সুপারশপের ব্যবসা

২,৬৫০ কোটি টাকার রেকর্ড ব্যবসা স্বপ্নের, পাঁচ বছরে বিক্রি বেড়ে দ্বিগুণ

এক অর্থবছরে ২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকার রেকর্ড ব্যবসা করেছে সুপারশপ স্বপ্ন। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী এসিআইয়ের সহযোগী এই প্রতিষ্ঠানটি সর্বশেষ ২০২৪–২৫ অর্থবছরে এই ব্যবসা করেছে। এসিআইয়ের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। গত রোববার এসিআইয়ের বার্ষিক সাধারণ সভা বা এজিএমে এই আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়।

আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে স্বপ্নের ব্যবসায় প্রায় ১৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তাতে পুরো অর্থবছরে এই সুপারশপটি ২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। তার আগের অর্থাৎ ২০২৩–২৪ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসা করেছিল ২ হাজার ২৮৫ কোটি টাকার। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে স্বপ্নের ব্যবসা বেড়েছে ৩৬৫ কোটি টাকার বা প্রায় ১৬ শতাংশ। ব্যবসা যতটা বেড়েছে পণ্য বিক্রি বাবদ খরচও বেড়েছে সেই হারে। গত অর্থবছরে ২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকার ব্যবসার বিপরীতে স্বপ্নের পণ্য বিক্রি বাবদ খরচ করতে হয়েছে ২ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ২ হাজার ২৮৫ কোটি টাকার ব্যবসার বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির পণ্য বিক্রি বাবদ খরচ ছিল ১ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এসিআইয়ের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসিআই লজিস্টিকসের আওতায় স্বপ্ন ব্র্যান্ডের সুপারশপটি পরিচালিত হয়। গত অর্থবছর শেষে দেশজুড়ে স্বপ্নের আউটলেটের সংখ্যা ছিল ৬৮৩টি। এই অর্থবছরেই স্বপ্ন দেশের ৬৪ জেলাতেই তাদের আউটলেট সম্প্রসারণ করেছে। তাতে ব্যবসাও বেড়েছে স্বপ্নের।

এ ছাড়া গত অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি যখন দুই অঙ্কের ঘর ছাড়িয়ে যায় তখন সাধারণ ভোক্তাদের চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে স্বপ্ন ‘সবার জন্য সাশ্রয়ী পুষ্টি’ স্লোগানে গরুর মাংস বিক্রির একটি কম্বো প্যাক চালু করে। তাতে ব্যাপক সাড়াও পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এই বিশেষ উদ্যোগে ফলে মাত্র ১৫ দিনে ১৪ লাখ ৩০ হাজার গ্রাহক এই কম্বো প্যাকটি কিনেছে। এই উদ্যোগও প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা বাড়াতে সহায়তা করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।

এদিকে ব্যবসা বাড়লেও অর্থবছর শেষে বড় অঙ্কের লোকসান করেছে স্বপ্ন। গত অর্থবছর শেষে স্বপ্নের লোকসান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭৩ কোটি টাকায়। তার আগের অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ১৯৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে স্বপ্নের লোকসান বেড়েছে ৭৭ কোটি টাকা বা ৩৯ শতাংশ। লোকসান বৃদ্ধির বড় কারণ ঋণের সুদ বাবদ প্রতিষ্ঠানটির খরচ বেড়ে যাওয়া। এ কারণে পরিচালন মুনাফার পরও প্রতিষ্ঠানটিকে লোকসান গুনতে হয়েছে। গত অর্থবছরে সুদ বাবদ স্বপ্ন সুপারশপকে পরিশোধ করতে হয়েছে ২৯৩ কোটি টাকা। তার আগে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে এই খাতে স্বপ্নের ব্যয় ছিল ২১৪ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সুদ বাবদ প্রতিষ্ঠানটির খরচ বেড়েছে ৭৯ কোটি টাকা বা প্রায় ৩৭ শতাংশ।

আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর শেষে স্বপ্ন ২১ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। এরপর সুদ ব্যয় ও কর পরিশোধের পর প্রতিষ্ঠানটির লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় পৌনে ৩০০ কোটি টাকায়। গত অর্থবছরে স্বপ্ন আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ কর পরিশোধ করেছে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি কর বাবদ সরকারকে দিয়েছে প্রায় ২৭ কোটি টাকা। তার আগের অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল প্রায় ১৪ কোটি টাকা।

কর বাবদ খরচ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত অর্থবছরে সুপারশপের পণ্য বিক্রির ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশে উন্নীত করা হয়। তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এসে সেই ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়। তবে তার আগে বাড়তি ভ্যাট গুনতে হয়েছে সুপারশপগুলোকে।

স্বপ্নের গত পাঁচ বছরের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০–২১ অর্থবছরে স্বপ্ন ১ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। তার বিপরীতে অর্থবছর শেষে প্রতিষ্ঠানটি কর–পরবর্তী লোকসানের পরিমাণ ছিল ১৪২ কোটি টাকা। ২০২১–২২ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ১ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকার ব্যবসা করে। তার বিপরীতে ওই অর্থবছর শেষে প্রতিষ্ঠানটির কর–পরবর্তী লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৩৬ কোটি টাকা। তার পরের বছর অর্থাৎ ২০২২–২৩ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসা করেছে ১ হাজার ৮৩২ কোটি টাকার। তার বিপরীতে কর–পরবর্তী লোকসান দাঁড়ায় প্রায় ১৫৩ কোটি টাকা। আর ২০২৩–২৪ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসা করেছে ২ হাজার ২৮৫ কোটি টাকার। তার বিপরীতে কর–পরবর্তী লোকসান ১৯৬ কোটি টাকা। আর সর্বশেষ ২০২৪–২৫ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসা করেছে ২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকার। তার বিপরীতে কর–পরবর্তী লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭৩ কোটি টাকা।

স্বপ্নের গত পাঁচ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০–২১ অর্থবছর বাদে বাকি চার অর্থবছরই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালন মুনাফা করেছে। তা সত্ত্বেও ব্যাংকঋণ ও সরকারের কর পরিশোধের পর পরিচালন মুনাফা বড় অঙ্কের লোকসানে পরিণত হয়। আর সেটি হয়েছে মূলত ব্যাংকঋণ বাবদ খরচ বেড়ে যাওয়ায়। এই পাঁচ অর্থবছরের প্রতিবছরই প্রতিষ্ঠানটির সুদ বাবদ খরচ বেড়েছে। এ কারণে লোকসানের বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।

জানতে চাইলে এসিআই লজিস্টিকের (স্বপ্ন) এমডি সাব্বির হাসান নাসির প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে স্বপ্ন যে মডেলে পরিচালিত হয়েছে, তাতে বড় অঙ্কের লোকসানি ছিল প্রতিষ্ঠানটি। আর এই লোকসান পোষাতে মূল কোম্পানি ও ব্যাংকঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করা হয়েছে। তাতে হাজার কোটি টাকার বেশি ক্রমবর্ধমান ঋণ জমে গেছে। যার বিপরীতে বছর বছর সুদ হিসাব করা হচ্ছে। ফলে গত কয়েক বছরে পরিচালন মুনাফায় ফিরলেও প্রকৃত মুনাফা করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক করতে বিজনেস মডেলে কিছুটা পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। ক্রমবর্ধমান বা পুঞ্জীভূত ঋণকে মূলধনে রূপান্তর করা হলে শিগগিরই স্বপ্ন লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। সেই প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবছর আমাদের ব্যবসা যে হারে বাড়ছে তাতে ঋণকে মূলধনে পরিণত করা হলে চলতি অর্থবছর শেষে এটি লাভের মুখ দেখবে।’