
ডিজিটাল লেনদেন বৃদ্ধিতে ৫ শতাংশ প্রণোদনার সুপারিশ।
ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বাড়াতে রিটার্নের কপি দাখিলের বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়ার দাবি।
দেশে ডিজিটাল অর্থনীতি বেগবান হচ্ছে না। এই না হওয়ার বড় কারণ নগদ লেনদেনের প্রাধান্য। নগদ লেনদেন এখনো দেশের লেনদেন জগতের ‘রাজা’। তবে সময় এসেছে এ নগদ লেনদেনকে নিরুৎসাহিত করার। কারণ, লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস) ও ডিজিটাল লেনদেনই হবে ভবিষ্যৎ। লেনদেনে ডিজিটাল মাধ্যম বেশি ব্যবহার করে চীন, ভারত ইতিমধ্যে তা প্রমাণ করেছে।
অথচ দেশে এমন সব নীতিমালা তৈরি করে রাখা হয়েছে, ক্রেডিট কার্ড নিতে গেলেই আয়কর রিটার্নের কপি দাখিল করতে হয়। আবার নগদ লেনদেনের বদলে মানুষ যে ডিজিটাল লেনদেন বা এমএফএস ব্যবহারে উৎসাহী হবে, তার জন্য কোনো প্রণোদনাও নেই।
বক্তারা বলেন, ডিজিটাল লেনদেন বাড়লে দুর্নীতি-অনিয়ম ও অর্থ পাচার কমবে। তাঁরা ঈদের আগপর্যন্ত ভ্যাট না বাড়ানোর দাবি জানান।
গতকাল বুধবার প্রথম আলো আয়োজিত ‘ডিজিটাল লেনদেনের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা: পরিপ্রেক্ষিত ভ্যাট বৃদ্ধি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ কথাগুলো বলেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান। প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন পুরো আলোচনা সঞ্চালনা করেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তারা বলেন, সামনে ঈদুল ফিতর। এ সময় সামনে রেখে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা বাড়ে। এ সময় ভ্যাট বাড়ানো হলে তাতে সব খাতের ব্যবসা কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণে ঈদের আগপর্যন্ত ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত না নেওয়ার আহ্বান জানান তাঁরা।
আলোচনার শুরুতে ডিজিটাল লেনদেনের বর্তমান পরিস্থিতি, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মাস্টারকার্ড বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল। তিনি তাঁর প্রবন্ধে ক্রেডিট কার্ডের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেন। প্রবন্ধে তিনি সুপারিশ করেন ডিজিটাল লেনদেন বাড়াতে এ খাতে ৫ শতাংশ প্রণোদনার। যার ৩ শতাংশ পাবেন গ্রাহকেরা আর ২ শতাংশ পাবেন সেবাদানকারী এজেন্টরা।
অনুষ্ঠানে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান খান চৌধুরী বলেন, এমএফএস হচ্ছে দেশের আর্থিক লেনদেনের ভবিষ্যৎ। চীন, ভারত ইত্যাদি দেশ বেশি এমএফএস ব্যবহার করে তার প্রমাণ দিয়েছে।
অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের এমডি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বৈদেশিক লেনদেনের বিধিমালা হালনাগাদ করার পাশাপাশি এনবিআরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ধরার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, চিকিৎসা ব্যয় বাবদ বছরে ৫ থেকে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হুন্ডি হয়ে যাচ্ছে। এটা রোধ করতে হবে। উৎপাদনমুখী কারখানা গড়ে উঠছে না এবং কর্মসংস্থান কম হচ্ছে বলে নিজের পর্যবেক্ষণের কথা জানান তিনি।
সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন বলেন, ক্রেডিট কার্ডে ঋণ নিতে হলে রিটার্ন জমা দিতে হয়। তবে ব্যক্তিগত ভোক্তা ঋণ নিলে রিটার্ন জমা দিতে হয় না। এর ফলে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বাড়ছে না। ক্রেডিট কার্ডে ঋণে রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া উচিত। দেশে মাত্র ২৫ লাখ কার্ড রয়েছে, অথচ হওয়া উচিত ১ কোটি।
এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশ লিমিটেডের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মঈনুদ্দিন মোহাম্মদ রাহগীর বলেন, ১০০ টাকা বিদ্যুৎ বিল এমএফএসের মাধ্যমে পরিশোধের ক্ষেত্রে গ্রাহককে ১০২ টাকা দিতে হয়। অথচ বাড়তি টাকা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের দেওয়া উচিত, গ্রাহকের নয়।
এসিআই লজিস্টিকসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সাব্বির হাসান নাসির বলেন, সুপারশপে ভ্যাট ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। একসময় তা ১ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল। এই ভ্যাট আর না বাড়িয়ে বর্তমানের ৫ শতাংশই বহাল রাখার দাবি জানান তিনি।
সুপারশপ থেকে ১৫৫ কোটি টাকা ভ্যাট নিলেও সুপারশপের বাইরের সাধারণ বাজার থেকে কোনো ভ্যাট সরকার পাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন সাব্বির হাসান নাসির। তিনি বলেন, সবার কাছ থেকে নিতে পারলে ৫ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট সংগ্রহ সম্ভব।
পোশাকের ব্র্যান্ড লা-রিভের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মন্নুজান নার্গিস বাংলা কিউআর কোডের ব্যবহার বাড়াতে না পারার ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, বাংলা কিউআর কোডে লেনদেনে একটি সফল হলে ১০টি হয় না। অন্তত ৮০ শতাংশ যেন সফল হয়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
ভ্রমণ খাতের সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান শেয়ার ট্রিপের এমডি সাদিয়া হক বলেন, ভ্রমণকে বৃহত্তর অর্থনীতির অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। করা হলে বাংলাদেশ থেকে বাইরে যাওয়া শুধু বাড়বে না, অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশেও পর্যটক বাড়বে।
আলোচকদের কারও বক্তব্যের সঙ্গেই দ্বিমত পোষণ করেননি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও এনবিআর চেয়ারম্যান। ডিজিটাল লেনদেন বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন বলেও তাঁরা আশ্বাস দেন।
ব্যাংকে আমানত রাখলে তিন হাজার টাকা করে কেন কেটে রাখা হবে—এমন প্রশ্ন তুলে গভর্নর এনবিআর চেয়ারম্যানের উদ্দেশে বলেন, এমন বিধান ব্যাংকে আমানত রাখতে মানুষকে নিরুৎসাহিত করে।
মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস) বা ইন্টারনেট ব্যাংকিং, যাই বলি না কেন—একে জনপ্রিয় করতে স্মার্টফোনকে সস্তা করতে হবে বলে মনে করেন গভর্নর। তিনি বলেন, এমএফএস বা ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের ব্যবহারকারী বাড়লে করও বাড়বে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলা কিউআর কোড চালু করা হলেও জনপ্রিয় হয়নি। তাঁর প্রশ্ন, একই ধরনের সেবায় ভারত পারলে বাংলাদেশ কেন পারবে না?
আর এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, আগামী বাজেটে ব্যবসায়ীদের তিনি চাপ দেবেন না। এ সময় তিনি ভ্যাট হার কমিয়ে একক হার চালুর বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সহায়তা চান।