আলোচনার জন্য আবার সময় চেয়ে অনুরোধ বাংলাদেশের, তৈরি হচ্ছে চূড়ান্ত অবস্থানপত্র

পাল্টা শুল্কহার কমানোর ব্যাপারে তৃতীয় দফার আলোচনা করতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) কাছে সময় চেয়ে আবার ই-মেইল করেছে বাংলাদেশ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গতকাল সোমবার ই–মেইল পাঠিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরুর সময় চেয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এর আগেই অবশ্য ইউএসটিআর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, এ সময়ে সংস্থাটির কর্মকর্তারা এত ব্যস্ত যে তাঁদের পক্ষে সময় বের করা কঠিন। ফলে বাংলাদেশ যেন তাঁদের কাছ থেকে সময় নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রে যায়, এটি ইউএসটিআরের চাওয়া।

এদিকে আজ মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এ বিষয়ে চূড়ান্ত অবস্থানপত্র পাঠাতে পারে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ কী কী বিষয়ে একমত হতে পারবে, সেগুলো অবস্থানপত্রে বলা হতে পারে।

বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান গত রোববার রাতে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ইউএসটিআর তাদের কাছ থেকে সময় না নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে নিরুৎসাহিত করছে। কারণ হচ্ছে, আলোচনা করতে ইউএসটিআরের অনেক লোক নিয়ে বসতে হয় এবং তাদের একটা প্রস্তুতির ব্যাপার থাকে।

জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সময় চেয়েছি, তারা তাদের সময় জানাবে। আগেরবারও অল্প সময়ের মধ্যেই গিয়েছিলাম।’ ইউএসটিআর যে ট্রাম্প প্রশাসনেরই দায়িত্বপ্রাপ্ত ও উপযুক্ত সংস্থা, সে কথাও জানান বাণিজ্যসচিব।

জানা গেছে, বাংলাদেশের অবস্থানপত্র চূড়ান্ত করতে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন গতকাল বিকেলে সচিবালয়ে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেনটেটিভ ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন।

যুক্তরাষ্ট্র গত ২ এপ্রিল দেশটিতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ওপর ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়। ওই দিন ৬০টি দেশের পণ্য আমদানিতে পাল্টা শুল্ক আরোপ করে ট্রাম্প প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ৯ এপ্রিল তা তিন মাসের জন্য স্থগিতও করে যুক্তরাষ্ট্র।

পাল্টা শুল্কহার কমিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দুই দফায় আনুষ্ঠানিক আলোচনা করে সাফল্য পায়নি বাংলাদেশ। এরই মধ্যে গত ৮ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি চিঠি পাঠিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে জানিয়ে দেন বাংলাদেশের ওপর আরোপ করা পাল্টা শুল্কের হার ৩৭ শতাংশ হবে না, এটা হবে ৩৫ শতাংশ।

এমন ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পোশাক পণ্য তৈরি করা দেশের রপ্তানিকারকেরা হতাশ হয়ে পড়েন। সরকারের প্রস্তুতির ঘাটতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন তাঁরা। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সমালোচনা করেন দেশের অর্থনীতিবিদেরাও।

এদিকে গত জুনের মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ হঠাৎ নন–ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (এনডিএ) করে বসে। এ কারণে দেশটির সঙ্গে আলোচনার কোনো বিষয় সরকার কারও কাছেই প্রকাশ করতে পারছে না।

শুল্কহার কমানোর বিষয়ে প্রথমে প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা লুৎফে সিদ্দিকী ও পরে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল সরকার। শেষ ধাপে অর্থাৎ চলতি জুলাই মাসের ৩ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত হন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।

৯ থেকে ১১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে ইউএসটিআরের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শেষে দেশে ফিরে গত ১৪ জুলাই অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। বৈঠকে তিনি খোলামেলা আলোচনা করতে পারেননি এনডিএ থাকার কারণে। ফলে তাঁদের কেউ ভালো কোনো পরামর্শও দিতে পারেননি।

এই ফাঁকে পাল্টা শুল্কের হার কমানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহানুভূতি পেতে বাংলাদেশ দেশটি থেকে আমদানি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়। গত রোববারই যুক্তরাষ্ট্র থেকে বছরে ৭ লাখ টন গম আমদানির জন্য সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) করা হয়েছে। আবার যেসব পণ্য আমদানি করা হয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে, সেগুলোর ওপর শুল্ক প্রায় শতভাগ প্রত্যাহারের পক্ষেও সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

লবিস্ট নিয়োগ প্রসঙ্গ

এ ধরনের আলোচনা ও দর-কষাকষি করতে বাংলাদেশ অভ্যস্ত নয় বলে শুরু থেকেই লবিস্ট নিয়োগের দাবি জানিয়ে আসছিলেন রপ্তানিকারকেরা। কিন্তু সরকারের দিক থেকে তা আমলে নেওয়া হচ্ছিল না। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শেষ দিকে এসে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে বলে জানা গেছে। সরকারের ইতিবাচক বার্তা পাওয়ায় ব্যবসায়ীরাও এ ব্যাপারে মনোযোগী হয়েছেন।

পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী ১০-১১ দিনে খুব ইতিবাচক কিছু পাওয়া কঠিন। তারপরও আমরা লবিস্ট নিয়োগ করতে চাই। কারণ, হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষিটা চালু রাখতে চাই আমরা।’

কোনো কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি পাল্টা শুল্ক কার্যকরের সময়সীমা বাড়ান, তাহলে আলোচনার আরেকটি দরজা চালু থাকবে—এমন আশাবাদের কথা জানিয়ে মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘লবিস্ট নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ করতেই সাত দিন লেগে যেতে পারে। তবে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আমাদের এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, বিদেশি ক্রেতারাও চেষ্টা করছে। তবে তারা পরিষ্কার করে কিছু বলছে না।