জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভবন
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভবন

ফিরে দেখা ২০২৫

রাজস্ব খাতে বড় সংস্কারের উদ্যোগে এনবিআরে নজিরবিহীন আন্দোলন

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে অন্যতম বড় সংস্কার হলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা—এই দুটি বিভাগ করা হয়। গত ১২ মে এই অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এখন চলছে বাস্তবায়নের কাজ। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই দুটি বিভাগ কাজ করবে, এমন প্রত্যাশা সরকারের নীতিনির্ধারকদের।

অন্যদিকে এনবিআর তথা রাজস্ব খাতে এই সংস্কার নিয়ে নজিরবিহীন আন্দোলন করেছেন শুল্ক-কর কর্মকর্তারা। এ জন্য কয়েক দিন কাজও পুরোপুরি বন্ধ ছিল। থমকে যায় রাজস্ব আদায় ব্যবস্থাপনা। ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতায় আন্দোলন প্রত্যাহারের পর এনবিআরের সদস্য থেকে শুরু করে কমিশনারসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বরখাস্তের পাশাপাশি অবসরে পাঠানো হয়। এটিও এনবিআরের ইতিহাসে নজিরবিহীন।

অবশ্য আন্দোলনকারীদের দাবি অনুসারে, রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা দুটি বিভাগেই রাজস্ব খাতের অভিজ্ঞদের নিয়োগসহ ঘোষিত অধ্যাদেশে বেশ কিছু সংশোধনী আনে সরকার। এখন সে অনুসারে, দুটি বিভাগের কার্যক্রম বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলেছে। এখনো দুটি বিভাগ আলাদা করে কাজ শুরু করতে পারেনি।

দেশের ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদেরা দীর্ঘদিন ধরে রাজস্ব খাতের নীতি ও আদায় আলাদা করার দাবি জানিয়ে আসছেন। তাঁদের যুক্তি হলো যাঁরা রাজস্বসংক্রান্ত আইন ও নীতি প্রণয়ন করবেন, তাঁরা রাজস্ব আদায় করলে অনেক সময় তা স্বার্থের দ্বন্দ্ব হতে পারে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে অযাচিত ও অযৌক্তিকভাবে নতুন নতুন শুল্ক-কর চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকে।

রাজস্ব খাত সংস্কারের উদ্দেশ্য হলো করহার নির্ধারণের মতো নীতিগত কাজ এবং কর আদায়ের কাজ পৃথক রাখা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের একটি শর্ত ছিল, রাজস্ব নীতি ও আদায়ের কাজে আলাদা সংস্থা করা। বাংলাদেশ হলো বিশ্বের সবচেয়ে কম কর–জিডিপি এমন দেশগুলোর একটি। এখনো জিডিপির অনুপাকে কর আদায় ৭–৮ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, রাজস্ব খাতের যে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত। এতে অর্থনীতি উপকৃত হবে। যত দেরি হবে, তত সুযোগ নষ্ট হবে।

জুন মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা কর্মচারী আন্দোলন করেন

সংস্কার নিয়ে যা হলো

অন্তর্বর্তী সরকার এসে রাজস্ব খাত সংস্কার নিয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদের নেতৃত্বে একটি গঠন করা হয়। পরে ওই কমিটি ২০২৫ সালের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টার কাছে রাজস্ব খাত সংস্কারের প্রস্তাব প্রতিবেদন জমা দেয়।

এর কয়েক মাস পরে মে মাসে এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ ২০২৫ নামে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, রাজস্ব নীতি বিভাগ কর আইন প্রয়োগ ও কর আদায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। রাজস্ব সংগ্রহের মূল কাজ করবে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ।

রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক পদগুলো প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের রাখা হয়েছে। কিন্তু বিসিএস আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডার কর্মকর্তাদের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়।

গত ১২ মে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারির পর এর বিরোধিতা করে প্রায় দেড় মাসজুড়ে আন্দোলন করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গত জুন মাসের শেষের দিকে দেশের শুল্ক-কর কার্যালয়ে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। অর্থবছরের শেষ সময়ে রাজস্ব আদায় হুমকির মুখে পড়ে। জুন মাসের শেষ দিকে টানা কয়েক দিন রাজধানীর এনবিআরসহ দেশের সব শুল্ক-কর কার্যালয়ে কাজ বন্ধ থাকে। এনবিআর ইতিহাসে এমন কখনো হয়। সারা দেশে অবস্থান কর্মসূচির পাশাপাশি মিছিল-সমাবেশ চলে। স্থবির হয়ে যায় পুরো রাজস্ব খাত।

এমন অবস্থায় ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতায় আন্দোলন স্থগিত করেন এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এরপর এনবিআরে আন্দোলনের জেরে বরখাস্ত, বদলিসহ নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বরখাস্তসহ নানা ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়। অনেককে অবসরে পাঠানো হয়।

পরে অবশ্য অধ্যাদেশটি সংশোধনের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি পরের এক মাসে ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে। সেই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে অধ্যাদেশটি সংশোধন কর করা হয়।

মূল সংশোধন কী হলো

রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫ বলা হয়েছিল, সরকার উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব পদে নিয়োগ করবে। এখন সংশোধন করে বলা হয়েছে, সরকার সামষ্টিক অর্থনীতি, বাণিজ্য নীতি, পরিকল্পনা, রাজস্ব নীতি বা রাজস্ব ব্যবস্থাপনা কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব পদে নিয়োগ প্রদান করবে।

মূল অধ্যাদেশে বলা হয়েছিল, সরকার রাজস্ব আহরণসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতা আছে, এমন যোগ্য কোনো সরকারি কর্মচারীকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদান করবে। এখন সংশোধনীতে বলা হয়েছে, সরকার রাজস্ব আহরণসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতা আছে, এমন যোগ্য কোনো সরকারি কর্মচারীকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব পদে নিয়োগ প্রদান করবে।

এ ছাড়া ওই দুই বিভাগে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট কাজে অভিজ্ঞদের নিয়োগ দেওয়া হবে।

এনবিআরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই দুটি বিভাগ যেন দ্রুত কাজ শুরু করতে পার, সে জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দুটি বিভাগের কাজ করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করি।’