• পিপিআরসির হিসাব অনুসারে, প্রতি চারজনে একজন দরিদ্র
• বিশ্বব্যাংক বলছে, গত এক বছরে দারিদ্র্য বেড়েছে
• ৫ দশকের সেরা সাফল্য ছিল দারিদ্র্য বিমোচন
• উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকার বেশি

দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশ সাফল্য দেখালেও হঠাৎ ছন্দপতন ঘটেছে। কোভিডের পর পর আবার দারিদ্র্য বাড়তে শুরু করেছে। তিন বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। তাতে বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে।
আবার কয়েক বছর ধরে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতি থমকে আছে। ফলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ কমেছে। ফলে কাজপ্রত্যাশীরা বিপাকে পড়েছেন। এটিও দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা।
আবদুস সালাম রাজধানীর আশকোনা এলাকায় সেলুনে কাজ করেন। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ছোটখাটো ভাড়া ফ্ল্যাটে থাকেন। সব মিলিয়ে মাসে সংসার খরচ এখন ২৫-৩০ হাজার টাকা। এক বছর আগেও প্রতি মাসে ২০-২৫ হাজার টাকায় সংসার চালানো যেত, যা আয় হতো, তা দিয়েই কষ্টেসৃষ্টে চলত তাঁর সংসার। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আবদুস সালামকে।
তাই আবদুস সালাম আগামী মাসে পরিবারকে গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন। নিজে একটি মেসে ওঠে যাবেন। এভাবেই আবদুস সালামের জীবনসংগ্রাম আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে আবদুস সালাম বলেন, ‘কয়েক মাস ধরে ধারদেনা করে চলছি। এখন আর কুলাতে পারছি না। নিরুপায় হয়ে স্ত্রী-সন্তানদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
আবদুস সালামের মতো এমন বহু সীমিত আয়ের মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে। অনেকেই গরিব হয়ে গেছেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদেরও এখন সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
প্রতিবছর ১৭ অক্টোবর আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে পালিত হয়। এ দিবসটি এমন এক সময় পালিত হচ্ছে, যখন বাংলাদেশে দারিদ্র্য হার বৃদ্ধির কথা বলছে বিশ্বব্যাংকসহ দেশি বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্যের জন্য ২০১৬ সালে বাংলাদেশে শোকেস কর্মসূচি পালন করেছিল বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম ঢাকায় এসে ‘দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্বে বাংলাদেশ’ শীর্ষক গণবক্তৃতা দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন দারিদ্র্য বিমোচনের উল্টো পথে হাঁটছে বাংলাদেশ।
দারিদ্র্য কত বাড়ল
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জাতীয় খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুসারে, ওই বছর দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এরপর আর এই জরিপটি হয়নি।
সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) ‘ইকোনমিক ডায়নামিকস অ্যান্ড মুড অ্যাট হাউসহোল্ড লেবেল ইন মিড ২০২৫’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে এখন দারিদ্র্যের হার ২৭ দশমিক ৯৩ বা প্রায় ২৮ শতাংশ। গত মে মাসে এই গবেষণা করা হয়। এ ছাড়া ১৮ শতাংশ মানুষ যেকোনো সময় গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
এর মানে হলো, গত তিন বছরের মধ্যে দরিদ্র লোকের সংখ্যা বেড়েছে প্রতি ১০০ জনে ১০ জন। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রতি ৪ জনে ১ জন দরিদ্র মানুষ। অথচ ২০১৬ সালের বিবিএসের হিসাবে, দেশে দারিদ্র্য হার ছিল ২৪ শতাংশের মতো।
পিপিআরসির মতো সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল সাড়ে ২০ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২১ দশমিক ২ শতাংশে।
দারিদ্র্যের সংজ্ঞা
বিবিএসের মানদণ্ড অনুসারে, খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবা কেনার জন্য একজন মানুষের প্রতি মাসে গড়ে ৩ হাজার ৮২২ টাকা খরচ করার সামর্থ্য যদি না থাকে, তাহলে তাকে দারিদ্র্যসীমার নিচে ধরা হয়। এটি উচ্চ দারিদ্র্যরেখা। পাশাপাশি দারিদ্র্য পরিমাপে ১১৯ ধরনের বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নেয় বিবিএস।
কেন বাড়ল
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক, পিপিআরসি, সানেমসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ২০২২ সালের পর দারিদ্র্য বেড়েছে। সংখ্যার হেরফের হলেও দারিদ্র্য বৃদ্ধি নিয়ে সবাই একমত। ছোটখাটো দুর্যোগ হলে বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যান। বাংলাদেশে এখন অন্তত ১০ কোটি মানুষ এমন ঝুঁকিতে রয়েছেন।’
জাহিদ হোসেনের মতে, দারিদ্র্য বৃদ্ধির মোটাদাগে তিনটি কারণ আছে। প্রথমত, জিনিসপত্রের দাম যে হারে বেড়েছে, সেই হারে আয় বাড়েনি। ফলে জীবনযাত্রার মান নেমে যাচ্ছে। মানুষ গরিব হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, চাহিদা অনুসারে কর্মসংস্থান হয়নি। বরং কমেছে। ২০১৬ সালের পর শিল্প খাতে কর্মসংস্থানের অংশীদারত্ব আনুপাতিক হারে বাড়েনি। শুধু সংখ্যা বেড়েছে। তৃতীয়ত, কোভিডের পর কৃষি খাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে। এর মানে, নিম্ন মজুরির কর্মসংস্থান বেশি হয়েছে, যা দারিদ্র্য কমাতে ভূমিকা রাখতে পারেনি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক রুশিদান ইসলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি অনেক অনুসন্ধানে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গিয়েছে। শিক্ষিত বেকারত্ব হার বৃদ্ধির ফলে শিক্ষার মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসের সম্ভাবনা কমেছে। শুধু তা–ই নয়, বিগত কয়েকটি শ্রমশক্তি জরিপ থেকে দেখা যায়, অধিকাংশ পেশায় গত কয়েক বছরে প্রকৃত মজুরি কমে গেছে। যেসব পেশায় উচ্চশিক্ষা দরকার সেখানেও কমেছে। সুতরাং দারিদ্র্য হার বেড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
জিনিসপত্রের দাম যে হারে বেড়েছে, সেই হারে আয় বাড়েনি। ফলে জীবনযাত্রার মান নেমে যাচ্ছে। মানুষ গরিব হচ্ছে। আবার চাহিদা অনুসারে কর্মসংস্থান হয়নি। বরং কমেছেজাহিদ হোসেন, সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়
পাঁচ দশকের বড় অর্জন দারিদ্র্য বিমোচন
স্বাধীনতার পরপর ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষই হতদরিদ্র ছিল। তখন অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮ শতাংশ। সার্বিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত সাড়ে ৮২ শতাংশ মানুষ। নব্বইয়ের দশক থেকে বিভিন্ন সরকারের আমলে নানামুখী দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি নেওয়ায় পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে। এই কর্মসূচি আরও বেশি গতি পায় ২০০০ সালের পর।
বিবিএসের হিসাবে, ২০০০ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ। পরের ২২ বছরে দারিদ্র্য হার কমে অর্ধেকে নেমে আসে।
বৈষম্য বেড়েছে
গত ৫ দশকে দেশে দারিদ্র্য হ্রাসে বড় সাফল্য থাকলেও ধনী গরিবের বৈষম্য দিন দিন প্রকট হয়েছে। বিবিএসের হিসাবে, ১৯৭৩-৭৪ সালে সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের মোট আয়ের সাড়ে ২৮ শতাংশের মতো ছিল। তখন সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশের মানুষের হাতে ছিল পৌনে তিন শতাংশের মতো আয়। সর্বশেষ ২০২২ সালের হিসাবে, দেশের সবচেয়ে বেশি ধনী ১০ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের মোট আয়ের ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র ১ দশমিক ৩১ শতাংশ।
বৈষম্যের নির্দেশক গিনি সহগ সূচক এখন দশমিক ৪৯৯ পয়েন্ট। দশমিক ৫০০ পয়েন্ট পেরোলেই উচ্চ বৈষম্যের দেশ হিসেবে ধরা হয়। এর মানে হলো, বাংলাদেশ অতি বৈষম্যে দেশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
সাধারণত গিনি সহগ দিয়ে একটি দেশে আয়বৈষম্য কেমন, তা বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়। সবার আয় সমান হলে গিনি সূচক হবে শূন্য। আর সব আয় একজনের হাতে গেলে সূচকটি হবে ১। এই দুই সীমার মধ্যে সূচক যত বাড়ে, অসাম্য তত বেশি। বাংলাদেশে এই বৈষম্য দিন দিন বেড়েছে।
অর্ধেক বেকার শিক্ষিত
কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, দেশে শিক্ষিতদের মধ্যে বেকার বেশি। বিবিএসের জরিপ অনুসারে, দেশে যত স্নাতক ডিগ্রিধারী আছেন, তাঁদের মধ্যে বেকার আছেন সাড়ে ১৩ শতাংশ। আর উচ্চমাধ্যমিক পাস বেকার ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ। এর মানে হলো, উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক ডিগ্রিধারী প্রতি ৫ জনের ১ জন বেকার। দেশে এখন এমন বেকার (উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক ডিগ্রিধারী) আছে প্রায় ১৩ লাখ, যা মোট বেকারের প্রায় অর্ধেক। বিবিএসের হিসাবে, দেশে এখন মোট বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ২৪ হাজার। যাঁরা সপ্তাহে এক ঘণ্টাও মজুরির বিনিময়ে কাজ করার সুযোগ পান না। যাঁদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তাঁরা সবচেয়ে কম বেকার। তাঁদের মধ্যে মাত্র সোয়া ১ শতাংশ বেকার।
একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ২০২২ সালে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন ফাহিম ইবনে আহসান। আড়াই বছর ধরে পছন্দমতো চাকরি পাচ্ছেন না। সর্বশেষ একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়েছিলেন। কিন্তু নিয়মিত বেতন–ভাতা না দেওয়ায় চাকরি ছেড়ে দেন। দুই মাসে ধরে বেকার বসে আছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পছন্দমতো চাকরি পেতে চাই। এ জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেছি। এখনো পরিবারের পাঠানো টাকায় চলতে হয়।’
কেন চাকরি পান না
এ বিষয়ে রুশিদান ইসলাম রহমান বলেন, শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি হওয়ার পেছনে বড় কারণ হচ্ছে শিক্ষার বিষয়বস্তুর প্রাসঙ্গিকতার অভাব এবং শিক্ষার নিম্ন মান। মাধ্যমিকের পর থেকে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত সেখানে আধুনিক কালের কর্মজগতের চাহিদার দিকে কোনো নজর দেওয়া হয়নি, বরং প্রচলিত পাঠ্য তালিকা ও মুখস্থ-নির্ভরতা টিকে আছে। শিক্ষায় নমনীয় দক্ষতা তেমন তৈরি হয় না, যা সব কর্মক্ষেত্রেই দরকার। শিক্ষার সব স্তরে, বিশেষত উচ্চশিক্ষায় মানের অবনমন ঘটেছে। কাজেই নিয়োগকারীদের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষিত তরুণদের যোগ্যতার বড় ফারাক তৈরি হয়।