
বেসরকারি খাতের প্রথম প্রজন্মের সিটি ব্যাংক এখন দেশের শীর্ষ ও শক্তিশালী ব্যাংকের একটি। বিদায়ী বছর ব্যাংকটির নিট মুনাফা প্রথমবারের মতো এক হাজার কোটি টাকার মাইলফলক ছাড়িয়েছে। আর এই মুনাফা ও ব্যাংকের শক্তিশালী ভিত তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং টেকসই ও পরিবেশবান্ধব অর্থায়ন। ব্যাংকটির ঋণের ৮৮ শতাংশই বিতরণ করা হয়েছে টেকসই খাতে।
সিটি ব্যাংক–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অর্থনীতির নানা অস্থিরতার মধ্যেও টেকসই ও পরিবেশবান্ধব প্রকল্পগুলো ধারাবাহিকভাবে ভালো করে যাচ্ছে। ফলে এসব খাতে দেওয়া ব্যাংকের কোনো ঋণ খেলাপি হয়নি। এ ধরনের ঋণ ব্যাংকটির আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী করতে সহায়তা করে যাচ্ছে বলে ব্যাংকটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।
ব্যাংকটির টেকসই ঋণে খেলাপির পরিমাণ প্রায় শূন্য। নব্বইয়ের দশকের দুর্বল সিটি ব্যাংক এখন দেশের শক্তিশালী ব্যাংকের একটি। মুনাফা ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
২০১৭ সালে সিটি ব্যাংকের শেয়ার কিনে ব্যাংকটির পর্ষদে যুক্ত হয় বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)। এর পর থেকে ব্যাংকটি ধারাবাহিকভাবে ভালো করে যাচ্ছে। ব্যাংকটি করপোরেট, সিএমএসএমই ও ভোক্তা ঋণের পাশাপাশি এখন অন্যান্য আর্থিক সূচকেও ভালো অবস্থানে রয়েছে। পাশাপাশি মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান বিকাশের মাধ্যমে পাঁচ লাখ গ্রাহকের কাছে ব্যাংকটি অতিক্ষুদ্র ঋণ পৌঁছে দিয়েছে। ব্যাংকটির অ্যামেক্স ক্রেডিট কার্ড সেবা আগে থেকেই বাজারের শীর্ষে। প্রধান কার্যালয়সহ ৪১টি শাখা ও উপশাখা এবং ৩৩টি এটিএমে রয়েছে সৌরবিদ্যুৎ–সুবিধা। ব্যাংকটির গ্রাহকের ৫৭ শতাংশই ইন্টারনেট ব্যাংকিং বা অ্যাপ ব্যবহার করে। ফলে পাঁচ বছর ধরে সিটি ব্যাংককে টেকসই ব্যাংকের তালিকায় রাখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই তালিকা ব্যাংকটির সাফল্যে আলাদা পরিচিতি যুক্ত করেছে। এ ছাড়া প্রযুক্তি ব্যবহার ও ডিজিটাল সেবার কারণে দেশের শীর্ষস্থানীয় স্মার্ট ব্যাংক হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে সিটি ব্যাংক।
বেসরকারি খাতের প্রথম ব্যাংক হিসেবে ১৯৮৩ সালে অনুমোদন পায় দ্য সিটি ব্যাংক। ব্যাংকটির উদ্যোক্তা ছিলেন তখনকার ১২ তরুণ ব্যবসায়ী। শুরুতে কিছুটা ভালো করলেও দশক পার না হতেই ব্যাংকটিতে নানা সমস্যা দেখা দেয়। ফলে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক হিসেবে তালিকাভুক্ত হয় এটি। খাদের কিনার থেকে ব্যাংকটিকে টেনে তুলতে ২০০৭ সালে প্রথম প্রজন্ম থেকে নেতৃত্ব নেয় দ্বিতীয় প্রজন্ম। এরপর ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক ব্যাংকিংয়ের উত্তম চর্চা অনুসরণ, লোগো পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন করে ব্র্যান্ডিং ও সেবার মান বাড়ানো হয় ব্যাংকটির। এই সময়ে অ্যামেক্সের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কার্ড ও খুচরা ব্যাংকিং ব্যবসারও প্রসার ঘটায় ব্যাংকটি। সব মিলিয়ে নব্বইয়ের দশকের দুর্বল সিটি ব্যাংক এখন দেশের শক্তিশালী ব্যাংকের একটি।
একসময় ব্যাংকটির ৪০ শতাংশের বেশি ঋণ খেলাপির খাতায় নথিভুক্ত ছিল। এখন সেই খেলাপি ঋণ কমে নেমে এসেছে ৪ শতাংশে নিচে। গত বছর শেষে সিটি ব্যাংক সমন্বিতভাবে মুনাফা করেছে ১ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে ব্যাংকটির সমন্বিত মুনাফার পরিমাণ ছিল ৬১৫ কোটি টাকা।
২০০৮ সালে লোগো পরিবর্তন করে নতুন বার্তা নিয়ে গ্রাহকদের সামনে হাজির হয় সিটি ব্যাংক। ২০০৯ সালে বিশ্বখ্যাত আমেরিকান এক্সপ্রেসের (অ্যামেক্স) ক্রেডিট কার্ড চালু করে ব্যাংকটি। একই বছর সব শাখা অনলাইনের আওতায় আনা হয়। ব্যাংকটির লোগোর পাশে যুক্ত হয় অ্যামেক্সের লোগো, যা দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে ভিন্নমাত্রা যুক্ত করে। ২০১০ সালে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাউঞ্জ সেবা চালু করে সিটি ব্যাংক, যা ছিল বেসরকারি খাতের প্রথম লাউঞ্জ সুবিধা। পরে আরও দুটি লাউঞ্জ চালু করে ব্যাংকটি। এর ফলে ব্যাংকটির কার্ড ব্যবসা নতুন মাত্রা পায়। ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আইএফসি ৫ শতাংশ শেয়ার কিনে সিটি ব্যাংকের অংশীদার ও পর্ষদে যুক্ত হয়।
২০২১ সালে বিকাশের গ্রাহকদের জন্য অতিক্ষুদ্র ঋণ চালু করে ব্যাংকটি, যা দেশের প্রথম ডিজিটাল ঋণ। এই সেবায় পাঁচ লাখের বেশি গ্রাহক ঋণ নিয়েছেন। গড়ে ঋণের পরিমাণ পাঁচ হাজার টাকা। সামনে প্রতিদিন বিকাশের ১ লাখ গ্রাহককে গড়ে ১০ হাজার টাকা ঋণ দিতে চায় ব্যাংকটি। ইতিমধ্যে এই ঋণসীমা ৫০ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। এসব সুবিধার ফলে ব্যাংকটির গ্রাহক গত বছর বেড়ে হয়েছে ২৬ লাখ, ২০২১ সালে যেখানে গ্রাহক ছিল ১৬ লাখ। এখন ব্যাংকটির গ্রাহকের মধ্যে সাত লাখ নারী। ব্যাংকটির কর্মকর্তার সংখ্যা ৫ হাজার ৩২১, এর মধ্যে ১ হাজার ১৯৩ জনই নারী কর্মকর্তা। দেশের সবচেয়ে বেশি—সাত লাখ ক্রেডিট কার্ড গ্রাহক ব্যাংকটির। ব্যাংকটির ঋণের ৬০ শতাংশ করপোরেট খাতে, বাকি ৪০ শতাংশের অর্ধেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি । এসব সূচক ব্যাংকটিকে টেকসই ব্যাংকের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে ভূমিকা রেখেছে।