টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনছেন সীমিত আয়ের মানুষেরা। গতকাল দুপুরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জাপান গার্ডেন সিটি এলাকায়
টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনছেন সীমিত আয়ের মানুষেরা। গতকাল দুপুরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জাপান গার্ডেন সিটি এলাকায়

‘ট্রাকের পেছনে দাঁড়িয়েছি কেউ দেখলে লজ্জায় পড়ব’

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা নাজিম হোসেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় তিনি একটি কাজে আগারগাঁওয়ে যাচ্ছিলেন। পথে জাপান গার্ডেন সিটির সামনে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ভ্রাম্যমাণ ট্রাক দেখে দাঁড়ান। প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ট্রাকটি থেকে ৪৫০ টাকায় সয়াবিন তেল, মসুর ডাল ও চিনি কেনেন তিনি। সমপরিমাণ পণ্য বাজার থেকে কিনলে তাঁর আরও ১৬০–১৮০ টাকা লাগত।

টিসিবির ট্রাকের পেছনে দাঁড়ানোর সময় বারবার এদিক–ওদিক তাকাচ্ছিলেন নাজিম হোসেন। পণ্য কিনে ফেরার সময় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করে পরিবারের নিয়মিত বাজারের খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু আমার আয় তো কম। এ জন্য বাধ্য হয়ে ট্রাকের পেছনে দাঁড়িয়েছি। পরিচিত কেউ দেখে ফেললে লজ্জায় পড়ব; তাই এদিক–ওদিক তাকাচ্ছিলাম।’

বছরের এ সময়ে (বর্ষা মৌসুম) বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় অধিকাংশ সামগ্রীর দাম বেশ চড়া। দেড় মাস ধরে সব ধরনের সবজি, মাছ, ফার্মের মুরগি ও ডিম আগের তুলনায় চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। এর কিছুদিন আগে বেড়েছিল চালের দাম। আর সর্বশেষ ১৫–২০ দিনের মধ্যে আটা, ময়দা, মসুর ডালের দামও বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নাজিম হোসেনের মতো সীমিত আয়ের মানুষেরা কিছুটা অর্থ সাশ্রয়ের আশায় টিসিবি কিংবা ওএমএসের (খাদ্য অধিদপ্তরের খোলাবাজারে বিক্রি) ট্রাকের পেছনে ভিড় করছেন।

টিসিবির একটি ট্রাকে ৫০০ জনের জন্য পণ্য থাকে। একজন ক্রেতা ২ কেজি মসুর ডাল, ২ লিটার সয়াবিন তেল ও ১ কেজি চিনি কিনতে পারেন। তাতে মোট ব্যয় হয় ৪৫০ টাকা। বাইরে থেকে এ পণ্য কিনতে ৬২০–৬৫০ টাকা লাগে। অন্যদিকে ওএমএসের ট্রাকে ৩০০ লোকের জন্য চাল ও ৫০০ লোকের জন্য আটা থাকে। একজন ব্যক্তি ৫ কেজি চাল ও ৪ কেজি আটা কিনতে পারেন। তাতে ব্যয় হয় ২৬০ টাকা, যা বাইরে থেকে কিনলে প্রায় ৫০০ টাকা লাগে।

হঠাৎ করে পরিবারের নিয়মিত বাজারের খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু আমার আয় তো কম। এ জন্য বাধ্য হয়ে ট্রাকের পেছনে দাঁড়িয়েছি। পরিচিত কেউ দেখে ফেললে লজ্জায় পড়ব; তাই এদিক–ওদিক তাকাচ্ছিলাম।
নাজিম হোসেন

সাধারণত টিসিবি বা ওএমএসের ট্রাক থেকে নিম্ন আয়ের মানুষেরা পণ্য কিনে থাকেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অনেকগুলো প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষেরাও। এ কারণে তাঁরা কিছুটা অর্থ সাশ্রয়ের আশায় টিসিবি বা ওএমএসের ট্রাকের পেছনে ভিড় করছেন।

গতকাল দুপুরে মোহাম্মদপুরের রিং রোডে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে টিসিবির ট্রাকের পেছনে অন্তত ১৫০ জন মানুষ পণ্য কেনার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন কর্মস্থল থেকে কিছু সময়ের জন্য ছুটি নিয়ে পণ্য কিনতে আসেন। এ ছাড়া শ্যামলী খেলার মাঠ, লালমাটিয়া, খামারবাড়ি ও কারওয়ান বাজার এলাকাতেও টিসিবি এবং ওএমএসের ট্রাকের পেছনে অনেকটা একই দৃশ্য দেখা গেছে। কেউ কেউ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পণ্য না কিনেই ফিরে গেছেন।

লালমাটিয়া এলাকায় টিসিবির ট্রাকের পেছনে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ফেরত যান মো. নাজমুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমি একটা কোম্পানিতে চাকরি করি। কাজের ফাঁকে এখানে দাঁড়িয়েছিলাম। সয়াবিন তেল ও ডাল কিনতে পারলে খুবই উপকার হতো। কিন্তু কাজ ফেলে বেশি সময় তো অপেক্ষা করতে পারব না। তাই চলে যচ্ছি।’

টিসিবির একটি ট্রাকে ৫০০ জনের জন্য পণ্য থাকে। একজন ক্রেতা ২ কেজি মসুর ডাল, ২ লিটার সয়াবিন তেল ও ১ কেজি চিনি কিনতে পারেন। তাতে মোট ব্যয় হয় ৪৫০ টাকা। বাইরে থেকে এ পণ্য কিনতে ৬২০–৬৫০ টাকা লাগে।

চড়া দামে বাজার গরম

বর্তমানে খুচরা বাজারে অধিকাংশ সবজি ৬০ থেকে ৮০ টাকার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমের প্রধান সবজি বেগুন, ঢ্যাঁড়স, কচুর লতি, পটোল, চালকুমড়া (জালি), করলা, কাঁকরোলসহ বেশির ভাগ সবজির দামই আগের তুলনায় বেশ বেড়েছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত তিন মাসে এসব সবজির দাম সর্বনিম্ন ১৬ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

সবজির দাম বেশি থাকায় মানুষ বিকল্প হিসেবে ডিম খাওয়া বাড়িয়ে দেন। কিন্তু এখন ডিমের দামও বেড়েছে। বর্তমানে ফার্মের মুরগির এক ডজন ডিম ১৩০-১৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। পাড়া-মহল্লায় দাম আরও কিছুটা বেশি। এ ছাড়া প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৮০ টাকা ও সোনালি মুরগি ২৯০ থেকে ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে এক ডজন ডিম ১০০-১১০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ১৪০-১৫০ টাকা ও সোনালি মুরগি ২৪০-২৬০ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হয়। সেই তুলনায় এখন দাম অনেক বেশি। অন্যদিকে বর্তমানে ২৮০ টাকা কেজির নিচে তেমন কোনো মাছই কেনা যায় না।

মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে আটা, ময়দা ও মসুর ডাল। কেজিপ্রতি আটার দাম ৬ থেকে ১০ টাকা ও ময়দার দাম ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। আর ছোট দানার মসুর ডালের দাম কেজিতে প্রায় ২০ টাকা বেড়েছে।

আমি একটা কোম্পানিতে চাকরি করি। কাজের ফাঁকে এখানে দাঁড়িয়েছিলাম। সয়াবিন তেল ও ডাল কিনতে পারলে খুবই উপকার হতো। কিন্তু কাজ ফেলে বেশি সময় তো অপেক্ষা করতে পারব না। তাই চলে যচ্ছি।
নাজমুল ইসলাম

ডিম–পেঁয়াজ আমদানির সুপারিশ

এদিকে ডিম ও পেঁয়াজের দাম আরও বেড়ে গেলে পণ্য দুটি আমদানির অনুমতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। সংস্থাটি গতকাল বাণিজ্যসচিবকে দেওয়া এক চিঠিতে বলেছে, খুচরা বাজারে এক ডজন ডিমের দাম ১৫০ টাকা ও এক কেজি পেঁয়াজের দাম ৯০ টাকা ছাড়ালেই পণ্য দুটি আমদানির অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। এর পাশাপাশি পণ্য দুটির শুল্ক-কর ছাড়ের সুপারিশও করেছে সংস্থাটি।