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার আন্তসীমান্ত পাইপলাইন উদ্বোধন করা হয়। পাইপলাইনের মধ্যে ১২৬ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার বাংলাদেশে এবং বাকি ৫ কিলোমিটার ভারতে বসানো হয়েছে। ১৫ বছরের চুক্তির আওতায় পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রতিবছর আড়াই লাখ টন থেকে চার লাখ টন ডিজেল আমদানি করা যাবে। ২০১৭ সালের ২৩ আগস্ট মন্ত্রিসভার অর্থনীতিবিষয়ক কমিটির অনুমোদনের পর চুক্তিটি সই করা হয়েছিল।
ভারতকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর স্থায়ীভাবে ব্যবহারের অনুমতি দেয়। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় পণ্য সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে বাণিজ্যিক অনুমতি দেয়। এ বিষয়ে স্থায়ী ট্রানজিট আদেশ জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এর আগে ২০১৮ সালে ভারতে এ নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করে ঢাকা ও দিল্লি। ২০১৯ সালে পরীক্ষামূলকভাবে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে একটি ভারতীয় পণ্যের চালান আগরতলা যায় আখাউড়া হয়ে। ২০২২ সালে মোংলা বন্দর দিয়ে আরও দুটি রুটে পরীক্ষামূলক ট্রানজিট নেয় দেশটি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরের ঘটনা। বন্দর ব্যবহার করে অন্য দেশে পণ্য রপ্তানির জন্য বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে ভারত। ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (সিবিআইসি) সেই ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে দেয়।
বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা, বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে পোশাকশিল্পের সুতা আমদানির সুবিধা বাতিল করে বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে স্থলপথ ছাড়া সমুদ্রপথে বা অন্য কোনো পথে সুতা আমদানি করা যাবে।
সরকার শুল্কমুক্ত সুবিধায় হিলি ও বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছিল। ১৫ এপ্রিল থেকে এই অনুমতির মেয়াদ শেষ হলে সরকার আর সময়সীমা বাড়ায়নি।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বাংলাদেশ থেকে আসা তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও প্লাস্টিকসামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্যের স্থলবন্দর দিয়ে আমদানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। এখন এসব পণ্য শুধু কলকাতা ও নভো সেবা সমুদ্রবন্দর দিয়ে আমদানি করা যাবে। ভারতের সিদ্ধান্ত আসলে মোট চারটি। যেমন:
প্রথমত, ভারতের কোনো স্থলবন্দর ব্যবহার করে সেখানে বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানি করতে পারবে না। রপ্তানি করতে হবে কলকাতার হলদিয়া বন্দর ও মুম্বাইয়ের নভো সেবা বন্দর দিয়ে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ থেকে ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামে শুল্ক স্টেশন ব্যবহার করে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, পানীয়, আসবাব, প্লাস্টিক পণ্য, সুতা ও সুতার উপজাত ইত্যাদি রপ্তানি করা যাবে না।
তৃতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গের চ্যাংড়াবান্দা ও ফুলবাড়ী শুল্ক স্টেশন দিয়েও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, পানীয়, আসবাব, প্লাস্টিক পণ্য, সুতা ও সুতার উপজাত ইত্যাদি রপ্তানি করা যাবে না। অর্থাৎ বাংলাদেশের লালমনিরহাটের বুড়িমারী ও পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা দিয়ে এসব পণ্য রপ্তানি হবে না।
চতুর্থত, ভারত বাংলাদেশের মাছ, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি), ভোজ্যতেল ও ভাঙা পাথর আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করেনি। এ ছাড়া ভারতের বন্দর ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ থাকবে না।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখলেও দেওয়া-নেওয়ার ভারসাম্যে একধরনের অসামঞ্জস্য রয়ে গেছে। ১৯৭২ সালের মৈত্রী চুক্তি দিয়ে সম্পর্কের সূচনা হলেও দীর্ঘ ৫৪ বছরে বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার, বিদ্যুৎ আমদানির সুযোগ, জলপথ, সড়ক ও রেলপথ ব্যবহারের সুবিধা দিয়েছে। বাংলাদেশ দিয়েছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযোগের সুবিধা। ডিজেল পাইপলাইন, উপকূলীয় জাহাজ চলাচল, বিদ্যুৎ রপ্তানি, লাইন অব ক্রেডিট, সীমান্তহাট, বাণিজ্যচুক্তি—সবকিছুতেই ভারত পেয়েছে বাস্তব সুবিধা।
পাল্টা হিসেবে বাংলাদেশ পেয়েছে কিছু আর্থিক সহায়তা, সীমিত পণ্য প্রবেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা এবং কিছু অবকাঠামো উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি। তবে প্রতীক্ষিত তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি আজও হয়নি। ট্রানজিট থেকেও পায়নি তেমন আর্থিক সুবিধা। ঋণ সহায়তা দিলেও ভারতীয় পণ্য কেনা ও ভারতীয় ঠিকাদারদের কাজ দেওয়ার শর্ত প্রকল্পের মান ও উপযোগিতা নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। আর সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ককে অনেকটাই নাজুক করেছে। মোটা দাগে বলা যায়, ৫৪ বছরে ভারত কৌশলগত ও অর্থনৈতিকভাবে বেশি লাভবান হয়েছে, আর বাংলাদেশ অপেক্ষা করছে প্রতিশ্রুত প্রতিদান ও ন্যায্য সুযোগের।