নিজের চালকলের গুদামে ব্যবসায়ী তরিকুল ইসলাম। সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জের এনায়েতপুর গ্রামে
নিজের চালকলের গুদামে ব্যবসায়ী তরিকুল ইসলাম। সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জের এনায়েতপুর গ্রামে

চাল বিক্রেতা থেকে বড় উদ্যোক্তা প্রতিবন্ধী তরিকুল

  • বছরে তরিকুল ইসলামের ব্যবসা এখন ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার।

  • ব্যবসার শুরু চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঈশ্বরদীতে গিয়ে কয়েক কেজি চাল বিক্রি দিয়ে।

  • তাঁর চালের ব্র্যান্ডের নাম ‘ফিন্টু রাইস’।

  • প্রথম চালকল করেন ২০১৯ সালে, দ্বিতীয়টি গত বছর।

স্কুলে ভর্তি হয়েও দ্বিতীয় শ্রেণির গণ্ডি পেরোতে পারেননি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার মোকরামপুরের আলীনগর গ্রামের তরিকুল ইসলাম। তারপর শৈশবেই পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে শরীরের একটি অংশের কার্যক্ষমতা হারান। সেই থেকে চলতে–ফিরতে ক্রাচ তাঁর নিত্যসঙ্গী।

শরীরের একাংশের কার্যক্ষমতা হারিয়েও দমে যাননি তরিকুল। কঠোর চেষ্টা ও উদ্যমে তিনি হয়ে উঠেছেন একজন সফল উদ্যোক্তা। স্থানীয়ভাবে অনেকের জন্য অনুকরণীয়। তরিকুল এখন ফিন্টু সুপার অটো রাইস মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। তাঁর অধীন কাজ করেন ছয়জন মহাব্যবস্থাপক আর ২০০ কর্মচারী। বর্তমানে দুটি অটো রাইস মিলের মালিক তিনি।

সমাজের চোখে প্রতিবন্ধী এই ব্যবসায়ীর ডাকনাম ফিন্টু। এই নামেই নামকরণ করেন নিজের প্রতিষ্ঠানের। তাঁর চালকল কারখানা অবস্থিত চাঁপাইনবাবগঞ্জের এনায়েতপুর গ্রামে। এই চালকলের প্রতিদিনের উৎপাদনক্ষমতা তিন হাজার মণ। তাঁর চালকলে উৎপাদিত চাল দেশের দক্ষিণাঞ্চলে অত্যন্ত সুপরিচিত। ‘ফিন্টু রাইস’ ব্র্যান্ড হিসেবে একনামে বিক্রি হয়। এই চালের চাহিদা এতটাই বেশি যে স্থানীয় চালের চেয়ে প্রতিবস্তা ২০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হয়। বিশেষ করে কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও কানাইপুর; মাদারীপুরের টেকেরহাট, বরিশাল, ঝিনাইদহ, কালীগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, আলমডাঙ্গা এসব এলাকায় এই চাল বেশি বিক্রি হয়। কুষ্টিয়া ও কিশোরগঞ্জে প্রতিদিন দুই ট্রাক করে চাল যায়। নারায়ণগঞ্জে যায় প্রতিদিন এক থেকে তিন ট্রাক, ঝিনাইদহে সপ্তাহে তিন থেকে পাঁচ ট্রাক। কালীগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, আলমডাঙ্গায়ও যায় এই চাল।

সম্প্রতি কথা হয় ৬০ বছর বয়সী তরিকুল ইসলামের সঙ্গে। শৈশবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে কীভাবে একজন সফল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন, সেই গল্প তিনি শোনান আলাপকালে। গল্পে গল্পে জানা যায়, শৈশবে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন প্রথম শ্রেণিতে; কিন্তু প্রথম শ্রেণির পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। তরিকুল বলেন, যখন পরীক্ষায় পাস করতে পারলাম না, তখন বাবা বললেন, তোকে দিয়ে লেখাপড়া হবে না। বাবার এই কথার পর লেখাপড়া আর বেশিদূর এগোয়নি। শুরু হলো জীবনযুদ্ধ। শৈশবেই যুক্ত হয়ে যান ব্যবসার সঙ্গে, তা–ও কিছু না জেনে, না বুঝে।

তরিকুল জানান, সেই ছোটবেলাতেই প্রতিদিন ১০ কেজি চাল নিয়ে ট্রেনে করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে পাবনার ঈশ্বরদীতে যেতেন তিনি। সেই চাল বিক্রি করে আবার ফিরে আসতেন। প্রতিদিন চাল বিক্রি করে পাঁচ থেকে আট টাকা লাভ হতো। তখন ঈশ্বরদীতে ফুটপাতের দোকানে প্রতি প্লেট ভাত বিক্রি হতো আট আনায়। এভাবে একটু একটু করে বিক্রি বাড়তে থাকে। ঈশ্বরদীর পরে কুষ্টিয়ায় গিয়ে চাল বিক্রি শুরু করেন তিনি। হঠাৎ একদিন যাত্রীবাহী ট্রেনে অবৈধভাবে চাল পরিবহনের অভিযোগে পুলিশ তাঁর ৩৮ মণ চাল আটকে দিল। সেটি ১৯৮২ সালের ৩ ডিসেম্বর। দিনটির কথা এখনো ভোলেননি তরিকুল। এভাবে চলতে চলতে ১৯৮৭ সালে বিয়ে করেন তিনি।

বিয়ের কথা বলতে গিয়ে কিছুটা বিষণ্ন হয়ে পড়েন তরিকুল। কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, বিয়ের পরপরই বাবা দুই মণ ধান ও পাঁচটি ঢেউটিন দিয়ে আলাদা করে দিলেন। এরপর শুরু হলো জীবনের প্রকৃত লড়াই। তরিকুলের মনের মধ্যে শুধু ব্যবসার চিন্তা। সেই চিন্তা থেকে বাবার দেওয়া দুই মণ ধান বিক্রি করে কিনলেন আম; কিন্তু সেই আম বিক্রি করে ২০ টাকা লোকসান গুনতে হলো। লোকসানের পর ভাবলেন, বাড়িতে নতুন বউ, লোকসানের কথা বললে মন খারাপ করতে পারে। তাই লোকসানের কথা ভুলে মাছ কিনে বাড়ি ফিরলেন হাসতে হাসতে। আমের ব্যবসার এক লোকসানেই আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন তিনি। এ অবস্থা দেখে ঘনিষ্ঠ বন্ধু আতাউর রহমান দুই হাজার টাকা ধার দিলেন কিছু একটা করতে। সেই টাকা দিয়ে প্রথম মুদিদোকান খোলেন তরিকুল। কারণ, আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যেভাবেই হোক ব্যবসায় করবেন তিনি। এভাবেই চলল কয়েক বছর। ১৯৯১ সালে আবার পুঁজিসংকটে। বাড়িঘরও নেই। এ সময় গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ২ হাজার টাকা ঋণ পেলেন। নগদ হাতে পেলেন ১ হাজার ৮৫০ টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৮০০ টাকা দিয়ে একটি গরু কিনলেন। সাত-আট মাস পর গরুটা ৩ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি করলেন। গরু বিক্রির ৩ হাজার ৬০০ টাকার সঙ্গে দোকানের জমানো ৪০০ টাকা যোগ করে মোট ৪ হাজার টাকা নিয়ে শুরু করলেন আতপ চালের ব্যবসা।

তরিকুল জানান, প্রথমবারই ধান ভাঙিয়ে চাল করে রাজশাহী নিয়ে গেলেন বিক্রির জন্য। সেবার ৭০০ টাকা লোকসান হলো। এতে জিদ আরও বেড়ে গেল। এত টাকা লোকসানই যখন হলো তখন এর শেষ দেখে ছাড়বেন। পরের হাটে আবার ধান কিনলেন। সেই ধান থেকে চাল তৈরি করে তা বিক্রি করে ১ হাজার ৭০০ টাকা লাভ হলো। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১ হাজার ৭০০ টাকার লাভ ছিল ব্যবসায়ী হিসেবে তরিকুলের যাত্রা শুরুর প্রথম মাইলফলক। অন্যের মিলে ধান ভাঙিয়ে সেই চাল শুরুতে সিরাজগঞ্জে বিক্রি করতেন তিনি। ২০১০ সালে কুষ্টিয়ার বাজার ধরেন।

তরিকুল জানান, ব্যবসায়ীরা চাল নিয়ে কোথায় বিক্রি করেন, কেউ কাউকে বলেন না। একদিন এক ব্যবসায়ী ঠিকানা দিলেন কুষ্টিয়ার বড়বাজারের ব্যবসায়ী প্রবীর বাবুর। চাল নিয়ে তাঁর কাছে গেলেন। তখন বিকেল হয়ে গেছে। প্রবীর বাবু চাল না কিনে ফিরিয়ে দিলেন তাকে। তিনি ঘুরতে থাকলেন কুষ্টিয়ার বড়বাজারে এ–দোকান, ও–দোকান। একপর্যায়ে এক ব্যবসায়ী তাঁর চাল কিনতে রাজি হলেন। সেই থেকে কুষ্টিয়ায় তাঁর চালের ব্যবসা শুরু। তরিকুলের মতে, এখন কুষ্টিয়ার চালের বাজারে যদি ১০০ বস্তা চাল বিক্রি হয়, তার মধ্যে ৯০ বস্তাই ‘ফিন্টু রাইস’, অর্থাৎ তরিকুলে চালকলের চাল। তরিকুল বলেন, ‘কোনো ভেজাল চাল বিক্রি করি না। তাই আমার চালের চাহিদা বেশি।’

দীর্ঘদিন ধরে চাল বিক্রির টাকা কোমরে গুঁজে বাড়ি ফিরতেন তরিকুল। এখন লেনদেন করেন ব্যাংকের মাধ্যমে। আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে ধান কিনে নিজের মিলে ভাঙিয়ে সেসব চাল বিক্রি করেন কুষ্টিয়াসহ অন্যান্য জেলায়। এভাবে ভালোই চলছিল। ২০০৮ সালে এসে আবারও ধাক্কা খান ব্যবসায়। আবার পুঁজি হারান; কিন্তু দমে যাননি। ওই বছর জনতা ব্যাংক থেকে দুই লাখ টাকা ঋণ নেন। আবার শুরু করেন। ঘুরেও দাঁড়ান। ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর নিজে প্রথম চালকল চালু করেন। আর গত বছর চালু হয় দ্বিতীয়টি। বর্তমানে তাঁর ব্যাংকঋণ পাঁচ কোটি টাকা। আর বাজারে পাওনা রয়েছে তিন কোটি টাকা। বছরে এখন তার ব্যবসা ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার। তরিকুল বলেন, স্বল্প সুদে ঋণ পেলে ব্যবসা আরও বড় করবেন তিনি। সেদ্ধ চালের একটি মিল করার ইচ্ছা তাঁর। তাতে নতুন করে ২০০ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

কেন আর একটি মিল করতে আগ্রহী ,তারও কারণ জানালেন তরিকুল। তিনি বলেন, তাঁর তিন মেয়ে। দুই মেয়ের জন্য দুইটা মিল দাঁড়িয়ে গেছে। এখন আরেক মেয়ের জন্য আরেকটি মিল করতে চান চাঁপাইনবাবগঞ্জে।

এর বাইরে তরিকুলের স্বপ্ন একটি চক্ষু হাসপাতাল করার। এ জন্য জমিও খুঁজতে শুরু করেছেন। কেন চক্ষু হাসপাতাল করার স্বপ্ন দেখেন, জানতে চাইলে তরিকুল বলেন, ছোটবেলায় এক পায়ের কার্যক্ষমতা হারিয়েছি। তাতেই আমি জানি প্রতিবন্ধী হয়ে জীবন সংগ্রাম কত কঠিন। আমি এক পায়ের কার্যক্ষমতা হারিয়ে আমাকে যে জীবন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে , সেখানে যার চোখ নেই তার অবস্থা ভেবে এই সিদ্ধান্ত তাঁর।