
শুঁটকি দিয়ে তৈরি বালাচাও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। একসময় সীমিত পরিসরে কক্সবাজার অঞ্চলে বালাচাও বানানো হলেও এখন দেশের নানা প্রান্তেই পাওয়া যায়। বাড়ছে এর বাণিজ্যিক উৎপাদন। অনেক তরুণ উদ্যোক্তা স্বল্প বিনিয়োগ করে বালাচাও তৈরি করে বাজারজাত করছেন। স্বাবলম্বীও হচ্ছেন তাঁরা।
বালাচাও মসলাদার ও মুখরোচক খাবার। তাই এই খাবার দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ছোট চিংড়ি শুঁটকি এই খাবারের প্রধান উপাদান।
গত এক দশকে বাংলাদেশে খাবারের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে এই নতুন খাবার। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও টেকনাফে এটি বেশি তৈরি হয়। সেখান থেকেই এর বড় অংশ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করা হয়। চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এর বাজারও বড় হচ্ছে।
থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারে বালাচাও বেশি পাওয়া যায়। মিয়ানমারে একে বলা হয় ‘বালাচাং’, আর থাইল্যান্ডে ‘কুং হেং’ বা শুকনো চিংড়ি।
ছোট চিংড়ি শুঁটকি দিয়ে বর্তমানে দেশে ৭০ শতাংশের বেশি বালাচাও তৈরি হয়। লইট্টা ও ছুরি শুঁটকি দিয়েও বালাচাও হয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, মূলত কক্সবাজার, টেকনাফ, কুয়াকাটা, ভোলা থেকে সংগ্রহ করা সামুদ্রিক চিংড়ির পোনা দিয়ে বালাচাও তৈরি হয়। বালাচাও দেখতে অনেকটা চানাচুরের মতো। ভাত, খিচুড়ি, ফ্রাইড রাইস ও সালাদসহ বিভিন্ন ধরনের সবজির সঙ্গে এই খাবার খাওয়া যায়।
বালাচাও বানায় এমন একটি প্রতিষ্ঠান হলো খাস ফুড। এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিবুল মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ভোজনরসিক জাতি। তাই মুখরোচক খাবারের তালিকায় বালাচাও ক্রমশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বিগত এক বছরে বালাচাওয়ের বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি।
তিনি জানান, শীত মৌসুমে এর বিক্রি বেড়ে তিন থেকে চার গুণে গিয়ে ঠেকে। তাই অনলাইনেই এর অর্ডার বেশি হয়। প্রায় ৩০টির অধিক অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বালাচাও বিক্রি হয়।
গত এক দশকে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বালাচাও। যদিও কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের মানুষের কাছে বেশ আগে থেকে এর জনপ্রিয়তা আছে। বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন সুপারশপের পাশাপাশি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এটি বিক্রি হয়। অলিগলির দোকানপাটেও জায়গা করে নিচ্ছে বালাচাও।
একসময় কক্সবাজার ও এর আশপাশের এলাকায় বার্মিজ বাজারে বালাচাও বেশি পাওয়া যেত। সে সময় কক্সবাজারের বার্মিজ মার্কেটে এটি নিয়ে আসতেন কিছু ছোট ব্যবসায়ী। পরে আগত পর্যটক ও স্থানীয় লোকজনের কাছে এর চাহিদা থাকায় প্রসার ঘটে এই খাবারের।
ছোট-বড় ৫০টির বেশি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিক্রি হচ্ছে বালাচাও। রাজধানীর সুপারশপ, কনফেকশনারি এমনকি বড় মুদি দোকানেও দেখা মিলে এই পণ্যের।
বর্তমানে কিছু বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান বাজারে তাদের তৈরি বালাচাও নিয়ে এসেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মোহাম্মদপুর এলাকায় আগোরার এক কর্মকর্তা জানান, আমরা কয়েক বছর ধরেই এই পণ্য বিক্রি করছি। প্রতি মাসে আমাদের এই শাখা থেকে ৬০ থেকে ৮০ বয়াম বালাচাও বিক্রি হয়। তবে এই পণ্য উচ্চ–মধ্যবিত্তরাই বেশি কেনেন।
প্রিন্স বাজার লিমিটেডের মোহাম্মদপুর শাখার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার সামসুদ্দিন ওমর প্রথম আলোকে জানান, ২০২৪ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বালাচাওয়ের বিক্রির প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ৪৭ শতাংশ। গত ছয় মাসে আমাদের মোহাম্মদপুর শাখা থেকে ১ লাখ ৮১ হাজার টাকার বালাচাও বিক্রি হয়েছে।
মূলত অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর এই তিন মাস চিংড়ি সংগ্রহ করা হয়। রোদে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হয়। বাকি সময় আড়তদারেরা সংগ্রহ করে রাখেন। পরে চাহিদা অনুযায়ী বাজারে ছাড়েন শুঁটকি ব্যবসায়ীরা।
রাজধানীর বছিলায় থাকেন নাজমুল ইসলাম ও সুমানিয়া ইসলাম দম্পতি। করোনায় নাজমুল ইসলাম চামড়ার ব্যবসায় লোকসান করেন। সুমানিয়া ইসলাম নতুন কিছু করার চেষ্টা করেন। তখন তিনি বালাচাও ব্যবসা শুরু করেন।
সুমানিয়া ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ২০২১ সাল থেকে আমরা ব্যবসা শুরু করেছি। আবাসিক এলাকা হওয়ায় আমাদের উৎপাদনের আকার ছোট। প্রতিদিন আমরা গড়ে ১৫ থেকে ২০ কেজি বালাচাও উৎপাদন করতে পারি। গত বছরেও আমরা মাসে গড়ে ৩ লাখ টাকার বালাচাও বিক্রি করতাম। এখন প্রতি মাসে গড়ে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা বিক্রি হয়।
তিনি আরও বলেন, প্রতি কেজি বালাচাও উৎপাদন করতে খরচ হয় ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। বিক্রি করা যায় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত।
এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বালাচাও সরাসরি রপ্তানি পণ্য হিসেবে বিদেশে যাচ্ছে না। তবে বিদেশে অবস্থান করা বাংলাদেশিদের কাছে এর জনপ্রিয়তা আছে। এই পণ্যে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ও ব্যাংকঋণ সুবিধা না পাওয়ায় এর বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে না। সম্ভাবনাময় এই পণ্যের প্রসার ঘটাতে প্রয়োজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও সরকারি সহায়তা।
নারায়ণগঞ্জের উদ্যোক্তা সুপিরিয়র ফুড বাজারের স্বত্বাধিকারী জাকির হোসেন ২০২১ সালে শুরু করেন অনলাইনে বালাচাওসহ অন্যান্য পণ্যের ব্যবসা। বর্তমানে তিনি নিজের পেজ থেকে বিক্রির পাশাপাশি পাইকারিও বিক্রি করেন।
জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আমারা প্রতিদিন গড়ে ২০ থেকে ২৫ কেজি বালাচাও উৎপাদন করি। এখন সব মিলিয়ে প্রতি মাসে ৬০০ থেকে ৮০০ কেজি তৈরি করি। এ খাতের চ্যালেঞ্জ কী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ খাতে শুঁটকি সংগ্রহে কিছু সিন্ডিকেট রয়েছে। আমরা পণ্যটি কিনে নিয়ে অনলাইনে ব্যবসা করি বলে বাজারে শুঁটকি বিক্রেতারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দেন। গত সপ্তাহে আমি চিংড়ি শুঁটকি কিনেছি ৪৫০ টাকা দিয়ে। আর এ সপ্তাহে দাম বেড়ে হয়েছে ৫২০ টাকা।
বালাচাওয়ের অর্ধেক অংশে থাকে শুঁটকি। কেউ ১০০ ভাগের ৭৫ ভাগ শুঁটকি দেয়। আবার কেউ দেয় ৫০ শতাংশ। আর বাকি অংশে থাকে পেঁয়াজ কুঁচি, রসুন, শুকনা মরিচ, লবণ ও অন্য মসলা। প্রথমে তেলে পেঁয়াজ বেরেস্তা করে তুলে রাখতে হয়।
একই তেলে রসুন মচমচে বাদামি করে ভেজে তুলে নিতে হবে। একইভাবে শুকনা মরিচ ভেজে সবশেষে চিংড়ি শুঁটকি বা অন্য শুঁটকি মচমচে করে ডুবো তেলে ভাজতে হবে। এবার বেরেস্তা, রসুন ভাজা ও মরিচ হাতে ভেঙে চিংড়ির সঙ্গে মিশিয়ে দিন। সবকিছু একটু সময় নিয়ে কম আঁচে ভাঁজতে হবে। তবে এক তেল দিয়ে একবারই বালাচাও তৈরি করা সম্ভব।
সঠিকভাবে বাতাস ও পানি থেকে দূরে রাখলে ৩ থেকে ৪ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। প্লাস্টিক জার বা বয়ামের মুখ ভালোভাবে বন্ধ করে রাখলে অনেক দিন সংগ্রহ করা যায়। এটি ফ্রিজে রাখতে হয় না এবং গরমও করার প্রয়োজন হয় না।
অনেকেই সাদা গরম ভাতের সঙ্গে ভর্তার মতো মাখিয়ে খেয়ে থাকেন। কেউ কেউ আবার চিপস ও চানাচুরের মতো খান। কেউ আবার আলুভর্তার সঙ্গেও খেয়ে থাকেন। অনেকে আবার বালাচাওয়ের সঙ্গে পেঁয়াজ, কাচা মরিচ ও সরিষার তেল দিয়ে মিশিয়ে ভর্তা বানিয়ে খান। মুখরোচক খাবার হিসেবে সবজি, শাক ভাজি, ডাল, খিচুড়ি, সালাদ, মুড়ি মাখা ও পোলাওসহ বিভিন্ন খাবারে এই বালাচাও মিশিয়ে স্বাদ বাড়ানো যায়। বালাচাও খেতে ঝাল হওয়ায় মুখের রুচি ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করে।