Thank you for trying Sticky AMP!!

মালিকদের নতুন আবদার

  • করোনার অজুহাতে আগামী দুই বছর শ্রমিকদের ৫% ইনক্রিমেন্ট দিতে চায় না মালিকদের একটি সংগঠন। এ জন্য তারা শ্রম প্রতিমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছে।

  • সংগঠনের সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমানের স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

করোনা সংকটে সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা পেলেও গত এপ্রিলে শ্রমিকের মজুরি ৩৫ শতাংশ কম দিয়েছেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা। পরে ঈদ বোনাসও কম দিয়েছেন তাঁরা। এবার শ্রমিকের বার্ষিক ৫ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধির (ইনক্রিমেন্ট) ওপর চোখ পড়েছে মালিকদের। তাঁরা আগামী দুই বছর শ্রমিকের ইনক্রিমেন্ট না দেওয়ার আবদার জানিয়েছেন।

তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের বড় দুই সংগঠনের একটি বিকেএমইএ গতকাল রোববার শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানকে এ ব্যাপারে একটি চিঠি দিয়েছে। সংগঠনের সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমানের স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বিভিন্ন খাতে যেখানে বেতন-ভাতা কমানো হয়েছে, সেখানে পোশাকশিল্পে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট বাস্তবসম্মত নয়। বিকেএমইএর এই বক্তব্যকে অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য আবদার বলে মনে করেন শ্রমিকনেতারা।

২০১৩ সালের নিম্নতম মজুরি বোর্ডে প্রথমবারের মতো শ্রমিক-কর্মচারীদের মূল মজুরি ৫ শতাংশ হারে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। পরে ২০১৮ সালের মজুরিকাঠামোতেও তা বহাল রাখা হয়। বর্তমান কাঠামো অনুযায়ী, সপ্তম গ্রেডের শ্রমিকের মোট মজুরি ৮ হাজার টাকা। তার মধ্যে মূল মজুরি ৪ হাজার ১০০ টাকা।

বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট পেলে মূল মজুরি ২০৫ টাকা বৃদ্ধি পাবে। আর বাড়িভাড়া বাড়বে ১০২ টাকা ৫০ পয়সা। সাকল্যে শ্রমিকের মজুরি বাড়বে ৩০৭ টাকা ৫০ পয়সা। অন্যান্য গ্রেডেও একেক হারে মজুরি বাড়বে। এই সামান্য অর্থ না দেওয়ার অভিপ্রায় জানিয়েই শ্রম প্রতিমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছে বিকেএমইএ।

মালিকদের বিবেক-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। তাঁরা যে শুধু মুনাফা বোঝেন, ইনক্রিমেন্ট বন্ধের দাবি তারই প্রমাণ।
বাবুল আক্তার, শ্রমিকনেতা

শ্রম প্রতিমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম গতকাল রোববার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্রেতারা পোশাকের দাম ১০-১৫ শতাংশ পর্যন্ত কম দিচ্ছেন। লোকসান দিয়ে ক্রয়াদেশ নিতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। তারপরও আমরা বেতন কমাইনি। ব্যাংকসহ অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন কমিয়ে দিয়েছে। বর্তমান অবস্থায় ইনক্রিমেন্ট দেওয়াটা বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়। সদস্যরা চেয়েছেন বলেই আবেদন করা হয়েছে।’ কঠিন সময়ে ইনক্রিমেন্ট না দেওয়ার স্বাধীনতা মালিকদের আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অন্যদিকে পোশাকশিল্পের মালিকদের আরেক সংগঠন বিজিএমইএর নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি না দিলেও ইনক্রিমেন্ট কয়েক মাস স্থগিত রাখতে শ্রমসচিবকে মৌখিকভাবে অনুরোধ করেছেন। একই সঙ্গে নতুন করে প্রণোদনা পেতে সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে বলে নিশ্চিত করেছেন সংগঠনের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা।

করোনার কারণে গত মার্চে পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ার পরিস্থিতিতে মালিকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লে সরকার রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। পরে তহবিলটির আকার বেড়ে ৯ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা দাঁড়ায়। সেই তহবিল থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কারখানামালিক নামমাত্র সেবা মাশুল বা সুদে ঋণ নিয়ে চার মাসের মজুরি দেন। দুই মাসের ব্যবধানে পোশাক রপ্তানিতে গতি ফিরলেও বেশ কয়েক হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করেন উদ্যোক্তারা। তার আগে এপ্রিলে কারখানা বন্ধের সময়ে ৩৫ শতাংশ মজুরি কম দেন। এমনকি শ্রমিকের ঈদ বোনাসও কম দিয়েছেন অধিকাংশ মালিক।

বিকেএমইএর ইনক্রিমেন্ট বন্ধের আবেদনের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে শ্রমিকনেতা বাবুল আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, পোশাকশিল্পের মালিকেরা এত সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পরও দুই বছরের জন্য ইনক্রিমেন্ট বন্ধের যে দাবি করেছেন, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে শ্রমিকেরা উৎপাদন করছেন, তাঁদের তো সুপার ইনক্রিমেন্ট দেওয়া দরকার। আসলে মালিকদের বিবেক-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। তাঁরা যে শুধু মুনাফা বোঝেন, ইনক্রিমেন্ট বন্ধের দাবি তারই প্রমাণ। ৫ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি না হলে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সারা বছর যে মূল্যস্ফীতি হয়, সেটি সমন্বয় করার জন্যই ৫% ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ৫.৭৮%। সুতরাং মজুরি ৫% বাড়লেও মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি সমন্বয় হবে না।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি

করোনার কারণে ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ায় গত এপ্রিলে মাত্র ৩৭ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। পরের মাসে ১২৩ কোটি ডলারের রপ্তানি হয়। তারপর রপ্তানি ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে ১ হাজার ৮৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে মাত্র দেড় শতাংশ কম।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সারা বছর যে মূল্যস্ফীতি হয়, সেটি সমন্বয় করার জন্যই ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ। সুতরাং মজুরি ৫ শতাংশ বাড়লেও মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি সমন্বয় হবে না। তিনি বলেন, বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে মালিকদের দর-কষাকষি না করে শ্রমিকদের ঘাড়ে পুরোটা চাপিয়ে দেওয়ার এই মানসিকতা কাঙ্ক্ষিত নয়।