দেশের কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতে ঋণের সুদহার বেড়েছে। অন্যদিকে ঋণ বিতরণও কমে এসেছে। ফলে অর্থায়ন সংকটে পড়েছেন অনেক সিএমএসএমই উদ্যোক্তা। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কর্মসংস্থানও। কারণ, এ খাতই সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করেছে।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ব্যাংকগুলোতে এখন এসএমই ঋণের সুদহার ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ। তবে পুনঃ অর্থায়ন সুবিধার ঋণের ক্ষেত্রে সুদহার ৭ থেকে ৮ শতাংশ। চড়া সুদ থাকায় সিএমএসএমই খাতের বিকাশের গতি কমে এসেছে। এ ছাড়া অনেক ব্যাংক ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
২০২০ সালে সিএমএসএমইসহ সব ঋণে সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি তখন মন্দা কাটাতে বিভিন্ন ঋণ প্যাকেজ দেওয়া হয়। ফলে সিএমএসএমই খাত অনেকটা ঘুরে দাঁড়ায়। তবে ২০২২ সালে সুদহার বাজারভিত্তিক করা ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে ছোট উদ্যোক্তারা আবার চাপে পড়েন। অন্যদিকে এই সময়ের মধ্যে নতুন করে আর কোনো সহায়তাও দেওয়া হয়নি। ফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ কমিয়ে দেয়।
দেশের অর্থনীতিতে সিএমএসএমই খাতের অবদান প্রায় ৩২ শতাংশ। ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে, দেশে ৭৮ লাখের বেশি সিএমএসএমই শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। শিল্প খাতের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৫ শতাংশ হয় এ খাত থেকে; সংখ্যাটি আড়াই কোটির বেশি। এসএমই ফাউন্ডেশন জানায়, ৭৮ লাখ সিএমএসএমইর মধ্যে মাত্র ৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ঋণের আওতায় রয়েছে। অর্থাৎ এসএমই খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ও পরিধি দুটোই কম।
দেশে ৭৮ লাখের বেশি সিএমএসএমই শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। শিল্প খাতের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৫ শতাংশ হয় এ খাত থেকে; সংখ্যাটি আড়াই কোটির বেশি। এসএমই ফাউন্ডেশন জানায়, ৭৮ লাখ সিএমএসএমইর মধ্যে মাত্র ৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ঋণের আওতায় রয়েছে।
ব্যাংকের মোট ঋণের অন্তত ২৫ শতাংশ সিএমএসএমই খাতে বিতরণের নির্দেশনা রয়েছে। তবে এ খাতে ঋণ রয়েছে ১৮ শতাংশের কম। এ খাতে ঋণ বাড়ার পরিবর্তে উল্টো কমে আসছে। নির্দেশনা অনুযায়ী, সিএমএসএমই খাতের ঋণের ২৫ শতাংশের অর্ধেক দিতে হবে কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র খাতে। মোট সিএমএসএমই ঋণের মধ্যে উৎপাদনশীল শিল্পে অন্তত ৪০ শতাংশ, সেবায় ২৫ শতাংশ এবং বাকি ৩৫ শতাংশ ব্যবসা উপখাতে বিতরণ করতে হবে। নারী উদ্যোগে দিতে হবে অন্তত ১৫ শতাংশ। যদিও এ ক্ষেত্রেও উৎপাদন ও সেবার তুলনায় ব্যবসায় বেশি ঋণ দিতে আগ্রহ দেখা যায়।
জানা গেছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিতরণ করা সিএমএসএমই খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪ হাজার ২৪১ কোটি টাকা, যা গত বছরের ডিসেম্বরে বেড়ে হয় ৩ লাখ ১৩ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা। যা ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ১৮ দশমিক ৪০ শতাংশ। তবে গত মার্চে ঋণ কমে হয়েছে ৩ লাখ ২ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিবছর সুদহারের কারণে গড়ে ঋণের স্থিতি ১৫ শতাংশ বাড়ার কথা। উল্টো ঋণ কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ যে পরিমাণ ঋণ আদায় হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক কম ঋণ বিতরণ করছে ব্যাংকগুলো। এর কারণ বিশ্লেষণ করে তাঁরা জানান, চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের ৭টিসহ মোট ১৪টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়। এর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে এসব ব্যাংকের গ্রাহকেরা অর্থায়ন সংকটে পড়েছেন। আবার খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় নতুন ঋণে আগ্রহ হারিয়েছে ব্যাংকগুলো।
এসএমই প্রতিষ্ঠান হাতবাক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাফাত কাদির প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থায়নের ক্ষেত্রে সিএমএসএমই খুবই উপেক্ষিত একটা খাত। অথচ এ খাতে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয়। বর্তমানে উচ্চ সুদহার ও ঋণের পরিধি কম হওয়ায় আমরা চাইলেও ব্যবসা বাড়াতে পারছি না। তিন-চার বছর ধরে আমরা খুব চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। তাই সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, সামনের বছরটা যেন এসএমই সহায়ক করা হয়।’
এদিকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়া আরও সহজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) না থাকলেও ছোট উদ্যোক্তাদের পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে পারবে ব্যাংক ও
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এ জন্য কোনো জামানত লাগবে না। পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তারা যাতে আরও বেশি ঋণ পান, সে জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে কারা নারী উদ্যোক্তা হিসেবে বিবেচিত হবেন, সেটিও
পরিষ্কার করা হয়েছে। যেসব ব্যাংকের দেশজুড়ে শাখা-উপশাখা নেই, তারা এ ধরনের ঋণ অন্য ব্যাংকের মাধ্যমেও বিতরণ করতে পারবে। পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণের মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে সাত বছর করা হয়েছে।
নতুন এসব বিধান যুক্ত করে সিএমএসএমই অর্থায়নের নতুন নীতিমালা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী পাঁচ বছর এই নীতিমালা কার্যকর থাকবে। এতে ঋণ আবেদন জমার পর গ্রাহককে তা মোবাইলে খুদে বার্তার মাধ্যমে জানাতে হবে। ৩০ দিনের মধ্যে ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। ঋণ অনুমোদন হলে তা যেমন গ্রাহককে অবহিত করতে হবে, তেমনি অনুমোদন না হলে প্রকৃত কারণসহ গ্রাহককে তা জানাতে হবে। আবেদন অনুমোদন না হলে নতুন করে আবার আবেদন করতে পারবেন গ্রাহকেরা।
বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রত্যাশা করছি যে সামনের দিনে এসএমই খাতে যে অর্থায়ন করা হবে, তার চেয়ে ঋণের কম প্রবৃদ্ধি হবে করপোরেট খাতে। কারণ, অর্থনীতিতে এসএমই খাতের চাহিদা বাড়ছে। এটা আমরা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি। এ জন্য এই খাতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ঋণ অনুমোদন আরও সহজ করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহারের চিন্তা চলছে।’
এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মো. মুসফিকুর রহমান বলেন, ‘সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণ কমে যাওয়া উদ্বেগজনক। কিছু বাস্তব কারণ রয়েছে। যেমন অনেকগুলো ব্যাংক এখন ঋণ দিতে পারছে না; সুদের হার বেশি। তবে আশার দিকও রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তারল্যের সমস্যায় থাকা কিছু ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে। সরকার মূল্যস্ফীতি কমাতে কাজ করছে; মূল্যস্ফীতি কমলে সুদহারও কমে আসবে। এ ছাড়া ঋণ পাওয়া সহজ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক সিএমএসএমই অর্থায়নের নতুন নীতিমালা করেছে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে প্রত্যাশা করছি, চলতি বছরের শেষ নাগাদ এসএমই ঋণের প্রবাহ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে।’