বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে পোলট্রিশিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়বে। এরই মধ্যে মুরগি ও ডিমের বাজারে তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
নতুন করে আবারও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি সংকটে ফেলেছে পোলট্রি খামারিদের। এমনিতেই পোলট্রি খাবারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এ খাতের ব্যবসায়ীরা সংকটে রয়েছেন। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্ত সেই সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে ব্যবসা টেকানো যাবে কি না, এ নিয়ে বড় ধরনের শঙ্কায় পড়েছেন পোলট্রি খামারিরা।
সরকার গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিটের দাম ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে। খামারিরা বলছেন, এতে পোলট্রি খাতের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। তখন ক্রেতা পর্যায়ে দাম সমন্বয় করতে হবে। সেটি হলে মুরগি ও ডিমের দাম বাড়তে পারে বাজারে।
ক্ষুদ্র খামারিরা বলছেন, ১ হাজার মুরগি পালনের একটি ছাউনিতে শীতকালে প্রতি মাসে বিদ্যুৎ খরচ হয় ২ হাজার থেকে ২ হাজার
৫০০ টাকা। গরমে সেই খরচ আরও ৫০ শতাংশের মতো বেড়ে যায়। তখন প্রতি এক হাজার মুরগির ছাউনিতে খরচ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকায়। নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে প্রতি ইউনিটে খরচ বাড়বে গড়ে ৫ শতাংশ।
খামারিরা বলছেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে শুধু খামারের উৎপাদন খরচ বাড়বে না, মুরগি পালনের অন্যান্য কাঁচামালেরও দাম বাড়বে। এ মূল্যবৃদ্ধির চাপ সামাল দিতে হবে খামারিদের। তাতে অনেক খামার বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। খামারিরা বলছেন, বর্তমানে যে দামে বাজারে মুরগি ও ডিম বিক্রি হচ্ছে তাতে অনেক খামারি লোকসান গুনছেন।
পাবনা চাটমোহরের বিসমিল্লাহ ট্রেডার্সের পরিচালক মিঠু সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘১২৬ দিন ধরে ৪ হাজার মুরগি পালন করছি। ১২০ দিনে ডিম দেওয়ার কথা থাকলেও আবহাওয়ার কারণে এখনো কোনো ডিম পাচ্ছি না। ডিম পেতে হয়তো ১৪০ দিনের মতো লেগে যেতে পারে। এই সময়ে খাবার ও বিদ্যুৎ বিল বাবদ খরচও বেড়ে যাবে। এদিকে জানুয়ারিতে বিদ্যুতের নতুন দাম কার্যকর হলে সেখানেও খরচ বাড়বে। সব মিলিয়ে তাই শেষপর্যন্ত লাভের মুখ দেখব কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছি।’
খামার পর্যায়ে যে দামে মুরগি–ডিম বিক্রি হচ্ছে, তাতে উৎপাদন খরচই উঠছে না। তাতে এরই মধ্যে অনেক খামারি ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। নতুন করে এ খাতে সংকট দেখা দিলে আরও অনেক খামার বন্ধ হয়ে যেতে পারে।সুমন হাওলাদার, সভাপতি, বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন
মিঠু সরকার জানান, একটা মুরগি থেকে সঠিক সময়ে ডিম পেতে হলে সেটিকে দিনে ১৬ ঘণ্টা সূর্যের আলো ও কৃত্রিম আলোতে রাখতে হয়। শীতে অনেক সময় কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে। তখন বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে বাজারে খামারি পর্যায়ে যে দামে ডিম ও মুরগির বিক্রি হচ্ছে, তাতে উৎপাদন খরচই উঠছে না।
নরসিংদীর বেলাবোর এলাকার ব্রয়লার খামারি সোহরাব হোসেন বলেন, ‘সাড়ে ৪ হাজার মুরগির খামারের জন্য গত মাসে তাঁকে বিদ্যুৎ বিল দিতে হয়েছে ১০ হাজার টাকার বেশি। চলতি মাসে বেশি শীত থাকায় খামারে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবহার বেশি হয়েছে। তাতে চলতি মাস শেষে বিদ্যুৎ বিল এমনতিই বাড়বে। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হবে বিদ্যুতের বাড়তি দাম। এমনিতে বেশ কিছুদিন ধরে লোকসানে মুরগি বিক্রি করতে হচ্ছে। নতুন করে খরচ আরও বাড়লে তা আমাদের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।’
এদিকে, ঢাকার খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি ব্রয়লার মুরগির দাম এখন ১৫৫ থেকে ১৬৫ টাকা। আর প্রতি কেজি সোনালি মুরগির দাম ২৬০ থেকে ২৮০ টাকা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। ডিমের দামও বাড়তি। প্রতি ডজন ফার্মের মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডিমের দাম ডজনে ১০ টাকা বেড়েছে।
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিসি) সভাপতি সুমন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, খামার পর্যায়ে যে দামে মুরগি–ডিম বিক্রি হচ্ছে তাতে উৎপাদন খরচই উঠছে না। তাতে এরই মধ্যে অনেক খামারি ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। নতুন করে এ খাতে সংকট দেখা দিলে তাতে আরও অনেক খামার বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) ও বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন ৮০ থেকে ৯০ হাজার ছোট-বড় মুরগির খামার আছে। করোনার আগে সংখ্যাটি ছিল ১ লাখ ১০ হাজারের ওপর। দেশে প্রতিদিন চার কোটির বেশি ডিম উৎপাদিত হয়। আর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দৈনিক মুরগির মাংস উৎপাদিত হয় ৩ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। এসব মাংস ও ডিমের বড় অংশ আসে গ্রামপর্যায়ের খামার থেকে। এসব খামারির বড় অংশ এখন উৎপাদনে টিকে থাকতে পারবেন কি না, তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিপিআইসিসি ও বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুরগির খামারের সঙ্গে ৫০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে। আর পোলট্রিশিল্পের বাজারের বার্ষিক আকার প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার। কিন্তু লোকসানে পড়ে খামার বন্ধ হচ্ছে, তাতে এ বাজারের আকার কমে যাবে বলে জানান সংগঠন দুটির নেতারা।