বাজারে চলছে বেচাবিক্রি
বাজারে চলছে বেচাবিক্রি

পাকিস্তান আমলের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন বদলে নতুন আইন হচ্ছে

পাকিস্তান আমলের পুরোনো আইন বাদ দিয়ে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বাজার নিয়ে নতুন আইন করতে যাচ্ছে সরকার। ‘নিয়ন্ত্রণ’ শব্দ বাদ দিয়ে আইনটির নামও পাল্টানো হচ্ছে। দীর্ঘ প্রস্তুতির পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ৩ ডিসেম্বর খসড়া চূড়ান্ত করার কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বাংলাদেশে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ এখনো চলছে পাকিস্তান আমলের কাঠামো ধরে। ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৫৬’ নামের এ আইনের বয়স প্রায় ৭০ বছর। পরিবর্তিত বাস্তবতা, বাজারকাঠামো, পণ্যবৈচিত্র্য, সংকটের ধরন, মজুতদারি ও মূল্য কারসাজির রূপ—সবই বদলে যাওয়ায় সরকার আইনটিকে সময়োপযোগী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে প্রস্তাবিত আইনের নতুন নাম রাখা হয়েছে, ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন, ২০২৫’। এখানে ‘নিয়ন্ত্রণ’ শব্দ বাদ দেওয়া হচ্ছে, তবে কার্যকারিতার জায়গায় নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থেকে যাচ্ছে আগের মতোই সরকারের হাতে এবং তা আরও স্পষ্টভাবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন আইন তৈরির কাজ শুরু হয় ২০২১ সালের শেষ দিকে। এরপর ২০২২ সালের শুরুর দিকে ১২ সদস্যের একটি কমিটি প্রাথমিক খসড়া তৈরি করে। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সেটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে জনগণের মতামত নেয়। ব্যবসায়ী সংগঠন, আমদানিকারক, পাইকারি বাজার, আইনবিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকদের মতামতের ভিত্তিতে সংশোধনের বিভিন্ন প্রস্তাব উঠে আসে। আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষে ২০টি ধারা, ১টি তফসিলসহ একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া তৈরি করা হয়।

এরপর খসড়া পাঠানো হয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষে (বাবাকো)। তারা ভাষাগত প্রমিতকরণ ও আইনগত পরিভাষার সামঞ্জস্য বজায় রেখে তা পর্যালোচনা করে এবং তা ফেরত পাঠায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। এখন সেই খসড়া চূড়ান্ত করতেই ৩ ডিসেম্বর সচিবালয়ে কর্মশালা করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, যেখানে সভাপতিত্ব করেন বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, নির্বাচন সামনে থাকায় সরকার এটিকে আর অধ্যাদেশ আকারে আনবে না। নতুন সরকারই আইনটি জাতীয় সংসদে পাস করবে—এমনটাই মন্ত্রণালয়ের প্রত্যাশা। আইন চূড়ান্ত হলে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বাজারে সরকারের হস্তক্ষেপের সুযোগ আরও স্পষ্ট হবে এবং একে ব্যবহার করে বাজারের অস্থিরতা মোকাবিলা করা সহজ হবে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আশা করছেন।

২০১২ সালে সরকার ১৭টি পণ্যকে ‘অত্যাবশ্যকীয়’ ঘোষণা করে। এগুলো হলো পেঁয়াজ, রসুন, ডাল, ছোলা, শুকনা মরিচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচি, ধনে, জিরা, আদা, হলুদ, তেজপাতা, সয়াবিন তেল, পাম তেল, চিনি ও লবণ। নতুন আইনে ধান, চাল, গম, আটা ও আলুকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে যুক্ত করা হচ্ছে। বিদ্যুৎকেও তালিকায় নেওয়া হচ্ছে।

কেন নতুন আইন

খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের খাদ্যনিরাপত্তা, বাজারের স্থিতিশীলতা, ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বচ্ছতা ও ভোক্তার স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সঠিক উৎপাদন, সরবরাহ ও বণ্টন নিশ্চিত করা জরুরি। বর্তমান সময়ে ঘন ঘন বাজার অস্থিরতা, মূল্যবৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহসংকট, যুদ্ধ-বৈরী পরিবেশ এবং মজুতদারি-কারসাজির মতো চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থায় পুরোনো আইন দিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন।

এ ছাড়া সীমিত পণ্যতালিকা, অস্পষ্ট সংজ্ঞা, শাস্তির অসামঞ্জস্য, বাজার তদারকির অপর্যাপ্ত কাঠামো এবং প্রযুক্তিনির্ভর বাজারব্যবস্থার সঙ্গে পুরোনো আইনের অসামঞ্জস্যও আইন প্রণয়নের অন্যতম কারণ।

খসড়া অনুযায়ী, উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ, পরিবহন, সরবরাহ, বিক্রি, আমদানি-রপ্তানি বা ভোগ—যেকোনো ধাপে সরকার প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারবে। প্রয়োজনে পণ্যের বিক্রি স্থগিত বা নিষিদ্ধ করার ক্ষমতাও বহাল থাকবে। মজুতদারি, অতিরিক্ত মুনাফা বা কৃত্রিম সংকট তৈরি করলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে। বাজার অস্থির হলে সরকার জরুরি ভিত্তিতে আমদানি উন্মুক্ত বা সীমিত করতে পারবে।

সরকার যেকোনো অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য নিম্ন আয়ের জনগণের কাছে বিক্রির জন্য ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এবং অন্য যেকোনো সরকারি দপ্তরকে দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে সরাসরি পণ্য কেনার ক্ষমতা দিতে পারবে—খসড়া আইনে এমন প্রস্তাব দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী এখন টিসিবির নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে।

বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা একটা কর্মশালা করেছি। আর এক থেকে বৈঠক করে চূড়ান্ত খসড়া তৈরি করব। খসড়া তৈরিতে আমাদের বিবেচনায় থাকবে ভোক্তা স্বার্থ।’

কী যুক্ত হচ্ছে, কী বাদ

১৯৫৬ সালের মূল আইনে ৩৪ ধরনের শ্রেণিভুক্ত পণ্য ছিল। ভোজ্যতেল, তৈলবীজ, খাদ্যদ্রব্য, কাগজ, জ্বালানি তেল, ইস্পাত, তুলা, সার, ইলেকট্রিক্যাল পণ্য, স্যানিটারি ফিটিংস, সাইকেল, টাইলস থেকে শুরু করে শিশুখাদ্য, সিনেমার কাঁচা ফিল্ম, টাইপরাইটার পর্যন্ত নানা পণ্য অন্তর্ভুক্ত ছিল।

২০১২ সালে সরকার ১৭টি পণ্যকে ‘অত্যাবশ্যকীয়’ ঘোষণা করে—পেঁয়াজ, রসুন, ডাল, ছোলা, শুকনা মরিচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচি, ধনে, জিরা, আদা, হলুদ, তেজপাতা, সয়াবিন তেল, পাম তেল, চিনি ও লবণ।

নতুন আইনে ধান, চাল, গম, আটা ও আলুকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে যুক্ত করা হচ্ছে। বিদ্যুৎকেও তালিকায় নেওয়া হচ্ছে। তবে সাবান, টুথপেস্ট, ডিটারজেন্ট ও কীটনাশকের মতো দৈনন্দিন পণ্যতালিকায় আসছে না।

পণ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকা মানে প্রয়োজন হলে সরকার দাম নিয়ন্ত্রণ, উৎপাদন পর্যবেক্ষণ বা বিপণনের ওপর ব্যবস্থা নিতে পারে। বাজারে কৃত্রিম সংকট বা মজুতদারি হলে আইন প্রয়োগ করা সহজ হয়। তালিকায় না থাকলে এসব প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রেই জটিল হয়। সিগারেট তালিকা থেকে বাদ দিলে এর উৎপাদন-বিপণনে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমে যাবে বলে আলোচনা রয়েছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি এ এইচ এম সফিকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯৫৬ সালের আইন দিয়ে আর কত? অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনটিকে নতুন করে প্রণয়ন করা খুবই দরকার। প্রয়োগ করতে না পারলে কাগুজে আইন করার কোনো দরকার নেই।’

শাস্তির বিধানে পরিবর্তন

আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৩ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানার প্রস্তাব দিয়েছিল। পরে কারাদণ্ড কমিয়ে ২ বছর করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। একটি ধারায় ১ বছরের কারাদণ্ড বাদ দিয়ে জরিমানা ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকার প্রস্তাব আনা হয়েছে।

নতুন খসড়ায় জোর দেওয়া হয়েছে যেন দণ্ড কার্যকর হয় এবং বিচারপ্রক্রিয়া সহজ হয়। তবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না—এমন একটি ধারাকে বাদ দিতে বলেছে, যাতে আইনগত ভারসাম্য রক্ষা হয়।

নতুন আইন কার্যকর হলে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বাজারে সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপ, মূল্য স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ, মজুতদারি রোধ ও ভোক্তা সুরক্ষা—সব ক্ষেত্রেই কার্যকারিতা বাড়বে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আশা। এ আইন দেশের বাজার কাঠামোকে আধুনিক বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি এ এইচ এম সফিকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বোতলজাত পানি, স্যানিটারি ন্যাপকিন, গো খাদ্য, মৎস্য খাদ্য, সাবান, বীজ ইত্যাদি পণ্যকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যতালিকায় রাখার পরামর্শ দিয়েছি।’

ক্যাব সভাপতি আরও বলেন, ‘১৯৫৬ সালের আইন দিয়ে আর কত? অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনটিকে নতুন করে প্রণয়ন করা খুবই দরকার। তবে আমি মনে করি আইন হওয়ার পর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে এর প্রয়োগে। প্রয়োগ করতে না পারলে কাগুজে আইন করার কোনো দরকার নেই।’