
দেশের শ্রমমানকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা, মালিক-শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করা এবং শ্রমিকের কল্যাণ নিশ্চিত করতে গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদ বাংলাদেশ শ্রম আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ নীতিগত ও চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দিয়েছে। এতে শ্রমিক সংজ্ঞা পরিবর্তন আনা, ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন সহজ করা, ভবিষ্য তহবিল বা সর্বজনীন পেনশন বাধ্যতামূলক ইত্যাদি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
উপদেষ্টা পরিষদে শ্রম আইন সংশোধনী অনুমোদন হলেও এখনো প্রজ্ঞাপন হয়নি। এ দেশে প্রজ্ঞাপনের সময়ও অনেক কিছু পরিবর্তন করা হয়। তাই আমাদের একটা দুশ্চিন্তা রয়েছে। তবে সংশোধনীর বিষয়ে যতটুকু জেনেছি, তাতে মনে হয়েছে এটি গ্রহণযোগ্য। তবে এখনো অনেক জায়গায় দুর্বলতা রয়ে গেছে।
শ্রমিকের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনাটা ভালো অগ্রগতি। এটার জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছি। শ্রমিককে কালো তালিকাভুক্ত করা নিষিদ্ধ হয়েছে। এটা একটা লজ্জার ব্যাপার যে ব্ল্যাক লিস্টিং (কালো তালিকাভুক্ত) আইনের মধ্যে এনে বন্ধ করতে হয়েছে। এত দিন বিষয়টি কেউ স্বীকার করছিলেন না, তবে আইনের মধ্যে আসায় এখন প্রমাণ হলো যে শ্রমিকদের অন্যায়ভাবে ব্ল্যাক লিস্টিং করা হতো।
কোন ধরনের আচরণ যৌন হয়রানি হিসেবে বিবেচিত হবে, তা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। এটি ইতিবাচক। তবে যৌন হয়রানির অভিযোগ নিষ্পত্তি কমিটিতে প্রতিষ্ঠানের বাইরের সদস্য রাখা বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি এখন পর্যন্ত কিছু দেখিনি। হয়তো সেটি বিধিতে থাকতে পারে। এটি জরুরি। তার কারণ কমিটির সব সদস্য প্রতিষ্ঠানের হলে অনেক সময় অভিযোগকারীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার সুযোগ থাকে। তাই যৌন হয়রানির অভিযোগ নিষ্পত্তি কমিটিতে প্রতিষ্ঠানের বাইরের সদস্য থাকা খুবই জরুরি।
প্রসূতিকালীন সুবিধার জায়গায় আমরা বেশ হতাশ হয়েছি। আমরা আশা করেছিলাম, মাতৃত্বকালীন ছুটি আরও বাড়বে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী মাতৃত্বকালীন ছুটি ৮ দিন বাড়িয়ে ১২০ দিন করা হয়েছে। অথচ সরকারি কর্মচারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস। জনগণের করের টাকায় সরকারের কর্মচারীদের বেতন হয়। অথচ যাঁরা কর দেন, তাঁদের মাতৃত্বকালীন ছুটি কম। এর চেয়ে হাস্যকর কিছু আর হয় না।
কর্মস্থলে দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ তহবিল চালুর উদ্যোগকে একটি আশার আলো হিসেবে দেখা যেতে পারে। এতে শ্রমিক আহত বা নিহত হলে নির্দিষ্ট ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত হবে। উদ্বেগের জায়গা হলো, দেশের শিল্পকারখানার অনেক দুর্ঘটনা মালিকের অবহেলা বা ত্রুটির কারণে ঘটে। এ জন্য এখন পর্যন্ত কোনো মালিককে শাস্তির মুখোমুখি করা যায়নি। আইনে কারখানামালিকের দায়বদ্ধতার কথা বলা হয়েছে। তবে সেগুলো আরও শক্ত করতে হবে। বিষয়টি বিধিতে পরিষ্কার করা জরুরি।
ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে খুশি-অখুশির জায়গা আছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিলাম যে বড় কারখানায় শ্রমিকদের সংগঠিত করা কঠিন। এখন কারখানায় ৩ হাজারের বেশি শ্রমিক থাকলে ৪০০ জনের সম্মতিতে ইউনিয়ন করা যাবে। এই জায়গায় আমরা খুশি। তবে অখুশির জায়গা হচ্ছে, আমরা দীর্ঘদিন ধরে মালিকপক্ষের নিয়ন্ত্রিত বা ভুঁইফোড় সংগঠনের হাতে গড়া ‘ইয়েলো ইউনিয়ন’ নিয়ে কথা বলে আসছি। ইউনিয়ন নিবন্ধনে শ্রমিক সংখ্যা কমে যাওয়ায় ইয়েলো ইউনিয়ন করার প্রবণতা বেড়ে যাবে। ইয়েলো ইউনিয়নের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি সংশোধনীতে নেই। সে জন্য ইয়েলো ইউনিয়ন ঠেকাতে আইনের বিধিমালায় কার্যকর ব্যবস্থা থাকতে হবে। আমাদের শ্রম দপ্তরে অসাধু কর্মকর্তার কমতি নেই। তাদের বিরুদ্ধে যদি শক্ত ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে অবস্থার কোনো উন্নতি হবে না।
ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনে কী কী লাগবে, সে বিষয়ে মালিক ও শ্রমিকের সমান জ্ঞান থাকতে হবে। একটি কারখানায় একাধিক ইউনিয়ন থাকলে কীভাবে যৌথ দর–কষাকষির এজেন্ট বা সিবিএ নির্ধারিত হবে, তা বিধিমালায় সুস্পষ্ট থাকতে হবে। না হলে কারখানায় অসন্তোষ হতে সময় লাগবে না। কম্বোডিয়ায় শ্রমিক সংগঠন করার জন্য শ্রমিকের সংখ্যা কমানোর পর কারখানার ভেতরে এক ইউনিয়ন আরেক ইউনিয়নের সঙ্গে মারামারি করে চলেছে। ফলে মালিকের সঙ্গে দর–কষাকষির আর সময় পায় না ইউনিয়ন। আমরা যেন ওই পর্যায়ে না যাই।
কল্পনা আক্তার, সভাপতি, বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশন