নগদ প্রবাসী আয় গ্রহণ বন্ধ

সিঙ্গাপুরি ব্যাংকের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের তিন ব্যাংক বিপাকে

সিঙ্গাপুরে কর্মরত বাংলাদেশি নাগরিকদের অর্ধেকই নগদে রেমিট্যান্স তথা প্রবাসী আয়ের অর্থ জমা করেন। এই অর্থ প্রথমে রেমিট্যান্স হাউসগুলোতে জমা হয়, এরপর সেখানকার ব্যাংক হয়ে বাংলাদেশে আসে। তবে সিঙ্গাপুরের ডিবিএস ব্যাংক সম্প্রতি ঘোষণা করেছে যে তারা আর রেমিট্যান্সের নগদ অর্থ গ্রহণ করবে না। এ কারণে সিঙ্গাপুর থেকে বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ স্থবির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যা সেখানে সেবা দেওয়া বাংলাদেশের তিনটি ব্যাংকের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনছে।

এই পরিস্থিতিতে রেমিট্যান্সের বৈধ চ্যানেল সচল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ করেছে। তাদের তৎপরতায় ডিবিএস ব্যাংক ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত নগদ অর্থ গ্রহণের সুবিধা চালু রাখতে রাজি হয়েছে। ডিবিএসের সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে অর্থ পাচার রোধের বিষয়টি সামনে আনা হচ্ছে। এ বিষয়ে দ্রুত নজর দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)।

যে তিন ব্যাংক বিপাকে

বাংলাদেশের অগ্রণী, ন্যাশনাল ও প্রাইম ব্যাংক ২০০৬ সাল থেকে সিঙ্গাপুরে রেমিট্যান্স সেবা দিয়ে আসছে। একসময় এই ব্যাংকগুলোর অ্যাকাউন্ট বা হিসাব ছিল স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, ইউওবি ও ওসিবিসি ব্যাংকের সঙ্গে। তবে অর্থ পাচারের অভিযোগ, নগদ অর্থের বেশি ব্যবহার এবং নিয়মনীতি না মানায় সেই সম্পর্ক প্রায় চার বছর আগে ছিন্ন হয়ে যায়। এখন শুধু সে দেশের ডিবিএস ব্যাংকের সঙ্গেই বাংলাদেশের তিন ব্যাংকের লেনদেনের সম্পর্ক রয়েছে।

অগ্রণী ব্যাংকের পাঁচটি শাখা এবং অন্য দুই ব্যাংকের তিনটি করে শাখা রয়েছে সিঙ্গাপুরে। এসব শাখা রেমিট্যান্স গ্রহণের পাশাপাশি আমানতসহ অন্যান্য সেবাও দিয়ে থাকে। দেশটিতে কর্মরত বাংলাদেশিদের বড় অংশ আয় পাঠানোর জন্য দেশীয় ব্যাংকের শাখাগুলোর ওপর নির্ভর করে।

ডিবিএসের সিদ্ধান্ত

গত আগস্টের শুরুতে ডিবিএস ব্যাংক সিঙ্গাপুরের কয়েকটি রেমিট্যান্স হাউসকে জানিয়ে দেয়, তারা আর রেমিট্যান্সের কোনো নগদ অর্থ গ্রহণ করবে না। এতে বিপাকে পড়া বাংলাদেশি তিন ব্যাংক বিষয়টি দ্রুত বাংলাদেশ ব্যাংককে জানায়। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুরোধে ডিবিএস আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত নগদ অর্থ গ্রহণ চালিয়ে যেতে সম্মত হয়।

সিঙ্গাপুরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের প্রায় অর্ধেকই নগদ জমা হয়। রেমিট্যান্স হাউসগুলো সেই অর্থ ডিবিএস ব্যাংকে জমা দেয় এবং সেখান থেকে তা দেশে আসে। এখন নগদ অর্থ গ্রহণ বন্ধ হয়ে গেলে রেমিট্যান্স হাউসগুলো অর্থ গ্রহণ করলেও তা আর দেশে পাঠাতে পারবে না। এর ফলে হুন্ডি বা অবৈধ পথে অর্থ লেনদেন বেড়ে যেতে পারে।

সিঙ্গাপুরে অবস্থিত এনবিএল মানি ট্রান্সফারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শহীদুল ইসলাম আজাদ জানান, হঠাৎ করে নগদ অর্থ গ্রহণ বন্ধ হয়ে গেলে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে। সেই আয় অবৈধ পথে যেতে পারে। প্রবাসীদের ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যস্ত হতে সময় দিতে হবে।

সিঙ্গাপুর থেকে রেমিট্যান্সের চিত্র

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সিঙ্গাপুর থেকে ৩৮ কোটি ৫২ লাখ মার্কিন ডলারের প্রবাসী আয় আসে, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেড়ে হয় ৪২ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। আর গত ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জুলাইয়ে ৪ কোটি ২৭ লাখ, আগস্টে ২ কোটি ৬৯ লাখ, সেপ্টেম্বরে ২ কোটি ৪৬ লাখ ও অক্টোবরে ৪ কোটি ২২ লাখ, নভেম্বরে ৪ কোটি ৪৭ লাখ, ডিসেম্বরে ৬ কোটি ৪ লাখ, জানুয়ারিতে ৭ কোটি ১৬ লাখ, ফেব্রুয়ারিতে ৭ কোটি ৩০ লাখ, মার্চে ৪ কোটি ৭৪ লাখ ও এপ্রিলে ৫ কোটি ৯ লাখ ডলার আসে।

জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংকও সিঙ্গাপুরের মোস্তফা ফরেন এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে প্রবাসী আয় আনে।

কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের শীর্ষ পাঁচ গন্তব্যের একটি হচ্ছে সিঙ্গাপুর। সে দেশে বেশির ভাগ কর্মীই নিয়োগ হয় নির্মাণ খাত ও জাহাজনির্মাণ শিল্পে। দেশটি শুধু দক্ষ শ্রমিকদেরই নিয়ে থাকে।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যে দেখা গেছে, দেশ থেকে ২০২২ সালে ৬৪ হাজার ৩৮৩ জন, ২০২৩ সালে ৫৩ হাজার ২৬৫ জন এবং ২০২৪ সালে ৫৮ হাজার ৮৭৮ জন সিঙ্গাপুরে কাজ করতে গেছেন। চলতি বছরে জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত গেছেন ২৬ হাজার ৩৮৯ জন। ২০০৪ সাল থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত দেশটিতে গেছেন ৯ লাখ ১৯ হাজার ১৫৯ জন।

এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থ পাচার রোধে ডিজিটাল লেনদেন জরুরি। সিঙ্গাপুরেও নগদ অর্থের লেনদেন কমে আসছে। দেশটিতে থাকা বাংলাদেশিরা অনেক কষ্ট করে আয় করেন, বেতনও বেশ কম। অনেকে নগদ টাকায় বেতন পান। সে জন্য রেমিট্যান্সের অর্থ নগদে লেনদেন করা বন্ধ হলে তাঁদের বড় সমস্যা হবে এবং অবৈধ হুন্ডি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়ে দ্রুত নজর দিতে হবে।’